ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

উপকূলের জেলেরা দেনার ভারে কাহিল

প্রকাশিত: ০৪:৫৫, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

উপকূলের জেলেরা দেনার ভারে কাহিল

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, ২৭ ফেব্রুয়ারি ॥ সাগরে জলদস্যুদের তান্ডব কমে এসেছে। কিন্তু মুক্তিপণে নিঃস্ব হাজারো মৎস্যজীবী এখন দেনার ভারে কাহিল। এদের জীবন-জীবিকা বন্ধের উপক্রম। উপকূলীয় এই জনপদের শত শত জেলে পরিবার জলদস্যুদের নৃশংসতায় এখন দিশেহারা। মারধর-নির্যাতনে শারীরিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে বহু জেলে। এদের ভয়ে এখনও সাগরে যায় না বহু জেলে। টাকার জন্য গুলি পর্যন্ত করা হয়েছে। কেউ কেউ সাগরে ঝাঁপ দিয়েছে প্রাণ বাঁচাতে। নির্মম মারধরের কথা না শুনলে বোঝা যায় না কী বর্বরতার শিকার হয়েছে সাগরে মাছ শিকারি জেলেদের। এদেরই একজন পঞ্চাশ বছর বয়সী মাঝি আবুল কালাম। ৩০ বছর কেটেছে সাগরে। এখনও নিজস্ব এফবি মা কুলসুম ট্রলারে মাছ শিকার করছেন। ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে দুইবার জলদস্যু তাকে অপহরণ করে নেয়। প্রথম দফায় রাজু বাহিনীর আস্তানায় ১৪ দিন। দ্বিতীয় দফায় জাহাঙ্গীর বাহিনীর ডেরায় ৩৪ দিন। প্রথম দফায় ওই বাহিনী মাঝিসহ ৬৪ জেলেকে এবং দ্বিতীয় দফায় ৬১ জনকে অপহরণ করে। প্রথম বাহিনীকে এক লাখ পাঁচ হাজার এবং দ্বিতীয় বাহিনীকে এক লাখ সাত হাজার টাকা মুক্তিপণ দিতে হয়েছে। ডাকাতের আস্তানায় থাকতে সুন্দরী লাঠির আঘাতের কথা এখনও ভোলেননি আবুল কালাম। তিনি জানান, যতক্ষণ হুঁশ থাকত, ততক্ষণ পেটাতো। মোবাইলে স্বজনদের নম্বরে রিং করে শোনাতো নির্যাতনে ভয়াবহতা। চিৎকারের শব্দ শোনাতো। যেন দ্রুত টাকা পাঠানো হয়। ডাকাতের সব কাজ করতে বাধ্য করা হতো জিম্মি জেলেদের। রান্না থেকে শুরু করে কালামের ভাষায়, ‘পাও ধোয়ানোর পানি পর্যন্ত দেয়া লাগতো।’ কালাম এখন নিঃস্ব। তিনি ১৬ লাখ টাকার দেনায় কাহিল। শুধু কালাম নয়, কাদের মাঝির ছিল পাঁচটি ট্রলার। এখন আছে মাত্র একটি, এফবি খাদিজা। এ মানুষটির শুধু মুক্তিপণের জন্য ২০১১-২০১৫ সালে পাঁচ বছরে গুনতে হয়েছে ৭৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা। আটবারে এ টাকা তাকে দিতে হয়েছে। কাদের মাঝি খাজুরা গ্রামে বসবাস করেন। লাভ তো দূরের কথা এখন কাদের মাঝি উল্টো ৫০ লাখ টাকার দেনা। তুলাতলীর জেলে নুর ছায়েদ প্যাদাকে মারধর করে গুলি করা হয়েছে। রত্তনের বোটের জাহাঙ্গীর মাঝিকে অপহরণ করা হয় ২০১৫ সালে। এফবি সাইফুল বোটের রহমান মাঝিকে অপহরণ করা হয়। এক লাখ ছয় হাজার টাকার বিনিময়ে মুক্তি মেলে। বোট মালিক সোবাহান খলিফাকে অপহরণ করে পাঁচবার। এ জন্য তাকে ২০১০ সাল থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা মুক্তিপণ দিতে হয়েছে। ২০১৪ সালে জলদস্যুদের হামলায় প্রাণ বাঁচাতে সাগরে ঝাঁপ দিতে হয়েছে পাঁচ জেলের। দীর্ঘক্ষণ ভাসার পরে তাদের মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। জয়নাল মাঝি নিজেই বোট মালিক। তাকে তিনবার অপহরণ করা হয়েছে। তিন লাখ টাকা মুক্তিপণে মুক্ত হয়েছেন। কর্ণফুলী বোটের ইউসুফ মাঝিকে ২০১৫ সালের শেষদিকে অপহরণ করে জলদস্যুরা। এক লাখ টাকায় রফা। জয়নাল মাঝির এখন ১০ লাখ টাকার দেনা। মুক্তিপণের জন্য এ মানুষটিকে গবাদিপশু পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে। ধার-দেনায় দুই চোখে ঝাপসা দেখছেন। বেল্লাল হোসেন কাজীর একটি বোট আজ পর্যন্ত পায়নি। র‌্যাব-৮-এর উপ-অধিনায়ক মেজর আদনান কবির জানান, জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। যারা এখনও রয়েছে তারাও র‌্যাবের নজরদারিতে রয়েছে। কিনারে যারা জলদস্যুদের সোর্স, তাদেরও অনুসন্ধান করে বের করা হবে। ভদ্রবেশী মুখোশধারীদের জনপদ থেকে চিহ্নিত করা হবে। রেহাই পাবে না যারা দালালি করেছে। তিনিও জলজীবী-মৎস্যজীবী যারা নিপীড়িত হয়েছে তাদের নৈতিকভাবে ও সামাজিকভাবে সহায়তার জন্য কাজ করা হচ্ছে বলে জানান।
×