ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মালিকের মুনাফা বাড়লেও ভাগ্য ফেরেনা চা শ্রমিকের

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ২৩ এপ্রিল ২০১৭

মালিকের মুনাফা বাড়লেও ভাগ্য ফেরেনা চা শ্রমিকের

শংকর পাল চৌধুরী, মাধবপুর, হবিগঞ্জ থেকে ॥ চায়ের রাজধানী হিসেবে খ্যাত সিলেট। শুধু সিলেট বিভাগেই রয়েছে ১৫৮টি চা বাগান। এসব বাগানে শ্রমিকের সংখ্যা ১ লাখ ২২ হাজার। আর চায়ের ওপর নির্ভরশীল মোট জনসংখ্যা ৬ লাখ। এখনও শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বাগান মালিকরা তাদের শ্রম ও ঘামে উৎপাদিত চায়ে কোটি কোটি টাকা আয় করলেও শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে কোন উদ্যোগ নিচ্ছেন না। নেই তাদের ভূমির মালিকানা। পাচ্ছেন না প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসেবা। প্রতিনিয়ত তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। সময়ের বিবর্তনে সবক্ষেত্রে পরিবর্তন এলেও চা শ্রমিকদের জীবনে লাগেনি কোন পরিবর্তনের ছোঁয়া। এমনকি ন্যায্য মজুরি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন চা শ্রমিকরা। জানা গেছে, ১৮৩৬ সালে এদেশে ব্রিটিশদের আগমণের পর পরই চীনে উদ্ভাবিত চা প্রথমে সিলেটের মালনীছড়া ও চট্টগ্রামের হায়দ্রাবাদ বাগানে চাষের উদ্যোগ নেয়া হয়। এক পর্যায়ে চা চাষ ও পরিচর্যার জন্য ভারতের অসম, উড়িষ্যা, ঝাড়খ-, উত্তরপ্রদেশ থেকে চা শ্রমিক হিসেবে নিয়ে আসা হয় চা জনগোষ্ঠীকে। তখন মজুরি ছিল ৬ আনা । সকাল ৮টা হতে ৫টা পর্যন্ত রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে চা শ্রমিকরা কঠোর পরিশ্রম করে। সেই তখন থেকে সিলেটে তথা বাংলাদেশে তাদের বসবাস। প্রায় পৌনে দু’শ’ বছর ধরে এদেশের মাটি আঁকড়ে বাস করলেও একখ- ভূমির মালিক হতে পারেননি তারা। এমনকি মৃত্যুর পর যে শ্মশানে তাদের ঠাঁই হয়, সেটিরও মালিকানা থাকে অন্যের হাতে। সিলেটের ১৫৮টি চা বাগানে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ শ্রমিকের বসবাস। বংশপরম্পরায় বিশাল এ শ্রমিক জনগোষ্ঠী চা বাগানের জায়গায় বাস করছেন। অনাবাদি জমি নিজের শ্রম-ঘাম দিয়ে আবাদ করে মূল্যবান চা উৎপাদন করে যাচ্ছেন তারা। ভূমির মালিকানা দাবি করলে বা ব্যক্তি উদ্যোগে মালিকানা গ্রহণের চেষ্টা করলে তাদের ওপর নেমে আসে চা বাগান মালিক বা সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শাস্তির খ—গ। এ কারণে যুগ যুগ ধরে ভূমিহীন থেকে যাচ্ছে বিশাল এ জনগোষ্ঠী। জমির মালিকানা না থাকায় নিজেরাও স্বাবলম্বী হতে পারছে না। এ কারণে কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণও দেয়া হয় না তাদের। ফলে চা শ্রমিকদের জীবনে কোন পরিবর্তন আসেনি দীর্ঘদিনেও। জানা গেছে, বর্তমানে প্রতিদিন হাজিরা ৮৫ টাকা, সঙ্গে রেশন সপ্তাহে মাত্র সাড়ে তিন কেজি চাল/আটা। প্রতিদিন একজন শ্রমিককে কাঁচাপাতা তুলতে হয় ২৪ কেজি। এই উত্তোলনকৃত কাঁচা চা পাতা দিয়ে বিক্রিযোগ্য চা পাতা হয় ৬ কেজি, যার ন্যূনতম বাজারমূল্য ১৫০০টাকা। ২০০৭ সালে একজন চা শ্রমিকের মজুরি ছিল ৩২ টাকা ৫০ পয়সা। ২০০৯ সালে হয় ৪৮ টাকা। ২০১৩ সালে বাড়ানো হয় ৬৯ টাকা আর এখন ৮৫ টাকা। কিন্তু শ্রমিকদের দাবি, প্রতিদিন ৩০০ টাকা। বর্তমানে উৎসব ভাতা বেড়েছে। বৃদ্ধ চা শ্রমিকদের সমাজসেবা মন্ত্রণালয় থেকে বছরে মাত্র ৫ হাজার টাকার খাদ্যসামগ্রী দেয়া হচ্ছে। চা শ্রমিকরা অনেক আন্দোলন করে এসব আদায় করেছেন। দেড়শ’ থেকে দুইশ’ বছর ধরে শ্রমিকরা বংশপরম্পরায় নিজেদের জমি মনে করেই বাগানে বসবাস করছেন। চা বাগানে বসবাস করলেও তারা যেন নিজ ভূমিতে পরবাসী। বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান চা শ্রমিকদের ভোটাধিকার দিয়ে দেশের স্বাধীন নাগরিক করলেও ভূমি অধিকারের ক্ষেত্রে তারা এখনও স্বাধীন নয়। অথচ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এই চা শিল্পীরা। এখনও চা বাগানের অধিবাসীরা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোন পাকা ইমারত/বাড়ি নির্মাণ করতে পারে না। বাগান এলাকায় কোন সরকারী স্থাপনা যেমন হাসপাতাল,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নির্মাণ করতে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। চা বাগানে দিন দিন চা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়লেও তাদের কর্মসংস্থানের পরিধি সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। যে কারণে হাজার হাজার নর-নারী কর্মহীন হয়ে দিন কাটাচ্ছে। যেসব শ্রমিক চা বাগানে কাজে রয়েছে শুধু টাকা ও রেশন তারাই পেয়ে থাকেন। এ টাকা ও রেশন দিয়ে পুরো পরিবার চালানো তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। ১৮৭ বছর আগে অবিভক্ত ভারত থেকে আসা বিভিন্ন ভাষা-গোষ্ঠীর মানুষ শত প্রতিকূলতার মধ্যে আচার-অনুষ্ঠান পালন করে আসছে। একেক গোষ্ঠীর বিয়ে, মৃত্যুর আচার-আচরণ একেক রকমের । এদেশের অন্যান্য নারীর তুলনায় চা বাগানের নারী চা শ্রমিকের জীবনধারা ও কাজের ধরন সম্পূর্ণ ভিন্ন। চৌকিদারের ডাকে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সাংসারিক সব কাজকর্ম সেরে সকাল ৮টার মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হয়। স্থানভেদে ১/২ কিঃমিঃ হেঁটে তার পর কর্মস্থলে পৌঁছতে হয়। সাধারণত চা পাতা তোলা, নার্সারি করা, গাছ ছাঁটাই করা নারী শ্রমিকরা করে থাকেন। যা খুবই কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ। দুপুর ২টার সময় আধ ঘণ্টা সময় পান খাবারের জন্য বাড়ি থেকে আনা শুকনো রুটি, মরিচ, লাল চা, পিঁয়াজ, আলু ও কচি চা পাতা মিশিয়ে বিশেষ এক ধরনের চাটনি তৈরি করে খাবার সেরে ফেলেন। সব নারী শ্রমিক দলবেঁধে একত্রিত হয়ে এগুলো দিয়ে কোন রকম পেটের ক্ষুধা নিবারণ করেন। স্বাস্থ্য ও পুষ্টিজ্ঞান সম্পর্কে তাদের জ্ঞান নেই। সামাজিক অবস্থার সঙ্গে যুদ্ধ করে তারা বেঁচে আছেন। বিশুদ্ধ পানির অভাবে চা শ্রমিকরা অনেক কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। ৫০ বছরের কোন শ্রমিককে ৮০ বছরের বেশি মনে হয়। প্রতিবছর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অনেক শ্রমিক মারা যায়। সরকারী কোন হাসপাতাল না থাকায় চা শ্রমিকরা স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। বাগান পরিচালিত নামমাত্র স্বাস্থ্যসেবা থাকলেও এর সেবার পরিসর খুবই সীমিত। চা শ্রমিকরা বসবাস করে খুবই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। বাগানের দেয়া কুঁড়েঘরে তারা একত্রে বসবাস করে। প্রতিবছর শ্রমিকদের গৃহনির্মাণের জন্য চুক্তিপত্র থাকলেও মালিক পক্ষ তাদের দাবির প্রতি উদাসীন। চা বাগান এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুবই কম থাকায় চা শ্রমিক সন্তানরা অনেকেই শিক্ষার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিকরণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ফলে ভূমির ওপর প্রজারা মালিকানা ফিরে পেলেও সেই আইনে চা বাগান এলাকার শ্রমিকরা এ আইনের আওতামুক্ত ছিল। এ কারণে সরকার চান্দপুর চা বাগানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেজা) ঘোষণা করে, চা বাগানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিলে ২০১৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর শ্রমিকরা আন্দোলনে গর্জে ওঠে। ‘আমার মাটি আমার মা কেড়ে নিতে দেব না’। এতে বহু জাতীয় নেতা অংশগ্রহণ করেছিলেন। লস্করপুর ভ্যালি সভাপতি ও ভূমি রক্ষা কমিটির আহবায়ক অভিরত বাক্তি জানায়, আমাদের পূর্বপুরুষরা পাহাড় কেটে আবাদ করে চা বাগানের জন্য উপযুক্ত করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের ভোটাধিকার দিয়েছেন; তখন থেকে আমরা নৌকা মার্র্কায় ভোট দিয়ে আসছি। এখন ক্ষমতায় বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের মা-বাপ তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের দাবিÑ বাংলাদেশে চা বাগানের জন্য বরাদ্দকৃত জমির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ১১ হাজার ৬৬৩.৮৩ হেক্টর। চা চাষের জন্য ব্যবহৃত প্রায় ৪৮ হাজার ৬০ হেক্টর অবশিষ্ট জমিতে শ্রমিকরা বসবাস করে এবং বেশিরভাগ জমি অব্যবহৃত আছে। আমরা যে সামান্যটুকু জমিতে বসবাস করে আসছি সেটুকু জমি আমাদের নামে বরাদ্দ দিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিনীত অনুরোধ জ্ঞাপন করছি। বঙ্গবন্ধুর ক্ষুধামুক্ত সোনার বাংলা ও ডিজিটাল বাংলাদেশের অংশীদার করতে চা শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বিনীত অনুরোধ জানান।
×