ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মঙ্গা ঠাঁই পেয়েছে জাদুঘরে ॥ মাটির চুলা হাঁড়ি পাতিল উধাও, বিদ্যুতে আলোকিত গ্রাম

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৩১ জানুয়ারি ২০১৭

মঙ্গা ঠাঁই পেয়েছে জাদুঘরে ॥ মাটির চুলা হাঁড়ি পাতিল উধাও, বিদ্যুতে আলোকিত গ্রাম

সমুদ্র হক ॥ গ্রামীণ অর্থনীতি আগের চেয়ে এখন অনেক চাঙ্গা। শহরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নত হচ্ছে গ্রামীণ জীবনমান। এখন শুধু কৃষিই নয়, এর বাইরে অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালিত হয় এমন উদ্যোগ ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী এক শতকে এই হার বেড়েছে অন্তত ৩০ শতাংশ। বর্তমানে প্রতি বছর বাড়ছে গড়ে ৯ শতাংশ হারে। ফলে স্থানীয়ভাবে কর্ম সংস্থানের হার বেড়ে যাওয়ায় দারিদ্র্যের হার কমছে। এক যুগ আগে এই হার ছিল ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ, বর্তমানে তা ১২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। দারিদ্র্য পালিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। গ্রামের দৃশ্য যে পাল্টে যাচ্ছে তা এখন সাদা চোখেই দেখা যায়। একদার খড় বেড়ার কুঁড়েঘর, গোয়াল ঘর, ঢেঁকি, পাতকুয়া, কাঁচা লেট্রিন, ক্ষেতের আইলে বর্জ্য আর চোখে পড়ে না। বিদ্যুত পৌঁছেছে বেশিরভাগ গ্রামে। সেখানে কুপি হারিকেন দেখা যায় না। এগুলো তুলে রাখা হয়েছে। নগর জীবনের মতো গ্রামেও লোডশেডিং মোকাবেলায় প্রতি ঘরেই আছে চার্জার লাইট। বিদ্যুতায়িত হয়নি এমন গ্রামে সোলার প্যানেল বসেছে। গ্রামের অনেক নারী এখন রান্না করে প্রেসার কুকারে এলপি গ্যাসের চুলায়। আঙিনার মধ্যে মাটির চুলা ও মাটির হাঁড়ি পাতিল সহজে চোখে পড়ে না। গ্রামের রাত এখন শহরের মতোই আলোকিত। গ্রামের অধিকাংশ মূল সড়ক এখন পাকা। যন্ত্রচালিত যানবাহন চলছে পাকা সড়কে। একদার চির চেনা গরুর গাড়ি, মোষের গাড়ি, ঘোড়ায় চালিত টমটম দেখা যায় না। বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠান র‌্যালিতে কখনও ঐতিহ্য দেখাতে ভাড়া করে নিয়ে যাওয়াও হয় এসব চেনা যানবাহন। গ্রামীণ মিলনমেলার নদী পাড়ের সেই খেয়া পারাপার নেই। ছোট পারাপারের স্থলে নির্মিত হয়েছে পাকা সেতু। অভূতপূর্ব ও অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে কৃষিতে। কৃষিতে যন্ত্র প্রবেশের পর সিংহভাগ কাজই হয় যন্ত্রে। গরুর হাল চাষ উঠেই গেছে। মধ্যম কৃষকের ঘরেও আছে পাওয়ার টিলার। যারা এখনও ছোট কৃষক তারা টিলার ভাড়ায় নিয়ে জমি চাষ করে। এতে মধ্যম কৃষকের রোজগার বেড়েছে। ধনী কৃষকের ঘরে ট্রাক্টরও গেছে। চারা রোপণ থেকে কাটাই মাড়াই ধান ভানা এবং বস্তায় ভরানো পর্যন্ত সবই যন্ত্রে। কেবল সেদ্ধ শুকানোর কাজ হয় হাতে। আবাদের ধরন পাল্টে যাচ্ছে। ফসল বহুমুখীকরণ কর্মসূচীতে একই জমিতে একের পর এক ফসল উৎপন্ন হচ্ছে। জমির আইলও পড়ে থাকছে না। সেখানে ফসলের সঙ্গী ফসল হয়ে সবজি উৎপন্ন হচ্ছে। বাঁশের জাংলার মতো জমির ওপরে বিশেষ পদ্ধতিতে দ্বিতল করে বাড়িতি চাষ হচ্ছে। এখন বছরের কোন সময় জমি পাথার হয়ে থাকে না। সারা বছর কোন না কোন আবাদ হচ্ছে। বসে নেই কৃষক। ফুরসত নেই একদ-। আধুনিকায়ন কৃষিতে কাজ জুটেছে এবং কাজ বেড়েছে গ্রামীণ নারীর। প্রতিযোগিতায় পুরুষের সমান্তরাল এগিয়ে যাচ্ছে নারী। মঙ্গার দৃশ্য এখন ছবি হয়ে জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে খাদ্য উদ্বৃত্ত হয়ে চাল সবজি মাছ শুঁটকি রফতানি শুরু হয়েছে। কৃষির এমন অগ্রগতির পাশাপাশি কৃষি বহির্ভূত ক্ষুদ্র শিল্প কুটির শিল্প দোকানের ব্যবসাসহ নানা ধরনের ব্যবসা বেড়েছে। গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে যান্ত্রিক যানবাহন বেড়ে যাওয়ায় সড়ক জংশন, সড়ক মোড় ও উন্নত এলাকায় ব্যবসা বাণিজ্য হড়ে উঠেছে। যেখানে নিত্যদিন ভ্রাম্যমাণ চায়ের দোকান বসছে। গড়ে উঠেছে সুদৃশ্য আধুনিক দোকানপাট। যেখানে প্রায় সকল পণ্যই মেলে। একটা সময় ঈদ মৌসুমে গ্রামের লোকজন ঈদের কেনাকাটায় শহরে যেত। এখন উপজেলা পর্যায়ের মার্কেটে তার প্রায় সবই মেলে। এইসব মার্কেটে শহরে যা পাওয়া তার সবই মেলে। উপজেলাগুলোর শো রুম ও উন্নত মার্কেট দেখে মনে হয় মিনি শহর। গ্রামে নতুন নতুন কর্ম সংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার গড়ে ওঠায় বিদেশ যোগাযোগ দ্রুততর ও সহজ হওয়ায় অর্থনীতির গতিপথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। যেমন উত্তরের চলনবিল এলাকায় শুঁটকি ব্যবসা শুরু হয়ে তা রফতানির পণ্য হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের প্রতিটি এলাকায় কোন না কোন সবজি রফতানি হচ্ছে। গ্রামে মিনি ডেইরি ফার্ম গড়ে উঠেছে। নারী সেলাই মেশিন কিনে পোশাক বানিয়ে বিক্রি ও সরবরাহ করছে। এমন অনেক কাজের ক্ষেত্র তৈরি হওয়ায় অর্থনীতির চাকা দ্রুত সচল হয়ে চাঙ্গা হচ্ছে। পুষ্টি চাহিদা মোকাবেলায় গাইয়ের দুধের জন্য বেশিরভাগ গ্রামে ডেইরি ফার্মের আদলে মিনি ডেইরি ফার্ম স্থাপিত হয়েছে। এই ফার্মের গাভীর দুধ নিজেদের চাহিদা পূরণের পর বাড়তি দুধ বাজারে বিক্রি করে গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এ ছাড়াও উত্তরাঞ্চলের প্রতিটি এলাকায় সবজি উৎপাদনে বড় ধরনের বিপ্লব ঘটেছে। প্রায় সকল সবজি রফতানির তালিকায় স্থান পেয়েছে। প্রতিদিন সকালে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বড় ব্যসায়ীরা বগুড়া নওগাঁ রংপুর রাজশাহী থেকে ট্রাকের পর ট্রাকে সবজি কিনে নিয়ে যাচ্ছে। বড় একটি অংশ রফতানি হচ্ছে আমেরিকা ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশে। মাছ রফতানি শুরু হয়েছে। বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রা। গ্রামীণ অর্থনীতি দিনে দিনে চাঙ্গা হয়ে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। সূত্র জানায়, প্রতি বছর ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ হারে অতি দ্রারিদ্র্য কমছে। এই হার আরও বাড়িয়ে জাতিসংঘ ঘোষিত সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের (এসডিজি) শর্ত পূরণে নির্ধারিত সময়ের আগে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনতে সরকার সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান পরিবর্তনের চিত্র মেলে উত্তরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে। বগুড়া জেলার নদী তীরবর্তী এলাকা সারিয়াকান্দির চরেও এখন পাকা সড়ক নির্মিত হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছে গেছে বিদ্যুত ও সোলার প্যানেল। বাঙালী নদী তীরের সোনাতলা এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুত পৌঁছেছে। বিদ্যুত পৌঁছায় সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা এলাকার গ্রামগুলোতে কুটির শিল্পের প্রসার ঘটেছে। নারী এখন ফসলের মাঠে কাজ ও ঘর গেরস্থালি ছাড়াও হাস মুরগি ও গবাদিপশু পালন পালন, মৎস্য চাষ, বনায়নে শ্রম শক্তি বিনিয়োগ করেছে।
×