জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে শুয়ে আছে জয়পুরহাটের ১৫ বছরের স্কুলছাত্রী শামীমা। মাথাজুড়ে ব্যান্ডেজ, বাঁ চোখে কালো গভীর দাগ আর ডান হাতে চলছে স্যালাইন। টানা পাঁচ দিন মেয়েটির জ্ঞান নেই। ঘোরের মধ্যে কোন কোন সময় ডেকে উঠছে ‘আম্মা’ ‘আম্মা’ বলে। ২০৪ নং শিশু ওয়ার্ডে তার চিকিৎসা শুরু হলেও এখন তার উন্নত চিকিৎসা ও নিরিবিলি পরিবেশ নিশ্চিত করতে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। সঙ্গে আছেন শামীমার মা। গভীর শোকে আচ্ছন্ন মহিলা মেয়ের পাশে না থাকতে পারলেও পাটি পেতে বসে আছেন আইসিইউর সামনের
মেঝেতে। নামাজ পড়ে দোয়া করছেন মেয়ে যেন সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে আবার মায়ের কোলে ফিরে আসে। গত ২৩ ডিসেম্বর রাতে নিজ বাড়িতে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হয় সে। পরিবারের ধারণা, তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে কে বা কারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তা জানে না পরিবার।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের কর্তব্যরত চিকিৎসক (নিউরোসার্জন) অসিত চন্দ্র সরকার জনকণ্ঠকে বলেন, স্কুলছাত্রীর মাথায় শক্ত কোন কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। এছাড়া তার মুখ ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখমের চিহ্ন পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যেই শামীমার মাথার পেছনে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। তবে সে এখনও শঙ্কামুক্ত নয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পাঁচ সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ড বসে ২৮ ডিসেম্বর দুপুরে। মেডিক্যাল বোর্ডে শামীমার উন্নত চিকিৎসা ও তাকে দ্রুত সুস্থ করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
শামীমাকে ধর্ষণ করার কোন প্রমাণ মিলেছে কি-না জানতে চাওয়া হলে চিকিৎসক অসিত চন্দ্র সরকার বলেন, ‘এখনও রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) এই বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্নভাবে খতিয়ে দেখছে।’
এদিকে গত ২৬ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে শামীমাকে দেখতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে যান মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। তার খোঁজখবর নিয়ে তিনি বলেন, ‘মানবাধিকার সুরক্ষায় আমরা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছি না, ব্যর্থ হচ্ছি। মেয়েটির সঙ্গে যা হয়েছে, নিঃসন্দেহে ন্যক্কারজনক ঘটনা। এতে তার মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। তদন্তের নামে কালক্ষেপণ করা চলবে না। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। কাজী রিয়াজুল হক আরও বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বেই ২০১৬ সালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের সহিংসতা রোধে সামাজিক চাপ সৃষ্টি দরকার।’
এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কালাই থানার পরিদর্শক বিশ্বজিৎ বর্মণের সঙ্গে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দেখা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘এ ঘটনায় এখন কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। আমরা প্রাণপণে মূল অপরাধীকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।’
সেদিন রাতের মর্মান্তিক ঘটনার পর শামীমার মা তার মেয়েকে প্রথম দেখেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চতুর্থ তলায় আইসিইউয়ের সামনে পাটি পেতে বসে আছেন তিনি। সেদিন রাতের ঘটনা বলতে গিয়ে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল তার। তিনি বলেন, ‘রাতে একাই ঘুমাত শামীমা। পাশের ঘরে আমি আর ওর বাবা থাকি। সঙ্গে আমার ছোট দুই ছেলেও। শুক্রবার ভোরে ফজরের নামাজ পড়তে উঠে দেখি শামীমার ঘরের দরজা পেছন থেকে লাগানো। প্রথমে দুই-তিনবার ডাক দেই। তারপর উত্তর না পেয়ে দরজার হুক খুলে ভিতরে গিয়ে লাইট জ্বেলে দেখি আমার মেয়ে উল্টো হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। ওর পুরো মুখে রক্ত মাখা। মেয়ের অবস্থা দেখে আমি চিৎকার করতে থাকি।’
ঘটনার পরপরই বাড়ির প্রতিবেশীদের সাহায্য নিয়ে শামীমার মা পুলিশে খবর দেন। তারপর দ্রত চিকিৎসার জন্য বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শামীমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। অবস্থার কোন উন্নতি না হওয়ায় সেখানকার চিকিৎসকদের পরামর্শে গত শনিবার রাতে তাকে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেও অবস্থার উন্নতি না হলে গত ২৫ ডিসেম্বর রাতে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
শামীমার ফুফা মোহাম্মদ দুলাল জনকণ্ঠকে বলেন, ‘শামীমা বিজ্ঞান বিভাগের খুবই মেধাবী একজন ছাত্রী। এবার সে দশম শ্রেণীতে উঠবে। ওর বাবা একজন কৃষক হওয়া সত্ত্বেও মেয়ের পড়ালেখাকে সবসময় প্রাধান্য দেয়। হঠাৎ করে এমন একটি ঘটনা কিভাবে ঘটে গেল তা আমরা বুঝতেও পারিনি। এখনও বুঝতে পারছি না। আমরা চাই দ্রুত যেন মূল অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয় এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয়। ’
শীর্ষ সংবাদ: