ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

মঙ্গল শোভাযাত্রার বিশ্ব স্বীকৃতির সুসংবাদ

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ১১ ডিসেম্বর ২০১৬

মঙ্গল শোভাযাত্রার বিশ্ব স্বীকৃতির সুসংবাদ

ডিসেম্বর আমাদের গর্বের, বিজয়ের মাস। যুদ্ধ করে শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয় অর্জনের আনন্দের সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা হয় না। সে এক অন্যরকম অভূতপূর্ব অনুভূতি। তাই প্রতিবছর ডিসেম্বর মাস শুরু হলেই বাঙালীর মনে, বিশেষ করে প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার মনে আলাদা একটা রোমাঞ্চকর জাগরণ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তার সঙ্গে নতুন কিছু যোগ হলে সে অনুভূতির মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়। মশহুর কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দণ্ড পর্যায়ক্রমে কার্যকর হওয়ার ঘটনা গত দুই বিজয়ের মাসে আমাদের নতুন করে জাগ্রত করেছে, প্রত্যাশা জাগিয়েছে এবং আলোর পথ দেখিয়েছে। মিথ্যার বিরুদ্ধে শুভ শক্তির জয়কে আরও অনিবার্যের পথে নিয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস মিলেছে। এ বছর বিজয়ের মাস শুরু হতেই আরেকটি সংবাদ এবার আমাদের অনুভূতির সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। পহেলা বৈশাখ উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে গত ৩০ নবেম্বর। বাঙালী সংস্কৃতির আনুষ্ঠানিক বিশ্ব স্বীকৃতি। সমগ্র জাতির জন্য বিশাল অর্জন ও গর্বের বিষয়। আমাদের যাত্রাপথে আরেকটি গৌরবোজ্জ্বল মাইলফলক স্থাপিত হলো। আমাদের জাতীয় শক্তির যত উৎসের জায়গা রয়েছে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হচ্ছে বাঙালী সংস্কৃতি। ইদানীং তার বৃহত্তম বহির্প্রকাশ পহেলা বৈশাখে নববর্ষ পালনের উৎসব। অপশক্তি গ্রেনেড-বোমা মেরে এর বিস্তৃতি ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। ১৯৮৯ সালে সামরিক স্বৈরশাসকপ্রসূত অপশক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে শুরু হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন পহেলা বৈশাখের সবচাইতে বড় আকর্ষণ। প্রতিবছর দেশে বিরাজমান পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির জাগরণের প্রতিফলন হয় চারুকলা ইনস্টিটিউট আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রায়। অঢেল বর্ণিল সাজে তার অপ্রতিরোধ্য পথ প্রদক্ষিণই বলে দেয় কোন অশুভ শক্তির স্থান বাংলাদেশে হবে না। বাঙালী সংস্কৃতির অপরাজেয় শক্তির প্রমাণ আমরা বিগত সময়ের সঙ্কটকালে পেয়েছি। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পাওয়ার মূল অবলম্বন হিসেবে কাজ করেছে বাঙালী সংস্কৃতি, যার ওপর দাঁড়িয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছর সংগ্রাম করেছি এবং চূড়ান্তভাবে একাত্তরে পাকিস্তানকে করেছি পরাজিত। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাঙালীদের দাবিয়ে রাখার আত্মঘাতী পরিকল্পনার পথে বাঙালী সংস্কৃতির বিস্তার, ব্যাপকতা ও তার শক্তিকে শুরু থেকেই সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করে। তাই যাত্রার প্রারম্ভেই তারা আমাদের সংস্কৃতির বাহন বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণ চালায়। প্রথম উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ায় তারা পরোক্ষ এবং ভিন্ন পথ অবলম্বন করে। বাংলা ভাষার প্রকাশ ও প্রয়োগে রোমান হরফ বা অক্ষর চালু করার চেষ্টা করে। সে উদ্যোগও বাঙালী রুখে দেয়। তারপর আসে আরও বড় আঘাত। তারা জাতির প্রাণভোমরা, শক্তির আধার ও ভা-ার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বাঙালীদের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলার অপচেষ্টা চালায়। রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী পালনে বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু তাদের সব অপচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যায়। তবে ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায় বাঙালীর মনে ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে। বাঙালী সংস্কৃতিপ্রসূত সবকিছুকে পাকিস্তানী শাসকরা আখ্যায়িত করতে থাকে বেদাত ও বিধর্মীদের কাজ হিসেবে। বাঙালীরা বুঝতে পারে রাজনৈতিক মুক্তি ছাড়া পাকিস্তানী শাসকদের দমননীতি থেকে কোন দিন রেহাই পাওয়া যাবে না। সুতরাং অনিবার্য হয়ে ওঠে রাজনৈতিক সংগ্রাম। বাঙালী জাতিকে চিরদিনের জন্য দাবিয়ে রাখার সব চক্রান্তের বিরুদ্ধে এক সময়ে রাজনীতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৬ সালে তিনি বাঙালী জাতির মুক্তির সনদ ছয় দফা প্রণয়ন করেন। পাকিস্তানের লৌহমানব ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান গর্জে ওঠেন। বলেন, অস্ত্রের ভাষায় মুজিবের ছয় দফার জবাব দেয়া হবে। মিথ্যা রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দিয়ে শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে ঝুলাবার চেষ্টা করেন আইয়ুব খান। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকরা এবারও বুঝতে ভুল করেন। তারা বুঝতে ব্যর্থ হন যে, ইতোপূর্বে চেষ্টা করেও তারা বাঙালীর জাতীয় শক্তির মূল আধার বাঙালী সংস্কৃতিকে দমন করতে পারেনি, আর তার একেবারে শেকড় থেকে আবির্ভূত হওয়া শেখ মুজিবকে কোন পথেই দাবিয়ে রাখতে পারবেন না। তারা আরও বুঝতে ব্যর্থ হলেন, যে জাতির প্রেরণার উৎস রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ এবং তরুণ কবি সুকান্ত, তাদেরকে অন্যায়ভাবে দাবিয়ে রাখা যাবে না। সুতরাং তাদের অপচেষ্টার ফল যা হওয়ার তাই হলো। ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিব জেল থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু উপাধি পেলেন এবং ঘোষণা করলেন, এখন থেকে এ অঞ্চলের নাম হবে বাংলাদেশ এবং সেøাগান হবে জয় বাংলা। বাঙালীর হৃদয়ের স্পন্দনের কথাই তিনি শোনালেন। তারপর জয় বাংলা সেøাগানের বিশাল শক্তি আমরা দেখেছি সত্তরের নির্বাচনে, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনে এবং মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে। যুদ্ধক্ষেত্রে যে কোন অস্ত্রের চাইতে শক্তিশালী হয়ে ওঠে জয় বাংলা সেøাগান। শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, সে সময় বন্ধুপ্রতিম বিশ্বের সব মানুষের কাছে আমাদের পরিচয়ের অন্যতম বাহন হয়ে ওঠে জয় বাংলা। আমরা পরিচিতি পেয়েছি জয় বাংলার মানুষ হিসেবে। পশ্চিম বাংলা এবং ত্রিপুরায় অনেক হোটেল রেস্টুরেন্টে খাওয়ার পর জয় বাংলার লোকের কাছ থেকে বিল পর্যন্ত নিত না। যুগে যুগে মনীষীরা বলেছেন, অসির চাইতে মসির শক্তি অনেক বেশি। আধুনিক যুগে এখন দেখা যাচ্ছে হার্ড পাওয়ারের চাইতে সফট পাওয়ারের শক্তি অনেক বেশি। পাকিস্তানীরা বাঙালীর সফট পাওয়ারের সঠিক মূল্যায়নে ব্যর্থ হওয়ায় তাদেরকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। ইয়াহিয়া খান তার হার্ড পাওয়ার অর্থাৎ সেনাশক্তির ওপর নির্ভর করে বলেছিলেন, দুটি ভেংচি দিলেই বাঙালীরা সব চুপ হয়ে যাবে। ১৬ ডিসেম্বর শোচনীয় পরাজয়ের পর নিজ দেশের মানুষ ও সেনাবাহিনীর কাছে চরমভাবে অপমানিত হয়ে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার সময় ইয়াহিয়া খান বুঝেছিলেন বাঙালীদেরকে ভেংচি দেখানোর পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে। শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান ইয়াহিয়ার ভেংচি প্রদানের ছবি এঁকে বলেছিলেন, এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে। একটা ছবির পরিণতি পাকিস্তান সেনাবাহিনী একাত্তরের যুদ্ধক্ষেত্রে ভালভাবে টের পেয়েছে। বর্বরতার সকল সীমা লঙ্ঘন করেও নিজেদের তারা রক্ষা করতে পারেনি। ৪৫ বছর পর বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে একটা মর্যাদাশীল রাষ্ট্র, আর পাকিস্তান সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। আমাদের সবচাইতে বড় ট্র্যাজেডি হলো কিছু কুলাঙ্গার, বিশ্বাসঘাতক ও নেমকহারামের জন্ম হয়েছে বাঙালী জাতির ভেতর থেকেই। তারা সব সময়ই অর্থ, বিত্ত, প্রতিপত্তি ও সঙ্কীর্ণ ক্ষমতার লোভে পাকিস্তানীদের মতোই ধর্মের মিথ্যা দোহাই দিয়ে বাঙালী সংস্কৃতির শক্তিকে অবমূল্যায়ন করেছে এবং এখনও করে চলেছে। কিন্তু শেষ বিচারে তারাও যে পাকিস্তানীদের মতোই ব্যর্থ হবে তার কিছু আলামত এখনই দেখা যাচ্ছে। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত, বিশাল শক্তির প্রতীক, জাতীয় পরিচয়ের অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ বাহন, একাত্তরে যে আওয়াজে পাকিস্তানী সেনাদের হৃদকম্পন শুরু হতো; সেই জয় বাংলা সেøাগানকে বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে সেটিকে বিতর্কিত করেন। তাতে জাতির মধ্যে যে বিভাজনের সৃষ্টি হলো, যে সঙ্কট তৈরি হলো, সেখান থেকে আজও অমরা বের হতে পারছি না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাঙালী সংস্কৃতির অবদান এবং সেখান থেকেই জয় বাংলা সেøাগানের উৎপত্তি। তাই জয় বাংলা সেøাগানকে অস্বীকার করা মানে বাংলাদেশকে অস্বীকার করা। দুই সামরিক শাসকের প্রবর্তিত রাজনীতির হাত ধরে বাংলাদেশে আবার ধর্মান্ধ মনমানসিকতার সংস্কৃতি ফিরে আসে, যার থেকে মুক্তি পাওয়াই ছিল আমাদের দীর্ঘ সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মুখ্য উদ্দেশ্য। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেও বাঙালী সংস্কৃতির শক্তির সঙ্গে পেরে ওঠেনি। এগুলো সব জানার পরেও বাংলাদেশে সামরিক শাসকদের রাজনীতি বাঙালী সংস্কৃতিকে পিছে ঠেলে দিয়েছে, অগ্রাহ্য করেছে এবং জয় বাংলা সেøাগানকে প্রত্যাখ্যান ও বিতর্কিত করেছে। সমাজে তাদের সুবিধাভোগীরা পহেলা বৈশাখের উৎসব সম্পর্কে ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করতে সাহস পায়। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াত-বিএনপি সরকারের সময় বিএনপি সমর্থক একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব এবং একটি ইংরেজী দৈনিকের সাবেক সম্পাদক একবার একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে পহেলা বৈশাখ পালন করাকে বেদাত, শরিয়তবিরোধী এবং বিধর্মীদের কাজ বলে মন্তব্য করেন, ঠিক যেমনটি আমরা শুনেছি পাকিস্তানীদের কাছ থেকে। ওই সময়ের একজন প্রভাবশালী সিনিয়র মন্ত্রী, এখন প্রয়াত। প্রসঙ্গক্রমে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোন অবদান নেই। রাজনীতির সাম্প্রদায়িকতন্ত্র একজনের মনের গহিনে প্রবেশ না করলে তার মুখ থেকে এমন কথা বের হতে পারে না। আজকের লেখায় এ কথাগুলো উল্লেখ করছি এ কারণে যে, ৪৫তম বিজয় দিবসকে সামনে রেখে বাংলাদেশের মানুষকে ভাবতে হবে- এত ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে পাকিস্তানী মনোভাবাপন্ন সাম্প্রদায়িক দর্শনের রাজনীতি আর কতদিন চলবে? এ বছরের বিজয় দিবসের আহ্বান হওয়া উচিত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছর সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ঘটনাসমূহ, বঙ্গবন্ধু এবং জয় বাংলা সেøাগান মান্য করেই সবাইকে এদেশে রাজনীতি করতে হবে। অন্যথায় নয়। বিজয়ের মাসের শুরুতে মঙ্গল শোভাযাত্রার বিশ্ব স্বীকৃতি আমাদেরকে যেন সেই অনুপ্রেরণাই দেয়। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক নিউ অরলিনস, আমেরিকা
×