ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোজাম্মেল হক নিয়োগী

নতুন বছরের আলো

প্রকাশিত: ০৬:০২, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬

নতুন বছরের আলো

অভির দুদিন ধরে জ্বর। প্রচ- জ্বর। সে বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। মা-বাবার চিন্তা হচ্ছে। ওষুধেও জ্বর কমছে না। তৃতীয় দিনে জ্বর সামান্য কমেছে। অভি বিছানা থেকে একা একা উঠতে পারছে। তবে শরীর দুর্বল। সকালে মা মুখে খাবার তুলে দেয়। অভি বলে, ‘সব তিতা লাগে। খাব না।’ মা বলে, ‘জ্বর হলে এমন হয়। খাও। না খেলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে।’ ‘খেতে ইচ্ছে করছে না।’ ‘অসুখ হলে জোর করে খেতে হয়। ইচ্ছে না করলেও খেতে হয়।’ খাওয়া শেষ করে অভি বলে, মা তুমি আমার পাশে বসে থাক। কোথাও যাবে না। মা হাসে। বলে, পাগল ছেলে আমার। এদিকে সারা দুনিয়ার কাজ পড়ে আছে। উঠানে ধান। ঘরে ধান। এসব সামলাতে হবে। তোমার ফুফুরা আসবে, পিঠা বানাতে হবে। মুড়ি ভাজতে হবে। তোমার পাশে বসে থাকলে চলবে? অভি মন খারাপ করে শুয়ে থাকে। মা চলে যায় কাজে। একটু পরেই জানালা দিয়ে উঁকি দেয় তিনা, রনি আর জনি। অভি ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোরা কই যাস? জনি বলল, স্কুলে যাই। তুই যাবি না? অভি বলে, না রে, আমার জ্বর। যাব না। তিনা বলে, যাবে না মানে? আজকে বই দেবে জানিস না? নতুন ক্লাসের নতুন বই। নতুন বছরের প্রথম দিনে বই। আর তুই যাবি না? অভির পাশে শুয়েছিল বিড়াল। অভি বিড়ালটিকে ডাকে ‘তুলনি’। অভি বিছানা থেকে লাফ দিয়ে ওঠে। পাশের বিড়ালটিও লাফিয়ে ওঠে বলে, মিউ, মিউ। অভি তৈরি হয়ে যায়। উঠানে নামতেই মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাও? স্কুলে। আজকে বই দেবে। উঠানের একপাশে রোদে বসে বাবা পিঠা খাচ্ছিল। রোদে বসে পিঠা খেতে খুব মজা। মুখ ফিরিয়ে বাবা বলে, জ্বর নিয়ে স্কুলে যাবি? অভি বলে, কোথায় জ্বর? কপালে হাত দিয়ে দেখ। সে বাবার কাছে গিয়ে বাবার হাতটি তার কপালে লাগিয়ে বলে, দেখো জ্বর আছে কিনা। বাবা বুঝতে পেরেছে সে বই আনতে স্কুলে যাচ্ছে। জ্বর থাকলেও যাবে। ফিরানো সম্ভব না। অভি আবার জিজ্ঞেস করে, কই জ্বর আছে? বাবা হাসে। মাও হাসে। তারা বুঝতে পারছে নতুন বইয়ের আনন্দে জ্বর কমে গেছে। তাই অভিকে আর বাধা না দিয়ে বলে, আচ্ছা ঠিক আছে যাও। তবে বই নিয়েই তাড়াতাড়ি চলে আসবে। এদিকে তিনা, জনি আর রনি বাইরে থেকে ডাকছে। অভি তাড়াতাড়ি আয়। তাড়াতাড়ি আয়। মেলায় যাওয়ার চেয়েও বেশি আনন্দ। অভি দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে ওদের সঙ্গে স্কুলে যায়। সঙ্গে তুলনিও লাফাচ্ছে। রনি বলল, দেখ তুলনিও লাফাচ্ছে। মনে হয় ও পড়বে। তুলনি রনির কথা শুনে বলে, মিউ। বাড়ির জাম গাছের ডালে একটি টিয়া ছিল। সেটিও উড়তে উড়তে অভিদের কাছে এসে বলে, ট্যাঁও। ট্যাঁও। ট্যাঁও। ওরা হাসে। অর্জন বলে, তুমিও নতুন বই পড়বে? টিয়া বলে, ট্যাঁও, ট্যাঁও, ট্যাঁও। ওরা স্কুলের মাঠে যায়। তিনার কাঁধে বসে আছে টিয়ে। অভির পাশে তুলনি। রনি আর জনি অন্য ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে মাঠে খেলা শুরু করে। একটু পরে কালাম স্যার সবাইকে ডেকে বললেন, শুনো ছেলে-মেয়েরা, হেড স্যার আর চেয়ারম্যান না এলে বই দেয়া যাবে না। আজকে হয়ত বই নাও পেতে পার। ছাত্রছাত্রীরা বলল, হবে না স্যার। হবে না স্যার। আজকেই বই চাই। কালাম স্যার বললেন, হেড স্যারের একটি জুতো গত রাতে চোর নিয়ে গেছে। ওনার ছেলেকে বাজারে পাঠিয়েছেন জুতো কিনতে। ছেলে কখন আসে সেটাই বড় প্রশ্ন। জুতোর দুরবস্থার কথা শুনে ছাত্রছাত্রীরা হাসতে শুরু করে। এই সময় পাশে দাঁড়ানো আফরোজা আপা ধমক দিয়ে বললেন, চুপ। একদম হাসবে না। এটা হাসির কথা নয়। কালাম স্যার আবার বললেন, চেয়ারম্যান সাহেবের গত রাতে একটা দাঁত পড়ে গেছে। অন্য দাঁতে ব্যথা। এজন্য আসতে পারবেন না। ছাত্রছাত্রীরা আবার হাসতে শুরু করে। আফরোজা আপা আবার ধমক দিয়ে বলেন, চুপ। একদম চুপ। তোমরা মাঠে গিয়ে খেলতে থাক। হেড স্যার এলেই বই দেয়া হবে। না এলে দেয়া হবে না। ছেলেমেয়েরা মাঠে খেলতে শুরু করে। সবার মনে আনন্দ থাকলেও হঠাৎ আনন্দটা মাটি হয়ে যায়। আজকে নতুন বছরের প্রথম দিনে বই না পেলে বছরটাই মাটি। কয়েকজন মন খারাপ করে রোদ পোহায়। শীতের রোদ বড় মিষ্টি। অভির খুব মন খারাপ। সে জ্বর নিয়ে এসেছে বই নিতে অথচ যদি বই না নিয়ে গেলে কেমন হয়? এক ঘণ্টা পরেই একটা মোটরসাইকেলর শব্দ শোনা যায়। ছেলে-মেয়েরা দেখে সত্যি সত্যি উপজেলা শিক্ষা অফিসার হেডস্যারকে পেছনে বসিয়ে আসছেন। তাঁদের দুজনকে দেখে ছাত্রছাত্রীরা চিৎকার করে উঠল। স্যার আসছেন। স্যার আসছেন। একটু পরে চেয়ারম্যানও হাজির। মুখটা ফুলে রয়েছে, দাঁতে ব্যথার কারণে। সব ছাত্রছাত্রীর নজর হেড স্যারের জুতোর দিকে। নতুন জুতো না পুরাতন কোন জুতো তা দেখার কৌতূহল কেউ থামাতে পারেনি। জুতো নতুনই। হেড স্যার বললেন, তোমরা লাইনে দাঁড়িয়ে যাও। আমার জুতো সংক্রান্ত সমস্যার জন্য দেরি হয়ে গেছে, আমি দুঃখিত। তারপর জুতো কিনতে গিয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসারকেও সঙ্গে নিয়ে এলাম। কি, তোমরা খুশি না? ছেলে-মেয়েরা সবাই খুশিতে চিৎকার বলল, জি স্যার,। টিও স্যার বক্তৃতা দিলেন। চেয়ারম্যান সাহেব মুখ খুলতে পারলেন না। দাঁতে ব্যথা। তিনি বসে রইলেন। প্রত্যেককে বই দেয়া হলো। মাঠজুড়ে ছাত্রছাত্রীরা আনন্দে লাফাতে লাগল। নতুন বই। আহা! নতুন বইয়ের ঘ্রাণ, জুড়িয়ে যায় প্রাণ। তিনা, রনি, জনি আর অভি বাড়ির দিকে ছুটছে। টিয়া পাখিটিও উড়ছে। তার মনেও আনন্দ। সে ট্যাঁও ট্যাঁও ট্যাঁও আনন্দ প্রকাশ করছে। তুলনিও মিউ মিউ মিউ করে আনন্দ করছে আর লাফাচ্ছে। নতুন বইয়ের আনন্দে অভির জ্বরও সেরে গেছে। নতুন বছরে প্রথম দিনে নতুন বই পেয়ে শিশুদের মনের আনন্দের জোয়ার যেন সারা গ্রাম ছাপিয়ে গেল।
×