ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গর্ভবতী মায়ের রোজা রাখা না রাখা

প্রকাশিত: ০৭:২৬, ২০ জুন ২০১৭

গর্ভবতী মায়ের রোজা রাখা না রাখা

প্রত্যেক গর্ভবতী মা চায় তার কোলে সুস্থ সন্তানের আগমন হোক। মানব শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যেঙ্গ তৈরি হয় তার মায়ের গর্ভে। আর প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যেঙ্গ সঠিকভাবে তৈরি হওয়ার জন্য গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় নির্দিষ্ট পরিমাণে পুষ্টি, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, পানি ইত্যাদি সরবরাহ জরুরী। এ সময় গর্ভবতী মায়ের শরীরে শিশুর জন্য দরকারী কোন কিছুর অভাব ঘটলে পরবর্তী জীবনে দীর্ঘমেয়াদী বা চিরস্থায়ী প্রভাব পড়ে। একজন মানুষের স্বাস্থ্য, মেধা, জন্মগত রোগ, বিশেষ বিশেষ অসুখে ভোগা অনেক ক্ষেত্রে মাতৃগর্ভে বেড়ে ওঠার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যা বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত। পবিত্র রমজান মাসে গর্ভবতী মায়ের রোজা রাখা না রাখা এবং গর্ভের শিশুর ওপর তার প্রভাব নিয়ে মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোতে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। বেশিরভাগ গবেষণায় দেখা গেছে গর্ভবতী মা দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকলে অনাগত শিশুর জীবনে দীর্ঘমেয়াদী ও স্থায়ী স্বাস্থ্যগত প্রভাব পড়ে। ২০০৯ সালে তেহরান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু বিষেশজ্ঞরা এক গবেষণায় দেখেন গর্ভাবস্থায় রোজা রাখলে কম ওজনের শিশু জন্মদানের ঝুঁকি দ্বিগুণ এবং ছেলে সন্তানদের ওপর এ প্রভাব অনেক বেশি। সৌদি আরবে ২০১০ সালে গর্ভাবস্থায় রোজা রেখেছিলেন এমন সাত হাজার তিরাশি জন মায়ের ওপর গবেষণায় দেখা যায় তাদের গর্ভফুল বা প্লাসেন্টার ওজনও কম। মাতৃজঠরে গর্ভফুলের মাধ্যমেই শিশুর শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও দরকারী উপাদান সরবরাহ হয়ে থাকে। গর্ভফুলের ওজন কম হলে তা শিশুর ওপর তাৎক্ষণিক বা দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য জটিলতা হতে পারে বলে গবেষকরা মতামত দিয়েছেন। এ সম্পর্কিত সবচেয়ে বড় গবেষনাটি হয় ইন্দোনেশিয়ায় ওহফড়হবংরধহ ঋধসরষু খরভব ঝঁৎাবু (ওঋখঝ). অবস্থানগত কারণে ইন্দোনেশিয়ায় প্রত্যেক বছর প্রায় সাড়ে তেরো ঘণ্টা না খেয়ে থাকার প্রয়োজন পড়ে রোজা রাখার জন্য। বর্তমানে গড় বয়স ৩৪ বছর এমন চৌদ্দ হাজার মানুষ যাদের মায়েরা ১৯৬৬ সালের দিকে গর্ভাবস্থায় রোজা রেখেছিলেন, গবেষণায় দেখা যায় তাদের গড় উচ্চতা যাদের মায়েরা ওই সময় রোজা রাখেননি তাদের সন্তানদের চেয়ে কম এবং স্বাস্থ্য ক্ষীণকায়। শুধু তাই নয়, এদের মধ্যে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, করোনারী হার্ট ডিজিজ ও কিডনি রোগে ভোগার হারও বেশি। একই রকম গবেষণায় উগান্ডা ও ইরাকের গবেষকরা দেখেন গর্ভাবস্থায় দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকা মায়েদের সন্তানদের পরিণত বয়সে কানে শোনা, দৃষ্টি শক্তি ও মস্তিষ্কের অনুধাবন শক্তি ক্ষীণ হয়। ১৯৪৪-১৯৪৫ সালে ডাচ ও ১৯৫৯-১৯৬১ সালে চীনে দুর্ভিক্ষের সময় জন্ম নেয়া শিশুদের ক্ষেত্রেও এমন স্বাস্থ্যগত ফলাফল পাওয়া গেছে। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা একটি বিল্ডিং তৈরির সময় যদি সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় রড, সিমেন্ট, বালু ইত্যাদি উপকরণ সরবরাহ করা না হয় তাহলে ভবিষ্যতে উক্ত বিল্ডিংয়ের স্থায়িত্ব বা গুণগতমান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। মায়ের গর্ভে একটি শিশু নির্ধারিত সময়কাল অবস্থান করার সুযোগ পায়। এই গুরুত্বপূর্ণ সময়েই মানব শরীরের জীবন ধারণ, রোগ প্রতিরোধ, মেধা-মনন সবকিছুর প্রয়োজনীয় অঙ্গ প্রত্যেঙ্গ যেমন স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকরী কোষ নিউরন, কিডনির নেফ্রোন, ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষ বিটা সেল ইত্যাদি নির্দিষ্ট সংখ্যায় তৈরি হওয়া প্রয়োজন, কেননা জন্মের পর এ সমস্ত কোষ আর তেমন তৈরি হয় না। চিকিৎসা বিজ্ঞানে একে ঋবঃধষ চৎড়মৎধসসরহম রহ ওহঃৎধ-ঁঃবৎরহব খরভব বলা হয়। মায়ের পেটেই তৈরি হওয়া এসব কোষকলা দিয়েই বাকি জীবন চালাতে হয়। কাজেই গর্ভবতী মা দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকলে নির্ধারিত সময়ে শিশুর শরীরের মূল্যবান কোষ কলা তৈরর জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ নির্দিষ্ট মাত্রায় সরবরাহের ব্যত্যয় ঘটে। যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে শিশুর বাকি জীবনে। চিকিৎসকরা ওজন ভেদে গর্ভবতী মাকে স্বাভাবিক খাবারের চেয়ে ৩০০-৫০০ ক্যালোরি বেশি খাদ্য গ্রহণ করতে বলেন। শুধু তাই নয় দিনে তিন বারের পরিবর্তে ছয় বার অর্থাৎ ঘন ঘন অল্প খাবারে গর্ভাবস্থায় মায়ের স্বাস্থ্য ভাল থাকে ও শিশুর সঠিক বৃদ্ধি ঘটে। স্বাভাবিক ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ স্বাস্থ্যবান মানব জীবন-যাপনের পূর্বশর্ত। ধর্মীয় ব্যাখ্যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আলেমগণ গর্ভবতী মায়ের রোজা রাখা না রাখা বিষয়ে কোরান হাদিসের আলোকে মতামত প্রদান করেছেন। গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মা যারা তাদের সন্তানদের স্বাস্থ্য নিয়ে শঙ্কিত হতে পারেন বা যেখানে শিশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে এমন মায়েদের জন্য রোজা রাখা বাধ্যতামূলক নয় বলে বেশিরভাগ আলেম মতামত দিয়েছেন। পরবর্তীতে সমান সংখ্যক রোজা রেখে, সমসংখ্যক দিন একজন গরিবকে অন্নদান করে বা অন্য আমলের মাধ্যমে তা পূরণ করতে বলা হয়েছে। আমাদের দেশের বিজ্ঞ আলেমগণ সম্মিলিত মতামত প্রদান করে গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের মনের বিভ্রান্তি ও শঙ্কা দূর করতে পারেন। চিকিৎসক হিসেবে আমরাও বৈজ্ঞানিক তথ্যের পাশাপাশি ধর্মীয় নীতিমালা সম্পর্কে মাদেরকে জানাতে পারি। ডা. রেজাউল করিম কাজল সহযোগী অধ্যাপক, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ফোন: ০১৯৭৯০০০০১১
×