ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এবার সামনে আনলেন আত্রাই ইস্যু

তিস্তা চুক্তি এড়াতে মমতার নানা কৌশল

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৭ মে ২০১৭

তিস্তা চুক্তি এড়াতে মমতার নানা কৌশল

তৌহিদুর রহমান ॥ তিস্তা চুক্তি এড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে নানা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিস্তা ইস্যু নিয়ে একের পর এক অযৌক্তিক বিষয়ের অবতারণা করছেন তিনি। বিশেষ করে তিস্তা ইস্যুতে ঢাকা-দিল্লীকে উল্টো চাপে রাখার কৌশল হিসেবে নতুন করে আত্রাই ইস্যু সামনে এনেছেন তিনি। এদিকে তিস্তা ইস্যুতে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এখন রাজনৈতিকভাবে চাপে রেখেছে মমতাকে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার ওপর দিয়ে বয়ে চলা আত্রাই নদীর ওপর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বাঁধ দেয়ার ফলে ভারতের অংশের পানি আটকে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। গত বুধবার এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যসচিব ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা প্রশাসককে একটি প্রতিবেদন তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন মমতা। সেই প্রতিবেদন তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পেশ করবেন। মমতার অভিযোগ, বালুরঘাটে আত্রাই নদীতে সমস্যা হচ্ছে। ওখানে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে দেয়া হচ্ছে। আমি বাংলাদেশের সরকারকে অনুরোধ করব, আত্রাই নদীর পানিকে বাঁধ দিয়ে আটকানো হচ্ছেÑওটা ছেড়ে দিন। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়ে মমতা জানান, আত্রাই নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে এখানকার পানি কিন্তু আটকে দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আমার পুরো রিপোর্ট চাই। এই বিষয়টি আমার কেন্দ্রীয় সরকারকে লিখতে হবে। কারণ, এই আত্রাইসহ অনেক নদী আছে যা এই দক্ষিণ দিনাজপুরের প্রাণকেন্দ্র। এই প্রাণভোমরাকে মেরে দেয়া চলবে না। সূত্র জানায়, দিনাজপুর জেলা দিয়ে ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার কুমারগঞ্জ ব্লকের সাফানগর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে আত্রাই নদী। এরপর ওই নদী দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট ব্লক দিয়ে ৫২ কিলোমিটার পথ শেষ করে ডাঙ্গিজলঘর হয়ে বাংলাদেশে নওগাঁ জেলায় ঢুকেছে। তবে আত্রাই নদীর রাবার ড্যাম নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর। আর এর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০১৪ সালের শেষদিকে। প্রায় তিন বছর আগে আত্রাই নদীর ওপর রাবার ড্যাম নির্মাণ কাজ শেষ হলেও এ নিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে কখনই কোন অভিযোগ ওঠেনি। এখন নতুন করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যয়ের এই অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৭-১০ এপ্রিল ভারত সফর করেন। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে মমতা তোর্সা, মানসাই, ধানসাই ও ধরলা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে এসব নদীর কোনটিই তিস্তার বিকল্প হতে পারে না বলে ঢাকার পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই দিল্লীকে জানানো হয়েছে। কেননা তিস্তা নদী লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ৩১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই নদীর মধ্যে শুধু বাংলাদেশ অংশেই পড়েছে ১১৫ কিলোমিটার। এছাড়া তোর্সা, মানসাই, ধানসাই, ধরলা নদীর কোনটিতেই ব্যারাজ নেই। সে কারণে এসব নদীর পানি বাংলাদেশ এমনিতেই পাচ্ছে। তবে তিস্তার ভারত অংশে গজলডোবায় বাঁধ থাকায় তিস্তার পানি পশ্চিমবঙ্গ সরকার সুবিধামতো ব্যবহার করছে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। তিস্তার ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যাও অনেক বেশি। সে কারণে তিস্তা এসব নদীর কোন বিকল্প হতে পারে না বলে ঢাকার পক্ষ থেকে দিল্লীকে ইতোমধ্যেই জানানো হয়েছে। তোর্সাসহ চার নদীর পানিবণ্টন নিয়ে যৌথ সমীক্ষা করার নির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছেন মমতা। তবে এসব নদীর পানি নিয়ে যৌথ সমীক্ষার প্রস্তাব মানে সময়ক্ষেপণ করা ছাড়া আর কিছু নয় বলে মনে করছেন ঢাকার শীর্ষ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা। এছাড়া এসব নদীর পানি নিয়ে সমীক্ষার কিছু নেই। কেননা, এসব নদীতে ব্যারাজ না থাকায় বাংলাদেশ এমনিতেই স্বাভাবিকভাবে এসব নদীর পানি পাচ্ছে। তিস্তা চুক্তিতে মোদি সরকারের কোন আপত্তি নেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তিস্তা চুক্তি করতে আগ্রহী। তিনি শুরু থেকেই এটা বলে আসছেন। তিনি মমতাকে পাশে নিয়েই এই চুক্তি করতে চান। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফরকালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যয়ের বিকল্প প্রস্তাবে বিব্রত হয়েছিল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। আর কেন্দ্রীয় সরকার মমতার বিকল্প প্রস্তাব মানতেও নারাজ। সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের পর থেকেই তিস্তা ইস্যুতে মমতার ওপর ঢাকা-দিল্লীর চাপ বেড়েছে। তবে তিস্তা ইস্যু এড়াতে উল্টো বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন মমতা। তিনি একের পর এক অযৌক্তিক উদাহরণ টেনে আনছেন। বিশেষ করে তোর্সাসহ চার নদীর বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তারপর সর্বশেষ আত্রাই নদীর বাঁধকে ইস্যু হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফরের পর তিস্তা ইস্যুতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে চাপে রেখেছে বিজেপি। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ধীরে ধীরে সরব হচ্ছেন বিজেপি নেতারা। তিস্তা নিয়ে মমতার ওপর নাখোশও বিজেপির শীর্ষ নেতারা। তিস্তা ইস্যুতে গত বৃহস্পতিবার ত্রিপুরার রাজ্যপাল তথাগত রায় বলেছেন, নিম্ন অববাহিকা হিসেবে বাংলাদেশের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। আমরা কোনভাবেই এটা এড়াতে পারি না। বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা ও অন্য নদীর পানি বণ্টনের বিষয়টি সমাধান করতে মোদিজী প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আজ হোক, কাল হোক- এটা ঘটবেই। তিস্তা নিয়ে ‘অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যা’ থাকলেও শীঘ্র তার সমাধান হবে বলে জোর দিয়ে বলেন তথাগত রায়। বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ শাখার সাবেক এই সভাপতি আরও বলেছেন, সন্ত্রাসবাদের মদদদাতা ও ভারতীয় সেনাদের ঘাতক পাকিস্তানের সঙ্গে যদি সিন্ধু নদের পানি নিয়ে চুক্তি করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের মতো দীর্ঘদিনের বন্ধুসুলভ প্রতিবেশীর সঙ্গে চুক্তিতে রাজি না হওয়ার কোন যৌক্তিক কারণ নেই। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সাবেক সভাপতি রাহুল সিনহাও মমতাকে ইঙ্গিত করে তিস্তা ইস্যুতে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন আশ্বাস দিয়েছেন তিস্তা চুক্তি হবে, আমরা সেই আশ্বাস এবং বিশ্বাস রেখেই চলব। এখানে কেউ বাধা হতে পারবে না। উল্লেখ্য, ১৯৮০’র দশক থেকে দুই দেশ তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা করে আসছে। পশ্চিমবঙ্গসহ সব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই ২০১১ সালে চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। সে কারণে ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হওয়ারও কথা ছিল। তবে শেষ মুহূর্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে তা আটকে যায়। এরপর বিভিন্ন সময় ভারত সরকার এই চুক্তি সইয়ের বিষয়ে আশ্বাস দিলেও সমস্যার সমাধান হয়নি।
×