ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভুটানের প্রধানমন্ত্রী তোবগের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শীর্ষ বৈঠক;###;পাঁচ চুক্তি ও এমওইউ সই;###;রাজা ও রানীর জমকালো অভ্যর্থনা;###;বিমানবন্দরে লালগালিচা সংবর্ধনা

থিম্পু-ঢাকা সহযোগিতার নতুন দুয়ার খুলল

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৯ এপ্রিল ২০১৭

থিম্পু-ঢাকা সহযোগিতার নতুন দুয়ার খুলল

বিডিনিউজ ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরে যোগাযোগের সুবিধা কাজে লাগিয়ে ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক সম্প্রসারণে চুক্তি হয়েছে বাংলাদেশের। সহযোগিতার নতুন পথ খুঁজতে মঙ্গলবার থিম্পুতে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। শীর্ষ বৈঠকের পর দ্বৈত কর প্রত্যাহার, বাংলাদেশের নৌপথ ভুটানকে ব্যবহার করতে দেয়া, কৃষি, সংস্কৃতি ও পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পাঁচটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে সই করেছে প্রতিবেশী দুই দেশ। সকালে শেখ হাসিনা ভুটান পৌঁছলে পারো বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে। এ সময় তাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয়। এর পর জাঁকজমকপূর্ণ শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে রাজধানী থিম্পুতে নিয়ে যাওয়া হয়। দুপুরের পর শেখ হাসিনাকে ভুটানের রাজকীয় প্রাসাদে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নেয়া হয়। সেখানে ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ও রানী জেটসান পেমার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন তিনি। এর পর দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠকে নেতৃত্ব দেন। থিম্পুর গ্যালয়ং শংখানে অনুষ্ঠিত শীর্ষ বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মোঃ শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, আলোচনার মধ্যে যেগুলো প্রমিনেন্টলি এসেছে সেগুলো হলো দুদেশের কানেকটিভিকে ধরে ব্যবসা ও বাণিজ্য বৃদ্ধি। দুই দেশের মধ্যে সই হওয়া চুক্তি ও সমঝোতার বিষয়ে শহীদুল হক বলেন, এই এমওইউ সইয়ের ফলে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সুবিধা হলো। বিশেষ করে দ্বৈত করের ক্ষেত্রে। এতে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম এ সময় উপস্থিত ছিলেন। একাত্তরে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদাতা দেশ হিসেবে ভুটানের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের কথা বলেন পররাষ্ট্র সচিব। সেই সম্পর্ককে ধরে রাখার জন্য ভুটানের রাজা বাংলাদেশকে একটা জমি দিচ্ছেন যেখানে বাংলাদেশের দূতাবাস গড়ে তোলা হবে। সে বিষয়ে বুধবার একটি সমঝোতা স্মারক সই হবে বলে শহীদুল হক জানান। ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী ভুটানের সমর্থনও চেয়েছেন। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ওদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, হাইড্রো বিদ্যুতের যে সম্ভাবনা আছে, সেটা একটা গেম চেঞ্জার হতে পারে এই অঞ্চলে। ভুটানে তিন দেশের সহযোগিতায় বিদ্যুত উৎপাদন হবে এবং এটা রিজিওনালি ট্রান্সমিট করবে। তিনি জানান, ভুটানের সরকার একটা ‘হেলথ ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠন করেছে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নের জন্য। এই তহবিলে সহযোগিতা চেয়েছেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী। সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আরও একটা জিনিস অনেকদিন ধরে আলোচনায় ছিল যে, বাংলাদেশী ডাক্তারদের এখানে সরকারীভাবে চাকরির ব্যাপারটা। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে উপস্থিত শহীদুল হক ভুটানের প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে বলেন, বিদেশী ডাক্তারদের এখানে চাকরি করলে মাসে তিন হাজার ডলার পর্যন্ত বেতন হবে। বাংলাদেশী ডাক্তাররা উৎসাহী হলে তাদের চাকরির সম্ভাবনা এখানে আছে। একই সঙ্গে বর্তমানে ১২৩ ভুটানী ছাত্র বাংলাদেশে পড়ছে। এদের মধ্যে ডাক্তারিতেই বেশি। ওই খাতে আরও সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য দুই প্রধানমন্ত্রীই এ ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছেন। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল নিয়ে বিবিআইএন নামে যে উপ-আঞ্চলিক জোট গঠনের কাজ চলছে তা নিয়েও দুই প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করেছেন বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিবিআইএন এই এলাকার কানেকটিভির একটা প্রধান করিডর। এর বাস্তবায়নে ভুটানকে তিনি তাগাদা দিয়েছেন। শহীদুল হক বলেন, কুয়াকাটা ও কক্সবাজারের সঙ্গে ভুটানকে নিয়ে একটি ‘টুরিজম করিডর’ কীভাবে তৈরি করা যায় তা খুঁজে দেখতে একটি প্রতিনিধিদল পাঠাবে দেশটির প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ভারতের মধ্য দিয়ে ফাইবার অপটিকসের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার একটা প্রস্তাব ভুটানের প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই অঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনা-এটা সবাই মিলে যৌথভাবে করতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল মিলে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে। তারা বলেছেন, বিমসটেকের একটা বড় সম্ভাবনা আছে। তারা ভাবে যে এই বিমসটেককে কাঠামো করেই এই এলাকার উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা দানা বাঁধতে পারে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর এবং সৈয়দপুর বিমানবন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব দেন ভুটানকে। দুই দেশের মধ্যে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর দেয়া নৈশভোজে অংশ নেন শেখ হাসিনা। তিন দিনের সফরের দ্বিতীয় দিন বুধবার সকালে শেখ হাসিনা রাজকীয় আপ্যায়ন হলে সম্মানিত অতিথি হিসেবে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন অটিজম এ্যান্ড নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডারস’ শীর্ষক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। বিকেলে শেখ হাসিনা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রার অংশ হিসেবে অটিজম ও অন্যান্য নিউরো ডেভেলপমেন্ট সমস্যার যথাযথ সমাধানে সক্ষমতা অর্জন শীর্ষক উচ্চ পর্যায়ের এক আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করবেন। ভুটান সফরে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়েছেন তার মেয়ে সায়মা হোসেন ওয়াজেদ, যিনি বাংলাদেশের জাতীয় অটিজম বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপার্সন। অটিজম নিয়ে কাজের জন্য তাকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের ‘চ্যাম্পিয়ন’ ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সফরে রয়েছেন। এছাড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রয়েছেন। শেখ হাসিনাকে ভুটানের রাজার বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক এবং রানী জেটসুন পেম রাজপ্রাসাদ তাশিহোডজংয়ে বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা প্রদান করেন। মঙ্গলবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী রাজপ্রাসাদের প্রধান ফটকে পৌঁছলে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভ্যর্থনা জানানো হয়। পরে তাকে ভুটানের একজন মন্ত্রী ও সিনিয়র কর্মকর্তারা প্রাসাদের ভেতরে নিয়ে যান। এখানে তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী ভুটানের রাজা ও রানীর সঙ্গে দর্শকদের সামনে উপস্থিত হন। পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক ও প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী ভুটানের রাজা ও রানীর সঙ্গে কিছু সময় একান্তে কাটান। শহীদুল হক বলেন, রাজা প্রথমবারের মতো তার ১৪ মাস বয়সী শিশুটিকে প্রধানমন্ত্রীকে দেখান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তার পুত্রের ‘দাদি’ বলে উল্লেখ করেন। এ সময় সায়মা ওয়াজেদ হোসেন, শেখ রেহানার পুত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি এবং তার স্ত্রী ও সন্তানরা উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীকে লালগালিচা অভ্যর্থনা বাসস জানায়, অটিজম বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশে তিনদিনের সরকারী সফরে মঙ্গলবার সকালে ভুটানে এসে পৌঁছলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লালগালিচা অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে। অটিজম এবং নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিসঅর্ডার বিষয়ক তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলন আজ ১৯ এপ্রিল ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে শুরু হচ্ছে। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গেস্ট অব অনার হিসেবে যোগ দেবেন। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে এবং থিম্পুতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জিষ্ণু রায় চৌধুরী বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানান। এ সময় তাকে দুটি শিশু পুষ্পতোড়া প্রদান করে এবং পরে প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিক খাদার (স্কার্ফ) উপহার দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীকে বিমানবন্দরে ভুটানের সেনা সদস্যরা গার্ড অব অনার প্রদান করে এবং তিনি গার্ড পরিদর্শন করেন। এ সময় দুদেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়। বিমানবন্দর থেকে বর্ণাঢ্য মোটর শোভাযাত্রা সহযোগে প্রধানমন্ত্রীকে লা মেরিডিয়ান থিম্পু হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী ভুটান সফরকালে এখানেই অবস্থান করবেন। সেখানে ভুটানের রয়েল প্রিভি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান লিয়েনপো চেনকাব দর্জি তাকে অভ্যর্থনা জানান। পারো বিমানবন্দর থেকে ভুটানের রাজধানীর ৭০ কিলোমিটার সড়কের দুপাশে দাঁড়িয়ে অসংখ্য মানুষ এবং শিশু-কিশোররা দুই দেশের পতাকা হাতে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানায়। সম্মেলন উপলক্ষে এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে স্বাগত জানিয়ে ভুটানের রাজধানী শহরকে বাংলাদেশ ও ভুটানের পতাকা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভুটানের রাজা ও প্রধানমন্ত্রীর বড় আকারের প্রতিকৃতি দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। আজ বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে ভুটানের রাজা ও রানীর দেয়া এক ব্যক্তিগত ভোজেও যোগ দেবেন তিনি। বিকেলে শেখ হাসিনা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রার অংশ হিসেবে অটিজম ও অন্যান্য নিউরো ডেভেলপমেন্ট সমস্যার যথাযথ সমাধানে সক্ষমতা অর্জন শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের এক আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করবেন। শেখ হাসিনা হেজোতে বাংলাদেশ দূতাবাসের ভিত্তিপ্রস্তরের ফলক উন্মোচন করবেন। বাংলাদেশ ও ভুটানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এ সম্মেলনের আয়োজন করছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালিক, অটিজম এবং নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিসঅর্ডার বিষয়ক সরকারের জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপার্সন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন এবং সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়েছেন। তিনদিনের সম্মেলনে অংশগ্রহণ শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী বৃহস্পতিবার দেশে ফিরবেন।
×