ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধাপরাধী বিচার

ময়মনসিংহের ১১ রাজাকারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

 ময়মনসিংহের ১১ রাজাকারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ময়মনসিংহের ১১ রাজাকারের বিরুদ্ধে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এই ১১ রাজাকারের বিরুদ্ধে হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায়ের চারটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৪ জনকে হত্যা, ৯ জনকে আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার পাগলা থানার নিগুয়ারী ইউনিয়নের সাধুয়া গ্রাম ও টাঙ্গাব ইউনিয়নের রৌহা গ্রাম এলাকায় তারা এসব অপরাধ করে বলেও অভিযোগে বলা হয়েছে। এটি তদন্ত সংস্থার ৪৮তম প্রতিবেদন। ১১ রাজাকারের মধ্যে ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলো- ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার পাগলা থানার নিগুয়ারী ইউনিয়নের সাধুয়া গ্রামের মোঃ খলিলুর রহমান (৬২), একই গ্রামের মোঃ সামসুজ্জামান ওরফে আবুল কালাম (৬৫), একই গ্রামের মোঃ আব্দুল্লাহ (৬২), মোঃ রইছ উদ্দিন আজাদী ওরফে আক্কেল আলী (৭৪) এবং ভালুকা উপজেলার রাজৈ ইউনিয়নের খুর্দ্দ পনাশাইল গ্রামের মোঃ আব্দুল মালেক আকন্দ ওরফে আবুল হোসেন ওরফে আবুল মেম্বার (৬৮)। পলাতক ছয়জন আসামির বিরুদ্ধে শীঘ্রই ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের মাধ্যমে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন জানানো হবে বলে জানিয়েছে তদন্ত সংস্থা। সোমবার রাজধানীর ধানম-িতে তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার ৪৮তম এ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান ও তদন্তকারী কর্মকর্তা মনোয়ারা বেগম। আব্দুল হান্নান খান জানান, ৬ খ-ে ৭৫ পৃষ্ঠা করে মোট ৪৫০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনটি শীঘ্রই প্রসিকিউশনের কাছে জমা দেয়া হবে। এর ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) তৈরি করে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে। আসামিদের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে তদন্ত শুরু করে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়। ৬০ জনের জবানবন্দী নেয়া হলেও একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও জব্দ তালিকার দু’জনসহ মোট ৩১ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেবেন। গ্রেফতারকৃত আসামিদের মধ্যে সামসুজ্জামান ও মোঃ রইছউদ্দিন আজাদী জামায়াত, মোঃ আব্দুল মালেক বিএনপি ও মোঃ খলিলুর রহমান জাতীয় পার্টির সক্রিয় সমর্থক। ১১ রাজাকারের বিরুদ্ধে যে ৪টি অভিযোগ আনা হয়েছে তা হলো (ক) ১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট (৩০ শ্রাবণ ১৩৭৮ বাংলা) বেলা আনুমানিক ১২টার দিকে গ্রেফতার ৫ জন ও অভিযুক্ত অন্য ৬ জন আসামিসহ ১০/১২ জন রাজাকার ময়মনসিংহ জেলার সাবেক গফরগাঁও বর্তমানে পাগলা থানার নিগুয়ারী ইউনিয়নের সাধুয়া গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাহাবুদ্দিন ওরফে খোকা খান, স্বাধীনতার সপক্ষের নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালী হাশেম খান, আনিসুর রহমান খানদের বাড়ি ঘেরাও করে। তখন রাজাকারদের দেখে ভয়ে পালানোর সময় আসামিরা স্বাধীনতার সপক্ষের নিরীহ নিরস্ত্র আবুল হাশেম খান ও আনিছুর রহমান খানকে নির্যাতন করে। রাজাকাররা তাদের বাড়িতে প্রবেশ করে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে এবং আসামিরা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাহাবুদ্দিন ওরফে খোকা খানকে অপহরণ করে নিগুয়ারী ইউনিয়নের নিগুয়ারী বাজার ত্রিমোহনী রাজাকার ক্যাম্প নিয়ে ৭ দিন অবৈধভাবে ওই রাজাকার ক্যাম্পে আটক রেখে অমানুষিক নির্যাতন করে। ২৩ আগস্ট ১৯৭১ (বাংলা ৬ ভাদ্র ১৩৭৮) রাতের কোন এক সময় হত্যা করে লাশটি নদীতে ফেলে দেয়। (খ) ১৯৭১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর (৫ আশ্বিন ১৩৭৮) দিবাগত রাত আনুমানিক সাড়ে ১২টার দিকে আসামিরা এবং কয়েকজন পাকিস্তান আর্মির সদস্য পাগলা থানাধীন টাঙ্গাব ইউনিয়নের রৌহা গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ও স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা নূর হোসেন ব্যাপারীর বাড়ি ঘেরাও করে। তারা বাড়িতে এবং সামনের দোকান ঘর লুটপাট করে নূর হোসেন ব্যাপারীসহ আটজনকে নির্যাতন করতে করতে বারইহাটি বাজারে রাজাকারদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। টাকা নিয়ে কয়েকজনকে ছেড়ে দিলেও নূর হোসেন ব্যাপারীকে আটক রেখে ওই রাতে কালিবানার নদীর ঘাটে (চরহী ঘাট) নিয়ে গুলি করে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেয়। (গ) ১৯৭১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর (৭ আশ্বিন ১৩৭৮) আছরের নামাজের পর আসামিরা পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর ৪/৫ জন সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে পাগলা থানার সাধুয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদের (মৃত) বাবা স্বাধীনতার পক্ষের স্থানীয় সংগঠক জৈধর খান ওরফে তারু খাঁর বাড়িতে লুটপাট চালানোর পর অগ্নিসংযোগ করে। জৈধর খাঁ ও তার ভাই জমধর খাঁকে ত্রিমোহনী বাজারে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতনের পর ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে তাদের গুলিতে হত্যা করে লাশ সুতিয়া নদীতে ফেলে দেয় আসামিরা। (ঘ) ১৯৭১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর (১০ আশ্বিন ১৩৭৮ বাংলা) সকাল ৯/১০টার দিকে আসামিরাসহ আরও ১০/১২ জন রাজাকার পাগলা থানার সাধুয়া গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ধনাঢ্য ব্যক্তি তৈয়ব আলী সরকারের বাড়ি ঘেরাও করে তাকে ও তার মুক্তিযোদ্ধা ছেলেকে খোঁজ করে না পেয়ে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। দুদিন পর তৈয়ব আলী সরকারসহ তিনজনকে পাত্থার বিলের ঘাটে রাখা রাজাকারদের নৌকায় তোলা হয়। তখন ৪ হাজার টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে একজনকে ছেড়ে দেয়, একজনকে অমানবিক নির্যাতন করে মৃতপ্রায় অবস্থায় বিলের পাড়ে ফেলে দেয়। তৈয়ব আলী সরকারকে সাধুয়া পাত্থার বিলের পানিতে চুবানো হয়। মৃতপ্রায় অবস্থায় নৌকায় তুলে রাজাকাররা হাতে থাকা অস্ত্র দিয়ে পিটিয়ে তাকে জখম করে। এরপর লাথি মারতে মারতে নৌকা থেকে বিলে ফেলে দেয়। তিন দিন পর তৈয়ব আলী সরকারের লাশ বিলে ভেসে উঠলে স্থানীয়রা লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করে।
×