ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাস্টিশিয়া মূর্তি নয়, ভাস্কর্য

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

জাস্টিশিয়া মূর্তি নয়, ভাস্কর্য

আরাফাত মুন্না ॥ সুপ্রীমকোর্টের সামনে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে যে ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছে তার নাম জাস্টিশিয়া। জাস্টিশিয়া রোমান শব্দ। অর্থ বিচারক। তিনি একজন নারী। পৃথিবীর অনেক দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সামনেই এই ভাস্কর্য রয়েছে। সুপ্রীমকোর্টসহ সারাদেশের আদালতগুলোর সৌন্দর্য বাড়ানোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে সুপ্রীমকোর্টের মূল ভবনের সামনে সম্প্রতি স্থাপন করা হয়েছে জাস্টিশিয়ার দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্যটি। কিন্তু কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠন একে ‘গ্রিক দেবীর মূর্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করে অপসারণের দাবি জানাচ্ছে। এই দলে আছে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী আন্দোলন প্রমুখ। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় এ সংগঠনগুলো বিক্ষোভেরও চেষ্টা চালায়। গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির কাছে স্মারকলিপি দিয়ে ভাস্কর্যটি সরিয়ে না নিলে আন্দোলনে যাওয়ারও হুমকি দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। অন্যদিকে বিশিষ্টজনরা বলছেন, সুপ্রীমকোর্টে স্থাপিত ভাস্কর্যের সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। মূর্তি ও ভাস্কর্যে পার্থক্য না বুঝেই এটা সরানোর দাবি জানানো হচ্ছে। হেফাজতের এই ধরনের কর্মকা-ের প্রতিবাদে ক্ষোভ প্রকাশ করে সম্প্রতি বিবৃতি দিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। এই দিকে এই ভাস্কর্যটি এখনও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়নি। গত জানুয়ারিতে এই ভাস্কর্যটি প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন বলে সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন জানালেও, তা হয়নি। তবে শীঘ্রই এই ভাস্কর্যটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন বলে সুপ্রীমকোর্টের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ বিষয়ে বলেন, ‘এটা তো মূর্তি না, এটা তো ভাস্কর্য। আর এখানে দেখানো হয়েছে তিনটা জিনিস। একটা হলোÑ দাঁড়িপাল্লা, ন্যায়বিচারের একটা সূচক। আর হাতে একটা তলোয়ার। দ- বা শাস্তির সূচক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তলোয়ার। তৃতীয়ত, চোখটা বাঁধা। অর্থাৎ একদম নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই বিচারের নিরপেক্ষতা তুলে ধরা হয় এই ভাস্কর্য দিয়েই। হেফাজতের দাবির প্রতি কান দেয়া ঠিক হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। ইরানের আদালতেও জাস্টিশিয়া : ইরান গভীর ইসলামী মূল্যবোধসম্পন্ন একটি মুসলিম রাষ্ট্র। সে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ‘তেহরান কোর্ট হাউস’-এর সামনেও জাস্টিশিয়ার ভাস্কর্য রয়েছে। ইরানে ইসলামী শরিয়াহ আইন প্রচলিত। এমন একটি দেশের আদালত চত্বরে একই ভাস্কর্য স্থান পাওয়ায় ইরানিদের ধর্মীয় অনুভূতিতে কোন আঘাত লাগেনি। ইরানিরা এই ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে কখনও আন্দোলন করেনি, বিক্ষোভ দেখায়নি। অথচ ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে জাস্টিশিয়া ভাস্কর্য ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে প্রচার চালাচ্ছে কয়েকটি সংগঠন। জাস্টিশিয়া কোনো দেবী নন। বরং জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে ন্যায়বিচার তথা বিচারসংশ্লিষ্ট মূল্যবোধের প্রতীক হিসেবে সারা বিশ্বে স্বীকৃত। ইরান ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, হংকং, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, হাঙ্গেরিসহ অনেক দেশেই এ ভাস্কর্য রয়েছে। একেক দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিবেচনায় জাস্টিশিয়ার অবয়ব ও পোশাক একেক রকম। বাংলাদেশের জাস্টিশিয়ার পরনে আছে শাড়ি। তার ডান হাতে রয়েছে একটি খোলা তলোয়ার, যা কর্তৃত্ব, শক্তি ও সামর্থ্যরে প্রকাশ। এ তলোয়ার আদালতের রায় বাস্তবায়ন ও আইনের আশ্রয় লাভের প্রতীক হিসেবেও পরিচিত। ভাস্কর্যের বাঁ হাতে আছে একটি দাঁড়িপাল্লা, যা ন্যায় ও পক্ষপাতহীনতার প্রতীক। আইনবিষয়ক ইয়েল জার্নালের মতে, এটি মামলার কোন পক্ষের প্রতি রাগ বা অনুরাগের বশবর্তী না হয়ে নিরপেক্ষভাবে আদালতে উপস্থাপিত সাক্ষ্য বিবেচনার প্রতীক হিসেবেও এই ভাস্কর্য পরিচিত। সৌন্দর্যবর্ধনে ভাস্কর্য : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে একাধিক ভাস্কর্য। এ ছাড়া সুপ্রীমকোর্টের ওয়াটার লিলি ফোয়ারা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুরে জাগ্রত চৌরঙ্গী, বাংলা একাডেমি চত্বর, বাংলামোটর, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মাসহ বিভিন্ন স্থানে অনেক ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। সুপ্রীমকোর্টের সামনে স্থাপিত জাস্টিশিয়াও তেমনই একটি শিল্পকর্ম। একে মূর্তি হিসেবে চিহ্নিত করা বিভ্রান্তিমূলক বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ভাস্কর্য মূলত নান্দনিকতা ও সৌন্দর্যতত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। সৌদি আরব, মিশর, তুরস্ক, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়াসহ বহু মুসলিমপ্রধান দেশে ভাস্কর্য রয়েছে নগরের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য। নির্মূল কমিটির বিবৃতি : সুপ্রীমকোর্টে প্রাঙ্গণে স্থাপিত ন্যায়বিচারের ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে কয়েকটি সংগঠনের হুমকির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। সম্প্রতি সংগঠনের উপদেষ্টা ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে বলেছেন, আমরা অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করছি ’৭১-এর ঘাতক দালাল মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির প্রতিভূ হেফাজতে ইসলাম এবং তাদের সহযোগীরা ন্যায়বিচারের ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে একের পর এক যেভাবে হুমকি দিচ্ছে সরকার কিংবা উচ্চ আদালত তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তারা বলেন, সুপ্রীমকোর্টের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্যকে হেফাজতীরা মূর্তি বা প্রতিমা বলছে যা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক নির্জলা মিথ্যা ছাড়া আর কিছু নয়। এই ভাস্কর্য জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বহু দেশের উচ্চ আদালতে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এর সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। নির্মূল কমিটি আরও বলেছে, ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল এবং সরকার উতখাতের জন্য জামায়াত-বিএনপির সহযোগিতায় হেফাজতীরা মাদ্রাসার নিরীহ ছাত্রদের রাজধানীতে এনে যে মহাতা-ব সৃষ্টি করেছিল তা ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। যে ইরানে ইসলামী হুকুমত ও শরিয়া আদালত বিদ্যমান রয়েছে সেখানেও উচ্চতর আদালতের দেয়ালে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ন্যায়বিচারের প্রতীক ‘জাস্টিশিয়া’ ভাস্কর্য খোদাই করা রয়েছে। সৌদি আরব, মিশর, তুরস্ক, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়াসহ বহু মুসলিমপ্রধান দেশে ভাস্কর্য রয়েছে নগরের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য। আদালত ও বিচারব্যবস্থার প্রতি হুমকি প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে বিবৃতিতে। বিবৃতিদাতারা হলেন, বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম, বিচারপতি শামসুল হুদা, বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, অধ্যাপক অজয় রায়, কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী, লেখক সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, সাংবাদিক কামাল লোহানী, অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর প্রমুখ।
×