ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভারতের পানি প্রত্যাহারই মূল কারণ

লোনা পানি উজানে প্রবেশে ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ হবে

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২২ মার্চ ২০১৭

লোনা পানি উজানে প্রবেশে ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ হবে

শাহীন রহমান ॥ বিশেষজ্ঞদের মতে, হিমালয় থেকে যত পানি উৎপত্তি হয়ে ভাঁটিতে নেমে আসে, তার ৯০ ভাগ পানি এ দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। কিন্তু ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার ও ভূগর্ভস্তরের পানি অধিক ব্যবহারের কারণে আগামীতে বড় ধরনের পানি সঙ্কটের মধ্যে পড়তে পারে দেশ। তাদের মতে উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণেই ভূগর্ভস্তরের পানি রিচার্জ হচ্ছে না। সমুদ্রে লবণাক্ত পানি ঠেলে নামানোর জন্য যে পরিমাণ পানি প্রয়োজন শুষ্ক মৌসুমে নদীতে সেই পরিমাণ পানি পাওয়া যাচ্ছে না। নদীতে এই পর্যাপ্ত পানির প্রবাহ না থাকায় প্রতিনিয়ত সমুদ্রের লোনা পানি দেশের উজানে প্রবেশ করছে। এখনই সতর্ক পদক্ষেপ নেয়া না হলে আগামীতে দেশ ভয়াবহ পানি সঙ্কটে পড়তে পারে বলে তারা উল্লেখ করেছেন। পানি সঙ্কটের এই বিষয়টি মাথায় রেখেই আজ বুধবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস। বিশ্বের ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে নিরাপদ পানির সঙ্কট উপলদ্ধি করে ১৯৯২ সালে জাতিসংঘ ২২ মার্চকে বিশ্ব পানি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের দিবসটি পালনের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দিবসটি পালনের জন্য কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। জাতিসংঘের সাবেক পরিবেষশ ও পানি বিশেষজ্ঞর এসআই খানের মতে, সমুদ্রের লবণ পানি ঠেলে নামানোর জন্য দেশের নদীগুলোতে প্রয়োজন ১ হাজার ৩৪৬ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি। কিন্তু নদীতে এই পর্যাপ্ত পানির প্রবাহ না থাকায় প্রতিনিয়ত সমুদ্রের লোনা পানি দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। তিনি বলেন, এ কারণেই পাতাল পানির রিচার্জ হচ্ছে না ঠিকমতো। পাতাল পানি ৮ মিটারের বেশি নেমে গেলে দেশের নলকূপগুলোর আর পানি পাওয়া যাবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার এবং সমুদ্রের লবণ পানি দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ার কারণে পানি সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ও ভূগর্ভস্থ স্তরের পানি নেমে যাওয়ার কারণেও এ আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের মতে, জাতিসংঘ থেকে নিরাপদ পানি সঙ্কটের কথা উপলব্ধি করে পানি দিবস ঘোষণা করা হলেও দেশের অনেক মানুষ নিরাপদ পানি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত। বিশেষ করে নদী দূষণের কারণে প্রায় নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা এখন কঠিন হয়ে পড়ছে। তারা বলছেন, শুষ্ক মৌসুমে এখন নদীতে প্রবাহ থাকছে না। শিল্পকলকারখানা বর্জ্যরে কারণেও নদীগুলো দূষিত হয়ে পানি ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। এছাড়া আমাদের দেশে পানযোগ্য পানির প্রধান উৎস নদী-খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়, পুকুর ও জলাশয়ের অবস্থাও করুণ। জলবায়ু পরিবর্তন ও ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে এখন নদী-খাল-বিলের অস্তিত্ব আর চোখে পড়ে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব মতে, এক সময় দেশে ১ হাজার ২০০ বেশি নদী থাকলেও সেগুলোর বেশিরভাগই এখন নেই। তাদের সর্বশেষ হিসাবে বর্তমানে দেশে নদীর সংখ্যা ৩১০ কথা বলা হলেও এগুলো এখন হুমকির মুখে পড়ছে। এক হিসেবে দেখা গেছে, পানির অভাবে দেশে প্রায় ১০০ নদী বিলীন হয়ে যাওয়ার পথে। তাদের মতে, উজানে পানি প্রত্যাহারের আগে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীতে পানির প্রবাহ ছিল ১ হাজার ৩৪৬ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। বর্তমানে এ নদীগুলোতে পানির প্রবাহ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। উজানে পানি সরিয়ে নেয়ার কারণেই মূলত নদীর প্রবাহ দারুণভাবে কমে গেছে। এতে করে সমুদ্রের লোনা পানিকে বাধা দেয়ার ক্ষমতা কমে গেছে। একই কারণে পাতাল পানিও পর্যাপ্ত রিচার্জ হচ্ছে না। দেশের লাখ লাখ নলকূপের মাধ্যমে আমরা খাবার পানি সংগ্রহ করে থাকি। এছাড়া ধান চাষের জন্য এবং অন্যান্য ব্যবহারের জন্যও আমরা পাতাল পানি ব্যবহার করছি। এ কারণে পাতাল পানি প্রতিবছর গড়ে ৫ মিটার নিচে নেমে যায়। বৃষ্টিপাতের কারণে পাতাল পানি ১ মিটার এবং বর্ষাকালে বন্যার কারণে নিচু জমি ও জলাভূমি প্লাবিত হওয়ায় ৪ মিটার রিচার্জ হয়। নদীতে পানি প্রবাহ কমে গেলে পাড় উপচে নিচু কৃষি জমি নিম্নাঞ্চল ও জলাভূমি প্লাবিত হয় না। এতে পাতাল পানি রিচার্জ কমে যাচ্ছে। ফলে সেচের পানি ও খাবারের জন্য পানির সঙ্কট দেখা দিচ্ছে শুষ্ক মৌসুমে। তাদের মতে, বাংলাদেশ ভাঁটিতে অবস্থিত হওয়ার কারণে প্রধান প্রধান নদী ও উপনদীগুলো দিয়ে হিমালয় অঞ্চল চীন, নেপাল, ভুটান ও ভারত থেকে পানি ও পলিমাটি দেশের অভ্যন্তরে বয়ে নিয়ে আসছে শ’ শ’ বছর ধরে। এই পানি সম্পকে ঘিরে গড়ে উঠেছে কৃষি সংস্কৃতি এবং কৃষি সংস্কৃতিকে ঘিরে মানব সভ্যতা বিকশিত হয়েছে। ১৯৪৭ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশের জনসংখ্যা সাড়ে ৪ কোটি থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটিতে। এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পানির চাহিদা দারুণভাবে বেড়ে চলেছে। খাবার পানি, গৃহস্থালির কাজের পানি কৃষি সেচ, শিল্প কারখানা, নগরায়ন এবং জলাধারে পানি সংরক্ষণ প্রয়োজন মেটাতে পানির চাহিদা বাড়ছে। অথচ ভারতের একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের ফলে পানি সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করছে। ইতোমধ্যে প্রায় সবগুলো নদীর উজানে বাঁধ ও ব্যারেজ নির্মাণ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২৫ সাল পর্যন্ত ভারতের বার্ষিক পানির প্রয়োজন ১ হাজার ১৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। তাদের পানির প্রাপ্যতা রয়েছে ৬ হাজার ৩৭৩ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। এর সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে পানি হারভেস্টিং করলে আরও ১৪২ বিসিএম পানি পাওয়া যাবে। ভারতের এই পানির প্রাপ্যতা প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় ৭ গুণ বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতে প্রাপ্য পানির ১৫ ভাগ ব্যবহার করলে নদীতে বাঁধ বা ব্যারেজ দিয়ে উজানে বাংলাদেশের পানি সরানোর কোন প্রয়োজন হয় না। অথচ একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে তারা বাংলাদেশের মানুষের জীবন হুমকিতে ফেলে দিচ্ছে। নদী দূষণের কারণে নিরাপদ পানি সরবরাহ করতে ওয়াসাকে ভূগর্ভস্থ স্তরের পানিও ওপর বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে। ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা শহরের চাহিদার ৮৬ ভাগ পানি যোগান দেয়া হচ্ছে ভূগর্ভস্থ স্তর থেকে। ফলে প্রতিবছর ভূগর্ভ স্তরের পানি নিচে নেমে যাচ্ছে। যা প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। এদিকে বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে পানির অপচয় রোধ ও পুনর্ব্যবহার নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে এ দাবি জানানো হয়। মানববন্ধনে বলা হয়, নগরায়নের ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং অনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক কর্মকা-ের ফলে বিশ্বব্যাপী বর্জ্য পানির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। পানির ক্রমবর্ধমান সঙ্কট রোধে প্রতিদিনের কাজে ব্যবহৃত পানির পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করাও প্রয়োজন। তারা বলেন, পানির পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হলে বিদ্যমান পানির সঙ্কট ও অপচয় বহুলাংশে হ্রাস করা যাবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ পানি আইন বাস্তবায়ন, নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে উল্লেখ করেন। বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে এই মানববন্ধন কর্মসূচীর আয়োজন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম।
×