ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

চালতা ফুল

বর্ষার রিমঝিম সুরে ছন্দ প্রকৃতির সৌন্দর্য চিরহরিৎ বৃক্ষ

প্রকাশিত: ০৬:১২, ১৩ জুন ২০১৭

বর্ষার রিমঝিম সুরে ছন্দ প্রকৃতির সৌন্দর্য চিরহরিৎ বৃক্ষ

সমুদ্র হক ॥ চিরসবুজ বৃক্ষের চালতা ফুল কি বর্ষাকে ডেকে এনেছে। না বর্ষা চালতাকে ডেকে এনেছে! দু’টোর উত্তর এবার এক। শুধু নীপবনের ফুল সময়ের আগেই চলে এসেছে। তা আসুক। চালতা ফুলের আগমনে বর্ষার নূপুর নিক্কনের রিমঝিম সুরে রোমান্টিক হৃদয়েও সুর উঠেছে ‘ওগো বরষা তুমি ঝরো না গো অমন জোরে/পাছে সে আসবে তবে কেমন করে/এলে না হয় ঝরো তখন অঝর ধারে/যাতে সে যেতে চেয়েও যেতে নাহি পারে...’। এমনই সুরে ছন্দ এনেছে চালতা ফুল। বরষার ফুল কদম যেমন আদরের, চালতা তা নয়। চালতা অনাদরের ফুল। আদরনীয় না হয়েও সুন্দর বৃক্ষ প্রকৃতির সৌন্দর্যকে ভরিয়ে রাখে। চালতার নাম কোথাও চালিতা কোথাও চাইলতে। ইংরেজী নামটি বেশ মজার ‘এলিফ্যান্ট এ্যাপেল’। বাংলা করলে দাঁড়ায় হাতি আপেল। আপেলের মতো দেখতে নয় মিষ্টিও নয়। স্বাদ টক। তারপরও কেন যে ইংরেজীতে এই নাম হলো এমন প্রশ্নের উত্তর মেলে না। আবার অসমীয় ভাষায় চালতার নাম ‘ঔটেঙ্গা’। বিজ্ঞান নাম ‘ডেলিনিয়া ইন্ডিকা’। চালতার ফুল ও ফল বাংলাদেশের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। চালতার ফুল ফোটে বর্ষায়। আর ফল পাকে বর্ষার পর শরত হেমন্তে। যা শীত পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। এই সময়টায় গ্রামের পথের ধারে, কোন গৃহস্থ বাড়ি, কৃষক বাড়ির উঠানে বর্ষার ফুল চালতা ফুটেছে। চালতার বড় আকারের সাদা ফুল দেখতে সুন্দর। সাদার মধ্যে সোনালি আভা ফুলকে অপার সুন্দর করেছে। সুগন্ধে সুরভি ছড়ায়। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে চালতার গাছ বেশি। ভারতের বিহার রাজ্য এবং পূর্ব ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার এবং চীনের কোন কোন অঞ্চলে চালতার ফুল ফুটে ফল ধরে। সবুজ রঙের চালতার গাছ মাঝারি আকারের। উচ্চতা ১৫ থেকে ১৭ মিটার। বেশ লম্বা। গায়ে লালচে রঙের চকচকে বাকল। শাখা প্রশাখার মধ্যে পাতাগুলো সবুজ, ঘন ও সন্নিবদ্ধ। পাতার চারধারে করাতের মতো খাঁজকাটা। ১৫ থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার। বছরে একবার চালতা বৃক্ষে ফুল ফোটে। এজন্য এই বৃক্ষকে কুসুম গর্ভ বলা হয়। গাছ থেকে পাকা ফল না পারলে আপনা আপনি বীজ মাটিতে পড়ে। অনুকূল পরিবেশে এই বীজ হতেই গাছ জন্মায়। চালতা তলায় অনেক সময় ছোট ছোট চারা দেখা যায়। এই চারা তুলে কোথাও রোপণ করলেও গাছ জন্মায়। চালতার ফল ধরতে সময় নেয় ৫ থেকে ৭ বছর। ফুল থেকে চালতা ফলের জন্মানোর প্রক্রিয়াটিও বেশ অদ্ভুত। প্রথমে ফুলের পাপড়িগুলো সবুজ হয়। বেড়ে গিয়ে ফলের আকার ধারণ করে। চালতার যে অংশটি খাওয়া হয় তা আসলে ফুলের বৃতি। ফল থাকে বৃতির আড়ালে। দেখতে অনেকটা পেয়ারার মতো। সবুজ বর্ণের ফলে আছে কয়েকটি ভাঁজ। চালতার কদর খুব বেশি না হওয়ায় সহজেই মেলে। দামও কম। ভাঁজ ও খোসা ছোট ফালি করে কেটে ছোট মাছ দিয়ে চর্চরি রান্না করলে স্বাদের হয়। চালতার টক রান্নার পর সুস্বাদে পরিণত করে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ অন্যান্য স্থানে চালতা দিয়ে চিংড়ি মাছ রান্না করা হয়। যা চালতার খাট্টা নামে অধিক পরিচিত। চালতা টক হওয়ায় এর মধ্যে পুষ্টি গুণাগুণ বেশি। চাটনি ও আচারের জন্য চালতা খ্যাতি অর্জন করেছে। চালতার আচার মুখরোচক এবং রুচি বাড়ায়। অম্বল ও হৃদরোগ প্রতিরোধ করে। চালতা শারীরিক দুর্বলতা কমিয়ে দেয়। কচি চালতার রসের মধ্যে সামান্য চিনি অথবা গুড় মিশিয়ে শরবত বানিয়ে পান করলে জ্বর ও কাশি দূর করে। এত কিছুর জন্যই বুঝি চালতার ফল টক হওয়ার পরও বৃক্ষের নাম হয়েছে এভারগ্রিন। যারা বয়সকে লুকিয়ে নিজের সৌন্দর্য অনেকটা সময় ধরে রাখতে চায় তাদের জন্য চালতা অন্যতম পথ্য। তখন চালতা বৃক্ষের চিরহরিৎ (চিরসবুজ) বা এভারগ্রিন নামটি নিজেও ধারণ করতে পারেন। চালতা ফুলের সৌন্দর্যে নিজেও বিকশিত হবেন। বর্ষাকে কাব্যময় করে তুলেছে এই চালতা।
×