ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এম. নজরুল ইসলাম

শেখ হাসিনা ॥ বাংলাদেশের নবপরিচয়ের রূপকার

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৩১ অক্টোবর ২০১৬

শেখ হাসিনা ॥ বাংলাদেশের  নবপরিচয়ের রূপকার

৬৭ বছর পেরিয়ে আসা দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এমন একটি রাজনৈতিক দল, যে দলের কাছে গণমানুষের আকাক্সক্ষা সবসময় বেশি। জাতীয় সঙ্কটে এই দলটি সবসময় মানুষের পাশে থেকেছে। জনগণকে সংগঠিত করে পথ চলেছে। ৬৭ বছরে অনেক চরাই-উৎড়াই পার হতে হয়েছে দলটিকে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকা আওয়ামী লীগ ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের রাজনীতিতে মুসলিম লীগের কবর রচনায় নেতৃত্ব দিয়েছে। ১৯৬৬ সালে বাঙালীর মুক্তিসনদ ছয় দফা ঘোষণার ভেতর দিয়ে পাকিস্তানের বিদায় ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন বাঙালীর প্রাণের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সেদিনের রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ স্বাধীনতা শব্দটি বাঙালীর প্রাণের শব্দে পরিণত করতে পেরেছিল আওয়ামী লীগ। দেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধÑ বাঙালীর মহত্ত্বর সব অর্জন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই হয়েছে। দেশের মানুষকে নতুন পথের দিশা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। স্বাধীন বাংলাদেশেই এই দলটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার সব অপচেষ্টা হয়েছে। পাকিস্তান আমলের মতোই দলটির নেতাকর্মীদের ওপর জেল-জুলুম চালানো হয়েছে। কিন্তু পথের দিশা হারায়নি আওয়ামী লীগ। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা হাল ধরার পর নতুন করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দলটি। সামরিক শাসনের অবসানে বাংলাদেশে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা নতুন করে প্রবর্তনের আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। আওয়ামী লীগের বর্তমান শাসনামলে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে আলোচিত। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। অমিত সম্ভাবনার বাংলাদেশে সমস্যাও তো কম নয়। কিন্তু রাজনৈতিক প্রজ্ঞা যে একটি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, বাংলাদেশ তার প্রমাণ। যদিও এখনই তৃপ্ত হওয়ার কোন কারণ নেই। যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে তাই সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। গঠনমূলক কর্মসূচী নিয়ে কাজ করতে হবে। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আবাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। এবারের সম্মেলনে দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কাজে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিজ এলাকায় দরিদ্র, গৃহহীন মানুষের তালিকা করতে বলেছেন। সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে দলের নেতাকর্মীদের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, এই গৃহহীন মানুষদের বিনা পয়সায় ঘর তৈরি করে দেয়া হবে। জনগণের সংগঠন হিসেবে এটাকে দলের দায়িত্ব বলে মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। একটি রাজনৈতিক দল কেবল ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করে না, জনকল্যাণও যে তার লক্ষ্য হতে পারে, আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বক্তব্যে সে কথাই উঠে এসেছে। রাজনৈতিক দলের সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টিই তিনি তাঁর নেতাকর্মীদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে জনগণের রায় নিয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে মাত্র পাঁচ বছরে বাংলাদেশ খাদ্যে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করে। দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল থাকে। মূল্যস্ফীতির হার ১.৫৯ শতাংশে নেমে আসে এবং প্রবৃদ্ধির হার ৬.২ শতাংশে উন্নীত হয়। ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা অর্জন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ লাভ, ডি-৮ ও বিমসটেক প্রভৃতি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরাম গঠন এবং এ্যাসোসিয়েশন ফর এশিয়ান পার্লামেন্টারিয়ান ফর পিস (এএপিপি) গঠন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে নতুন মর্যাদার আসনে অভিষিক্ত করে। দারিদ্র্য বিমোচনে নানারকম উদ্ভাবনমূলক কর্মসূচী গ্রহণের ফলে দারিদ্র্য হ্রাসের বার্ষিক গড় হার ০.৫০ থেকে ১.৫০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মানব দারিদ্র্য সূচক ৪১.৬ থেকে ৩২ শতাংশে নেমে এসেছে। মানব উন্নয়ন সূচকে জাতিসংঘের ৫৬ পয়েন্ট অর্জন, সাক্ষরতার হার ৬৬ শতাংশে উন্নীতকরণ, শিক্ষানীতি প্রণয়ন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেশনজট দূরীকরণ ছিল তাঁর শাসনামলে জাতির অগ্রগতির পরিচায়ক। বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতে এ সময়ে অর্জিত হয় বিস্ময়কর সাফল্য। মাত্র পাঁচ বছরে বিদ্যুত উৎপাদন ৪৩০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি ও আহরণ ব্যবস্থায় অগ্রগতি হয়েছে। যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ৬২ হাজার কিলোমিটার কাঁচা-পাকা রাস্তা এবং ১৯ হাজার সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ প্রভৃতির মাধ্যমে একটি নির্ভরযোগ্য ভৌত অবকাঠামোর ভিত্তি রচিত হয়েছে। অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় পাঁচ বছরে জাতীয় আয়ের ১৪.৭ থেকে বেড়ে ১৮ শতাংশে এবং বিনিয়োগের হার ২০ থেকে ২৩.১ শতাংশে উন্নীত হয়। লিখিত বক্তব্যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী উল্লেখ করেছেন, ‘আমাদের গৃহীত উন্নয়ন পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের ফলে গত মেয়াদের পাঁচ বছর এবং এই মেয়াদের প্রথম আড়াই বছরে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিশ্বের সামনে রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে।’ তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণ ছিল এই সরকারের অঙ্গীকার। লক্ষণীয়, ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, সারাদেশে ৫ হাজার ২৭৫টি ডিজিটাল সেন্টার চালু হয়েছে। এছাড়া ৩০০০ ডাকঘরে ডিজিটাল সেবা দেয়া হচ্ছে। এসব সেন্টারের মাধ্যমে প্রতি মাসে ৪০ লাখের বেশি গ্রামীণ মানুষ ২০০ ধরনের ডিজিটাল সেবা পাচ্ছে। গ্রামে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। দেশে বর্তমানে মোবাইল সিমকার্ডের সংখ্যা নাকি ১৩ কোটির ওপর। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬ কোটি ২০ লাখের বেশি। ২০১৭ সালে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। সারাদেশে ২৪৫টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্রে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ওয়াই-ফাইয়ের মাধ্যমে বিনামূল্যে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া শুরু হয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারে এখন ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। থ্রী জি মোবাইল সেবা চালু করা হয়েছে। ফোর-জি অচিরেই শুরু হবে। এ সবই সম্ভব হয়েছে গতিশীল নেতৃত্বের গুণে। সবকিছু উপেক্ষা করে দেশ ও মানুষের কল্যাণচিন্তায় যিনি নিবেদিত তিনিই তো বলতে পারেন, ‘আওয়ামী লীগই আমার শেষ এবং একমাত্র ঠিকানা। সব হারিয়ে আপনাদের নিয়েই আমি বেঁচে আছি, আমার কোন ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া নেই। দেশের কল্যাণই আমার একমাত্র লক্ষ্য। বারবার আমাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর রহমত এবং আপনাদের ভালবাসাই আমাকে দেশবাসীর কাছে ফিরিয়ে এনেছে। আমার পিতা বঙ্গবন্ধু জীবন দিয়ে গেছেন, কিন্তু আপনাদের ভালবাসার অমর্যাদা করেননি। ইনশাল্লাহ জীবন দিয়ে হলেও বাংলার মানুষের বিশ্বাস ও ভালবাসার মর্যাদা রক্ষা করব।’ গণতন্ত্রের মানসকন্যা, জনমানুষের নেত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘সুদূর আগামীর বাংলাদেশ নিয়েই আমাদের সুদীর্ঘ পরিকল্পনা। তাই ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে আধুনিক শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশে পরিণত করতে চাই। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, একমাত্র আওয়ামী লীগই পারবে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিশ্বে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে। জনকল্যাণই সব রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য হওয়া উচিত। কল্যাণব্রতে দীক্ষা নিলে যে কোন রাজনৈতিক দলই যে দেশের উন্নয়নে কাজ করতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সব নেতা ও কর্মী দলীয় প্রধানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জনকল্যাণে ব্রতী হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে ভিয়েনার উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছি। দেশের মানুষকে একমন্ত্রে উজ্জীবিত করে এক লক্ষ্যে একত্রিত করার ক্ষমতা রাখেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য অর্জনের নেতৃত্ব দিতে তাঁর বিকল্প নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন মর্যাদার আসনে। তাঁর নেতৃত্বই পারে আওয়ামী লীগকে আরও গতিশীল করে তুলতে। তিনিই তো বাঙালীর আশার প্রদীপ। বিশ্বে বাংলাদেশের নবপরিচয়ের রূপকার তিনি। লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকার কর্মী লেখক ও সাংবাদিক হধুৎঁষ@মসী.ধঃ
×