ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হাতিরঝিলে ওয়াটার ট্যাক্সি

ঝিলের জলে নতুন ঢেউ ১২ মিনিটে গুলশান, অর্ধেক সময়ে বাড্ডা

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬

ঝিলের জলে নতুন ঢেউ ১২ মিনিটে গুলশান, অর্ধেক সময়ে বাড্ডা

মোরসালিন মিজান ॥ বিপুলায়তন ঢাকা। তবু দমবন্ধ লাগে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়া যায় না। তেমন জায়গার খুব অভাব। এ অবস্থায় বড় পাওয়াটি সাজানো গোছানো হাতিরঝিল। এক সময়ের পরিত্যক্তপ্রায় জলা-জঙ্গল বর্তমানে ঢাকার ফুসফুস। ফুসফুস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যান্ত্রিক ঢাকার দুর্ভোগ বহুবিধ যন্ত্রণা ভুলিয়ে সবুজ সতেজ অনুভূতি দিচ্ছে হাতিরঝিল। বিশেষ প্রকল্পের আওতায় এর স্থলভাগে প্রচুর কাজ হয়েছে। জলভাগে শুধু ছিল জল। স্বচ্ছ সুন্দর শান্ত জলে এখন চলছে ওয়াটার ট্যাক্সি। হাতিরঝিলে বেড়াতে আসা মানুষের বাহনটি নিয়ে দারুণ কৌতূহল। চড়ছেন। উপভোগ করছেন। যাদের নিত্য আসা যাওয়া, বিশেষ ফল পাচ্ছেন তারাও। ওয়াটার ট্যাক্সি চালু হওয়ার পর বাড্ডা, গুলশান, রামপুরা, খিলগাঁওসহ নগরীর পূর্বাংশের সঙ্গে কারওয়ান বাজার মগবাজার দিলু রোড ইস্কাটন বাংলামোটর এবং তেজগাঁও এলাকার যাতায়াত যথেষ্ট সহজ হয়েছে। এপ্রিল নাগাদ বাড়ানো হবে ট্যাক্সির সংখ্যা। আর তা হলে রাজধানীর একটি বড় অংশের লোকজনের যাতায়াত ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে বলে আশা করছেন হাতিরঝিল প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। গত শুক্রবার বিজয়ের বিশেষ দিবসে হাতিরঝিলে ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। এর পর থেকে নিয়মিতভাবে চলছে। প্রাথমিক শুরু করা হয়েছে চারটি ট্যাক্সি দিয়ে। ওয়াটার ট্যাক্সিগুলোর কাঠামো তৈরি করা হয়েছে চট্টগ্রামের একটি কারখানায়। গত ৫ ডিসেম্বর ঢাকায় আনা চারটি ট্যাক্সি পানিতে নামানো হয়। বর্তমানে এফডিসি সংলগ্ন ঘাট থেকে গুলশানে যাওয়া আসার জন্য রয়েছে দুটি ট্যাক্সি। অন্য দুটি মেরুল বাড্ডা ঘাট পর্যন্ত আসা যাওয়া করছে। একটি ট্যাক্সি আসছে। যাচ্ছে অন্যটি। এভাবে নিত্য আসা যাওয়া। ঝিলের জলে নতুন ঢেউ। পাড়ে এসে আছড়ে পড়ছে। এফডিসি সংলগ্ন পাড় ধরে সামান্য হাঁটতেই দেখা গেল কৌতূহলী মানুষের ভিড়। টিকেট কাউন্টারের সামনে নাতিদীর্ঘ লাইন। ভেতরে বসেছিলেন সুহেল রানা। তিনি জানালেন, এখান থেকে গুলশানে যাওয়ার টিকেটের মূল্য ৩০ টাকা। মেরুল বাড্ডায় যেতে লাগবে তারও কম। ২৫ টাকা। টিকিট কাউন্টার থেকে সরাসরি রাস্তা আছে। সেটি ধরে হেঁটে গেলেই টার্মিনাল। টার্মিনালে যাওয়ার পথে দুই এক মিনিট দেড়ি করছিলেন প্রায় সবাই। কারণ পথটি বেশ নান্দনিক করা হয়েছে। টার্মিনালটিও সুন্দর। পরিচ্ছন্ন। কয়েক মিনিট দাঁড়াতেই তীরে নোঙর করল গুলশান থেকে ছেড়ে আসা একটি ওয়াটার ট্যক্সি। যাত্রীরা লাইনে দাঁড়িয়ে ওঠছিলেন। ততক্ষণে পাশে জায়গা করে নিয়েছে বাড্ডা থেকে ছেড়ে আসা আরেকটি ট্যাক্সি। দুটোরই টিকেট কাটা ছিল। প্রথমে ওঠা হলো গুলশানের ওয়াটার ট্যাক্সিতে। মূল কাঠামোর রং লাল। ভেতরে নীল রঙের ৩০টি আসন। মহিলা শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য আসন সংরক্ষিত। কেউ কেউ জলপথ ভয় পান। তাদের জন্য রাখা আছে লাইফ জ্যাকেট। সব যাত্রী ওঠার পর ২টা ৩০ মিনিটে চলতে শুরু করে বোট। সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীরা বাইরের দিকে চোখ রাখেন। না, জানালা দিয়ে নয়। ওয়াটার ট্যাক্সির দুই পাশ খোলা। বাইরের দৃশ্য পরিষ্কার দেখা যায়। উভয়পাশেই কংক্রিটের শহর। সুউচ্চ ভবন। বার বার দেখা। তবু এই ভিউটা নতুন। সবাই কৌতূহল নিয়ে দেখছিলেন। ইঞ্জিনের গতি খুব বেশি নয়। আবার কমও নয়। শান্ত ঝিলের জলে ঢেউ তুলে এগিয়ে যাচ্ছিল ওয়াটার ট্যাক্সি। সামনে কিছুক্ষণ পরপরই দৃশ্যমান হচ্ছিল বিভিন্ন আকার আকৃতির সেতু। সেতুর নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় বেশ একটা অনুভূতি হয়। যাত্রীরা সবাই উপরের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন। দেখছিলেন। পাশে বসা যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, বড় অংশটি বেড়াতে এসেছে। কয়েকজন বাবা পাওয়া গেল যারা মূলত বাচ্চার আগ্রহে ওয়াটার ট্যাক্সির যাত্রী হয়েছেন। বাচ্চাদের একজন মোবাশ্বিরা। বনানী বিদ্যা নিকেতনের ক্ষুদে শিক্ষার্থী একটিবারের জন্য নিজের আসনে বসছিল না। দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক উঁকি দিচ্ছিল। হাতের কাছে জল। সে দেখছিল। ঢেউ ভেঙ্গে সামনে এগিয় যাওয়া দেখছিল অবাক হয়ে। কথা প্রসঙ্গে বললো, গতকাল ইয়ার ফাইনাল শেষ হয়েছে। তাই বেড়াতে এসেছি। খুব ভাল লাগছে। নানা বাড়িতে গিয়ে সে নৌকো চড়েছে জানিয়ে বলল ওয়াটার টেক্সি বেশি ভাল! গুলশানে যাদের প্রতিদিনের কাজ, তারা অনেকেই ছিলেন ট্যাক্সিতে। তাদের একজন এস এম জামাল। গুলশান ১ নম্বরে অফিস। বললেন, যানজটের কারণে আর পারছিলাম না। আজ তাই কাওরান বাজার থেকে এদিকে চলে এসেছি। এখন কোন যানজট নেই। লাল বাতি জ্বলছে না কোথাও। মাত্র কয়েক মিনিটে অফিসে পৌঁছে যাব। যে কোন বিবেচনায় এটি ‘বেটার’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। তার সঙ্গে কথা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই দেখা গেল, নিকেতন পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে বোট। আরও দু’ একটি ব্রিজের নিচ দিয়ে যাওয়া হলো। তার পর গুলশান গুদারা ঘাট। নোঙর করতেই সবাই ঘড়ি দেখলেন। ২টা ৪২ মিনিট। তার মানে ১২ মিনিটে গুলশান! আরেকজন বললেন, না, ১৪ মিনিট লাগল। ওয়াটার ট্যক্সির চালক এ পর্যায়ে আলোচনায় যোগ দিলেন। জানালেন, ১২ থেকে ১৪ মিনিটের বেশি লাগে না। টেক্সি থেকে নামার পর দেখা যায়, এই ঘাটটি অতো পরিচ্ছন্ন নয়। ধারে কাছেই আবর্জনার ভাগাড়। এদিকে আরও একটু নজর দেয়ার পরামর্শ দিয়ে নেমে যান যাত্রীরা। পাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়সী মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। পরে জানা গেল, এরা সবাই যাত্রী নন। অনেকেই কৌতূহল নিয়ে ওয়াটার ট্যাক্সি দেখছিলেন। বাকিরা টিকেট হাতে নিয়ে বোটে উঠতে থাকেন। এই ওঠানামার যেটুকু সময়, তার পরই এফডিসি ঘাটের দিকে যাত্রা। এবার সময় লাগল মাত্র ১৩ মিনিট! এফডিসি সংলগ্ন ঘাট থেকে বাড্ডায় যাওয়া এবং আসার অভিজ্ঞতাও প্রায় অভিন্ন। একই রকম দেখতে ট্যাক্সি। সমানসংখ্যক আসন। এফডিসি ঘাট থেকে বাড্ডা ঘাটে পৌঁছতে লাগল ৮ মিনিট। এই বোটে বেড়াতে আসা যাত্রীদের সংখ্যা কম। কথা বলে বোঝা গেল, বেশিরভাগই বাড্ডা ও আশপাশের বাসিন্দা। নিত্য যাতায়াতে ওয়াটার ট্যাক্সি ব্যবহার করছেন তারা। আমিরুল নামের এক যাত্রী বললেন, রামপুরা থেকে কাওয়ানবাজার যেতে বেশ ভুগতে হয়েছে এতদিন। কোন রিক্সা চলাচল করে না। বাস চলে। তবে পর্যাপ্ত নয়। তাই এই সার্ভিস খুব কাজে এসেছে বলে জানান তিনি। বেসরকারী একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন আলী আশরাফ। ওয়াটার ট্যাক্সি বাড়ানোর পরামর্শ দিলেন দেন। বলেন, ঘাটে কিছু সময় নষ্ট হয়। এটা কমাতে পারলে আরও কার্যকর হবে উদ্যোগটি। ওয়াটার ট্যাক্সি পরিচালনার কাজটি ২০ বছরের জন্য পেয়েছে করিম গ্রুপ। এই গ্রুপের পরিচালক লেফট্যানেন্ট (অব) এস এম শাহ আলম ওয়াটার ট্যাক্সি সেবার দায়িত্বে আছেন। জনকণ্ঠকে তিনি জানান, বর্তমানে প্রতিদিন চারটি ট্যাক্সিতে যাতায়াত করেছেন প্রায় ৩ হাজার যাত্রী। যাত্রীদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে এপ্রিলের মধ্যে আরও ৪ থেকে ৬টি ওয়াটার ট্যাক্সি চালু করা হবে। বর্তমানের তুলনায় দ্বিগুণ যাত্রী পরিবহন করতে চাই আমরা। হাতিরঝিলে বেড়াতে আসা মানুষের সময় আরও আনন্দঘন করতে লাক্সারি বোট যোগ করা হবে বলেও জানান তিনি। বিদেশ থেকে আনা হবে এই বোট। এতে চমৎকার রেস্তরাঁ থাকবে। আছে আরও কিছু চিন্তা। বেশ আগে ২০০৭ সালে শুরু হয় হাতিরঝিল প্রকল্পের কাজ। ৩০২ একর জমির ওপর চলে সংস্কারকাজ। ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর হাতিরঝিলে চালু করা হয় চক্রাকার বাস সার্ভিস। ভাবা হচ্ছিল জলযানের কথাও। বিজয়ের বিশেষ দিবসে শুক্রবার বাস্তবায়ন করা হয় নতুন এই পরিকল্পনা। হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রকল্পের অধীনে ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিস সুবিধা গুলশান ও বারিধারা পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে।
×