ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

র‌্যাব ক্যাম্পে আত্মঘাতী হামলা

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১৮ মার্চ ২০১৭

র‌্যাব ক্যাম্পে আত্মঘাতী হামলা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সীতাকু-ে জঙ্গী অপারেশনের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকায় নির্মাণাধীন র‌্যাব সদর দফতরের ভেতর আত্মঘাতী বোমা হামলায় এক জঙ্গী নিহত হয়েছে। শুক্রবার জুমার নামাজের আগ মুহূর্তে আশকোনা হাজিক্যাম্প মসজিদ সংলগ্ন দেশের এলিট বাহিনীর সদর দফতরে এই ঘটনা ঘটে। এতে র‌্যাবেরও দই সদস্য আহত হয়েছে। বিস্ফোরণে নিহত জঙ্গীর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ায় তাৎক্ষণিক শনাক্ত করা যায়নি তার নাম-পরিচয়। তার বয়স আনুমানিক ২৫ থেকে ৩০ হতে পারে। ঘটনার পর পরই দেশের সব বিমানবন্দর,কারাগার ও রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। তল্লাশি চালানো হয় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার গণপরিবহন, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল ও অন্যান্য যানবাহনে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন দফতরে প্রবেশ করে জঙ্গীদের বোমা বিস্ফোরণের এটাই প্রথম ঘটনা। আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান র‌্যাব মহাপরিচালকসহ বিভিন্ন গোয়েšদা বাহিনীর উর্ধতন কর্মকতারা। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আশকোনা হাজিক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় বিপুলসংখ্যক র‌্যাবের গাড়ি অবস্থান করতে দেখা যায়। এ সম্পর্কে র‌্যাব মিডিয়ার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান জনকণ্ঠকে বলেছেন, জুমার নামাজের আগে ২৫-৩০ বছর বয়সী অপিরচিত এক যুবক ক্যাম্পের পূর্বপাশের দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করে। এ সময় তাকে চ্যালেঞ্জ করতে গেলে সে মুহূর্তেই নিজের শরীরে রাখা বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু ঘটে। এ সময় র‌্যাবের দুই সদস্য আহত হয়। ধারণা করা হচ্ছে, এটি আত্মঘাতী জঙ্গীর কাজ। তার শরীরেই সুইসাইডাল ভেস্ট বাঁধা ছিল। ঘটনার পর পরই এ প্রতিবেদক সেখানে হাজির হয়ে দেখতে পান বিপুলসংখ্যক র‌্যাব সদস্যের উপস্থিতি। শুক্রবার আশকোনা হাজিক্যাম্প মসজিদের পশ্চিম পাশের একটি দেয়াল টপকে নির্মাণাধীন র‌্যাবের সদর দফতরে প্রবেশ করে এই আত্মঘাতী জঙ্গী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলার শব্দ শুনে অনেকেই সেখানেই দৌড়ে যান। তখন মুসল্লিরা জুমার নামাজে যাচ্ছিলেন। হাসনাইন নামের এক মুসল্লি বলেন, আমি বাসা থেকে বের হয়ে সবে মসজিদের গেটে ঢুকেছি, তখনই বিকট শব্দ শুনতে পাই। এ সময় মসজিদ থেকে অনেকেই দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। মসজিদ থেকে আমি বের হয়ে আসি। কিন্তু সামনে যেতেই দেখি র‌্যাব জড়ো। তারা লোকজনকে বাধা দিচ্ছে। নামাজ পড়ে বের হয়ে শুনি এ ঘটনা। তখন বেলা পৌনে একটা। মুজিবুল হক নামের এক মুসল্লি বলেন, ক্যাম্পের কাছাকাছি যাওয়ার পরই বিকট শব্দে বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনতে পাই। দৌড়ে গিয়ে দেখতে পাই, ছিন্নভিন্ন একটি মৃতদেহ পড়ে আছে। মৃতদেহের ছিন্নভিন্ন অংশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। পরে আমরা সবাই নামাজে চলে যাই। নামাজ শেষ করে আবারও সেখানে আসি। তখন জানতে পারি মসজিদের পশ্চিম পাশের দেয়াল টপকে এক যুবক ভেতরে ঢুকেই শরীরে বাঁধা বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এই প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণের মতোই র‌্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মুফতি মাহমুদ বলেন, আনুমানিক বেলা একটার দিকে বাউন্ডারি ওয়ালের নিচ দিয়ে একজন প্রবেশ করে। অপরিচিত ব্যক্তি হওয়ায় তাকে চ্যালেঞ্জ করা হলে সে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা বিস্ফোরণ ঘটে। ঘটনাস্থলেই আত্মঘাতীর মৃত্যু হয়। বেলা আড়াইটার সময় র‌্যাব ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় মূল প্রবেশের গেট বন্ধ। কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। ততক্ষণে মসজিদের পূর্ব পাশের দেয়ালের পাশেও র‌্যাব সদস্যরা টহল দিতে শুরু করে। মুফতি মাহমুদ বলেন, এখন ক্যাম্পের নিরাপত্তাকেই তারা বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন। যেহেতু বিস্ফোরণ ঘটেছে সেহেতু আর কোন বিস্ফোরক আছে কিনা; বোম ডিসপোজাল ইউনিট সেটি পরীক্ষা করে দেখছে। এখানে যারা কাজ করবেন তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সদর দফতরের এই আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ কোন্ জঙ্গীগোষ্ঠীর তা সুনির্দিষ্ট করে না বলতে পারলেও র‌্যাবের পক্ষ থেকে এটিকে জঈ হামলা বলেই ধারণা করা হচ্ছে। র‌্যাব জানিয়েছে, বিস্ফোরকের ধরন দেখে ধারণা করা হচ্ছে, হামলাকারী কোন জঙ্গীগোষ্ঠীর সদস্য। তবে হামলাকারীর মৃতদেহের কাছ থেকে একটি কালো ব্যাগ উদ্ধার করা হয়েছে। জঙ্গীর ছিন্নভিন্ন লাশের পাশেই একটি কালো ট্রাভেল ব্যাগ পড়ে থাকতে দেখা যায়। এই ব্যাগে কী আছে তা এখনই জানা সম্ভব হচ্ছে না। হামলাকারীর মাথায় ক্যাপ পরা ছিল। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে দেখা যায়, হাজিক্যাম্প মসজিদের পশ্চিম পাশের সীমানা দেয়াল ঘেঁষেই নির্মিত হচ্ছে র‌্যাবের সদর দফতর। বছরতিনেক আগে শুরু হয় এই নির্মাণ কাজ। তিন বছরেও এখনও বড় ধরনের কোন ভবন নির্মাণ সম্ভব হয়নি। এই দফতরের উত্তরপাশে রাস্তা ঘেঁষে একটি সীমানা প্রাচীর রয়েছে। পশ্চিমে রেললাইন সংলগ্ন একটি দেয়ালই র‌্যাব নিজেদের নিরাপত্তায় কাজে লাগাচ্ছে। দক্ষিণপাশে নেই কোন সীমানা প্রাচীর। পূর্বপাশে র‌্যাবের নিজস্ব কোন দেয়াল নেই। তবে মসজিদের পশ্চিমের দেয়ালটাই শেয়ার করছে র‌্যাব দফতর। আর এদিক দিয়েই ভেতরে প্রবেশ করে ওই জঙ্গী। প্রত্যক্ষদর্শীর এক র‌্যাব সদস্য জানান, মসজিদের দিক থেকেই ওই যুব্ক হঠাৎ খুব সহজেই দেয়াল টপকে র‌্যাব দফতরে ঢুকে পড়ে। তাৎক্ষণিক সেখানে কর্তব্যরত কয়েক র‌্যাব সদস্য তাকে বাধা দিতে যায়। তখনই সে বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তার দেহ। শরীরের বিভিন্ন অংশ দূরে ছিটকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাকে মুখ দেখে চেনার উপায় নেই। পরনে ছিল একটি কালো রঙের পাঞ্জাবি। তার গলায় একটি নীল রঙের গেঞ্জি বাঁধা ছিল। মাথায় ছিল একটি ক্যাপ। তবে তার কাছে কোন ধরনের লিফলেট পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য, তিন মাস আগে গত ২৪ ডিসেম্বর আশকোনাতেই জঙ্গী আস্তানায় প্রায় ১৬ ঘণ্টার পুলিশী অভিযানে জঙ্গী নেতা তানভীর কাদেরীর ছেলেসহ দুজন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। দক্ষিণখানের পূর্ব আশকোনায় হাজি ক্যাম্পের কাছে তিনতলা বাড়ির সূর্য ভিলায় অভিযান চালানো হয়। ওই বাড়িতে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত দুজনের একজন হলেন জঙ্গীনেতা তানভীর কাদেরীর ১৪ বছর বয়সী ছেলে। অন্যজন পলাতক জঙ্গী নেতা রাশেদুর রহমান সুমনের স্ত্রী শাকিরা। তারপর শুক্রবার ঘটে যায় এই ঘটনা। ্র‌্যাব জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে প্রমাণ মেলেছে এ ঘটনায় ব্যবহার করা হয়েছে সুইসাইডাল ভেস্ট। গত ডিসেম্বরে আশকোনায় হাজি ক্যাম্পের পাশের একটি বাড়িতেও সুইসাইডাল ভেস্টের মাধ্যমে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায় এক নারী জঙ্গী। ফের এই একই কায়দায় আত্মঘাতী হামলা চালায় এক জঙ্গী। বৃহস্পতিবারও সীতাকু-ে দুটি জঙ্গী আস্তানার একটিতে অভিযান চালানোর সময় পুলিশ এক আত্মঘাতী নারীসহ জঙ্গী দম্পতিকে আটক করে। সুইসাইডাল ভেস্ট দেখতে ফতুয়া বা হাতাকাটা গেঞ্জির মতো। এটা বেল্টের মতোও হয়। যা জঙ্গী-সন্ত্রাসী আত্মঘাতী হামলা চালাতে ব্যবহার করে। এই পোশাক থাকে বিস্ফোরক ভর্তি। ২৪ ডিসেম্বর আশকোনার ওই বাড়িতেও কোমরে ‘সুইসাইডাল ভেস্ট’ পরে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল এক নারী জঙ্গী। বাড়ির ভেতরে থাকা তিনজনকে আত্মসমর্পণ করতে বললে বোরখা পরা ওই নারী ধীরে ধীরে হেঁটে ঘর থেকে বের হয় এবং বিস্ফোরণ ঘটায়। তখন তাকে হাত উঁচু করতে বললে সে তা করেনি। বোরখা পরা থাকায় বোঝা যাচ্ছিল না তার কোমরে সুইসাইডাল ভেস্ট ছিল কিনা। একইভাবে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মিরপুরের একটি জঙ্গী আস্তানা থেকে কয়েকটি সুইসাইডাল ভেস্ট উদ্ধার করেছিল পুলিশ। এছাড়া চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ঘাঁটি বানৌজা ঈঁসা খানের ভেতরে বানৌজা পতেঙ্গা মসজিদে বিস্ফোরণের পর আটক আবদুল মান্নানের কাছ থেকে বোমাসহ কয়েকটি সুইসাইডাল ভেস্ট উদ্ধার করা হয়। শুক্রবারও নির্মাণাধীন সদর দফতরে আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে এতে আত্মঘাতী হামলাকারী নিহত হয়। তার শরীরেও সুইসাইডাল ভেস্ট পরা ছিল বলে নিশ্চিত হয়েছে র‌্যাব।
×