ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নিরাময় অযোগ্য ৬ লাখ রোগীর জন্য নেই প্যালিয়েটিভ কেয়ার

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১১ জুন ২০১৭

নিরাময় অযোগ্য ৬ লাখ রোগীর জন্য নেই প্যালিয়েটিভ কেয়ার

নিখিল মানখিন ॥ দেশে পূর্ণাঙ্গ প্যালিয়েটিভ কেয়ার সেন্টার নেই। পাইলট প্রকল্প হিসেবে সীমিত পরিসরে দেশের একমাত্র প্যালিয়েটিভ কেয়ার সেন্টার চালু রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্যালিয়েটিভ কেয়ার সেন্টারে পৃথিবীতে প্রতিবছর পাঁচ কোটি মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে সাড়ে তিন কোটি মানুষের মৃত্যুপূর্ব ব্যথামুক্তি এবং অন্যান্য চিকিৎসা সেবার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশেও এমন রোগীর সংখ্যা অনেক। ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল ও অনিরাময়যোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুশয্যায় থাকে দেশের প্রায় ছয় লাখ মানুষ। তাদের ব্যথার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি বা প্যালিয়েটিভ কেয়ার দেয়া সম্ভব। ২০০৭ সালে শুধু ক্যান্সারে পৃথিবীতে মারা গেছে ৭০ লাখ মানুষ। এদের মধ্যে প্রায় ৭০ ভাগ মানুষকে মৃত্যুপূর্ব একটা দীর্ঘ সময় ভুগতে হয়েছে অমানুষিক শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণায়। মৃত্যু তাদের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছে। অথচ অতি অল্প প্রশিক্ষণেই সেবা ও সহযোগিতা দিয়ে এ ধরনের রোগীর ব্যথাহীন মৃত্যু নিশ্চিত করা সম্ভব। একজন রোগীর মৃত্যুপূর্ব যন্ত্রণা প্রশমিত কাজে সবার এগিয়ে আসা উচিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্যালিয়েটিভ কেয়ার হ্রাস করতে পারে নিরাময়-অযোগ্য রোগে আক্রান্ত অন্তিমশয্যার রোগীদের শারীরিক বেদনা। যোগাতে পারে মানসিক সমর্থন, স্বস্তি ও বাস্তবতা মেনে নেয়ার শক্তি, আধ্যাত্মিক শান্তি। আর সেই সঙ্গে রোগীর পরিবারের জন্যও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। এটি তাদের জীবনে নতুন দিন আনে না; কিন্তু তাদের প্রতিটি দিনে যোগ করে নতুন জীবন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খান বলেন, প্যালিয়েটিভ কেয়ার স্বাস্থ্যসেবা এমন একটি ক্ষেত্র, যার প্রয়োজনীয়তা বর্তমানে প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এটি এমন একটি উদ্যোগ যা জীবন সংশয়ী রোগে আক্রান্ত রোগী এবং তাদের স্বজনদের জীবনের মানোন্নয়ন করে। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্তকরণ এবং দক্ষ নির্ণয়ের মাধ্যমে ব্যথা ও অন্যান্য উপসর্গের চিকিৎসা এবং শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আত্মিক সমস্যা সমাধান দিয়ে থাকে। উপাচার্য আরও বলেন, প্যালিয়েটিভ কেয়ার রোগীর ব্যথা নিরাময়, উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ, মানসিক ও সামাজিক সহায়তা প্রদানে জোর দিয়ে থাকে। এটি বিভিন্ন ধরনের রোগের শেষ পর্যায়ে যেমন হৃৎপি-, ফুসফুস, বৃক্ক এবং যকৃৎ ও ক্যান্সার রোগীদের কষ্ট হতে মুক্তি প্রদানে মূল ভূমিকা পালন করে থাকে। প্যালিয়েটিভ সেবার প্রয়োজনীয়তা ও করণীয় বিষয় তুলে ধরে সেন্টার ফর প্যালিয়েটিভ কেয়ার প্রকল্পের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডাঃ নিজাম উদ্দীন আহমেদ বলেন, প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর মাধ্যমে হাতেকলমে শেখানো হবে প্রান্তিক রোগীদের ব্যথা ও অন্যান্য উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ, উপযুক্ত কথোপকথন এবং সার্বিক সেবার বিভিন্ন বিষয়। সেবাদান কর্মীরা নিরাময় অযোগ্য রোগীদের যে গভীর কষ্ট এবং দুর্দশা পর্যবেক্ষণ করেন, তার যথাযথ যতœ নেয়া প্রয়োজন। আশা করি, তাদের দক্ষতা শুধু ব্যথা কমানো নয়, বরং এর গভীরে কী হচ্ছে, তা কিভাবে বর্ণনা করতে হবে এবং রোগী ও তার পরিবারকে কিভাবে আশা যোগাতে হবে সে ক্ষেত্রেও দক্ষতা বাড়ানো দরকার। তিনি আরও বলেন, আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থায় চরম আরোগ্য-নির্ভরতার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে নতুন আশার সম্ভাবনা নিয়েই এগিয়ে এসেছে ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’ অথবা ‘প্রশমন সেবা’র দর্শন। যখন কোন রোগীর রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব নয় তখন তার রোগ সংক্রান্ত উপসর্গগুলো নিরাময় বা সুরাহা করাকে প্যালিয়েটিভ কেয়ার বলে। সমাজসেবা ও চিকিৎসাব্যবস্থার একটি যথাযথ সম্মিলনে কতিপয় উন্নয়নশীল দেশে যে ‘কমিউনিটি প্যালিয়েটিভ কেয়ারের ধারণা গড়ে উঠেছে, তা বাংলাদেশেও বহু পরিবারকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের প্রয়োজন হয় সেসব রোগীর যাদের দীর্ঘমেয়াদী স্নায়ুরোগ। যেমন স্ট্রোক, প্যারালাইসিস। অথবা যারা এইডস বা ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত যা সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব নয়। কিন্তু এসব রোগের উপসর্গগুলোর অন্যতম হচ্ছে তীব্র ব্যথা, যা অনেক কষ্টকর। এসব রোগী যেহেতু জানতে পারে ধীরে ধীরে তিনি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, তাই তার মানসিক কষ্টও কম নয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে রোগীরা শারীরিকভাবে পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এসব ক্ষেত্রে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের প্রয়োজন। অধ্যাপক ডাঃ নিজাম উদ্দীন বলেন, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কষ্ট লাঘব করে চিকিৎসাসেবা এবং সহানুভূতি ও মমতার সমন্বয়ে রোগীকে পরিচর্যা করাই প্যালিয়েটিভ কেয়ারের লক্ষ্য। প্যালিয়েটিভ কেয়ার বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবা খাতে তুলনামূলক নতুন একটি ধারণা। ‘ভাল হবার নয়’ এমন রোগী ও তার পরিবারকে চিকিৎসা সেবা ও সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার আওতায় নিয়ে আসাই প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা প্রশমন চিকিৎসা সেবা কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য। এর মাধ্যমে যেসব রোগের কোন চিকিৎসা নেই মৃত্যু অবধারিত সেসব রোগীকেও মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সেবাযতœ করা তথা রোগীর একটি ব্যথামুক্ত মৃত্যু নিশ্চিত করা। প্যালিয়েটিভ কেয়ারের ধারণামতে ‘কিছু করার নেই’ একটি ভুল, পলায়নপর মনোবৃত্তির বাক্য। একজন মানুষের মানবিক দায়িত্ব হিসেবে কিছু না কিছু নিশ্চয়ই করার আছে। এই রোগীদের বেঁচে থাকার শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত চিকিৎসাসেবা বা সমাজসেবা ব্যবস্থায় পরিচর্যা করতে হবে। ওদের কষ্ট, সমস্যা লাঘবে সচেষ্ট থাকতে হবে। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল ভার্সিটিতে সেন্টার ফর প্যালিয়েটিভ কেয়ার ২০১১ সালে যাত্রা শুরুর দিন থেকেই নিয়মিতভাবে নিরাময় অযোগ্য রোগীর চিকিৎসা এবং সেবা প্রদান করে আসছে। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই সেবা ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিয়ে সব সদস্য রাষ্ট্রকে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে এটি অন্তর্ভুক্তকরণের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূল ধারায় সম্পৃক্তির পরামর্শ দিয়েছে।
×