ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রুহুল আমিন ভূঁইয়া

উপেক্ষিত প্রবীণ সমাজ

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ২৭ অক্টোবর ২০১৬

উপেক্ষিত প্রবীণ সমাজ

বৃদ্ধাশ্রম আমাদের দেশে এখন নতুন কোন ধারণা নয়। প্রায় এক দশক আগে এ দেশে বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠতে শুরু করে মূলত সমাজ সেবামূলক কাজের অংশ হিসেবে। কিন্তু ধীরে ধীরে এটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক রূপ লাভ করেছে। বর্তমানে ঢাকা শহরে বেশকিছু বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে। সেখানে অর্থের বিনিময়ে বয়স্কদের থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা, বিনোদনসহ আনুষঙ্গিক সব ব্যবস্থা করা হয়। পাশ্চাত্যের অনেক কিছুর সঙ্গে ‘বৃদ্ধনিবাস’ এই ধারণা আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে পরিবারের ভঙ্গুর অবস্থা এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, সেখানে পরিবারের কেউ কারও প্রতি কোন প্রকার দায়িত্ব পালন করে না। এর ফলে বৃদ্ধরা বিশেষভাবে অসহায় হয়ে পড়ে তাদের দেখাশোনা করার লোকের অভাবে। এ কারণে তাদের শেষ বয়সে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করার উদ্দেশ্যে ওল্ড এইজ হোম বা বৃদ্ধাশ্রম গড়ে ওঠে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশেও বৃদ্ধনিবাস গড়ে উঠেছে এবং তা ক্রমবর্ধমান। এই ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধনিবাস গড়ে ওঠা আমাদের সমাজ সম্পর্কে নেতিবাচক সঙ্কেত দিচ্ছে- তা হচ্ছে পিতামাতার সঙ্গে সন্তানের বন্ধনের ক্রমহ্রাসমানতা। যে কোন কারণেই বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠুক না কেন এটা এই বার্তা দিচ্ছে যে, এই সমাজের সন্তানের সঙ্গে তাদের মা-বাবার সম্পর্ক ক্রমেই দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে এবং এমনকি তা মুছেও যাচ্ছে। আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রম গড়ে ওঠার পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে দেখা যায় বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানদের অবহেলা ও উপেক্ষা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত সম্ভবত দেশের প্রথম বৃদ্ধনিবাসের বিভিন্ন সময়ে মিডিয়ার নেয়া সাক্ষাতকার থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়, তারা সন্তানদের কাছ থেকে অবহেলা, অনাদর, অবজ্ঞা, উপেক্ষা, মানসিক নির্যাতন পেয়ে এসেছেন। এসব কারণেই তাদের সারা জীবনের সংগ্রাম ও সাধনার ফসল সন্তানদের কাছ থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন শেষ বয়সে অন্তত একটু সম্মান ও শান্তিময় জীবনের জন্য। এখানে এসে হয়ত তারা অসম্মান ও অবহেলা থেকে রেহাই পেয়েছেন, অনেকের হয়ত তুলনামূলক অনেক ভাল ব্যবস্থা হয়েছে থাকা, খাওয়া ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে; হয়ত সেবাযতœও পাচ্ছেন; কিন্তু তার পরও প্রশ্ন থেকে যায়- মনের শান্তি কি তারা পেয়েছেন? তাদের মনের পর্দায় কি ভেসে ওঠে না প্রিয় সন্তান, নাতি-নাতনি ও স্বজনদের মুখ? সারা জীবন যাদের জন্য সংগ্রাম করেছেন শেষ বয়সে তাদের ছেড়ে কি তারা আসলেই শান্তি পাচ্ছেন? তারা তো পাশ্চাত্যের মা-বাবার মতো সন্তানদের প্রতি উদাসীন থেকে বল্গাহীন জীবন যাপন করেননি। তাহলে এ কেমন প্রতিদান? বৃদ্ধাশ্রমের অস্তিত্ব প্রমাণ করে আমাদের সমাজে বয়স্করা কোন না কোনভাবে অবহেলিত, নিগৃহীত, উপেক্ষিত ও বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের পরিবারে। অনেকে সয়ে যাচ্ছেন মুখবুজে আর কেউ কেউ প্রতিবাদস্বরূপ গিয়ে উঠেছেন বৃদ্ধাশ্রমে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- কেন এই অবস্থা পরিবারগুলোতে? জবাব একটি কথায় দেয়া যেতে পারে- যথাযথ শিক্ষার অভাব। মা-বাবার প্রতি সন্তানের কর্তব্য কী এবং তাদের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব কতটুকু- এ সম্পর্কে যথাযথ নৈতিক ও ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবই এর মূল কারণ। আমাদের দেশে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় এ বিষয়ে তেমন কোন গুরুত্ব দেয়া হয় না; ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি অনীহা প্রকাশ পায়। সে ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থী পরিবার থেকেই সামান্য যেটুকু ধর্মীয় জ্ঞান পেয়ে থাকে; সেটুকুও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। নৈতিক শিক্ষাবিহীন শিক্ষা ব্যবস্থার ফল এই দাঁড়াচ্ছে যে, লেখাপড়া শেষ করে একজন শিক্ষার্থী অর্থ উপার্জনের এক চৌকস মেশিনে পরিণত হয়, যার মধ্যে নৈতিক ও মানবিক গুণ ও মূল্যবোধ জাগ্রত না হয়ে ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যায় ব্যক্তি স্বার্থের আড়ালে। প্রতিবেশী হিন্দুপ্রধান দেশেও দেখা যায় একই ধরনের চিত্র। সেখানে কলকাতাসহ বিভিন্ন রাজ্যে শত শত বৃদ্ধনিবাস গড়ে উঠেছে কয়েক বছরের ব্যবধানে। এগুলোর বেশিরভাগই ব্যক্তি মালিকানাধীন ও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। হিন্দুদের মধ্যে শেষ বয়সে আশ্রমে গিয়ে ধ্যান ও উপাসনার জীবন কাটিয়ে দেয়ার উৎসাহ দেয়া হয় ধর্মীয়ভাবেই। কাজেই তাদের মধ্যে স্বেচ্ছায় সংসার ত্যাগ করে গয়া বা কাশি আশ্রমে গিয়ে থাকার প্রবণতা অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে প্রতিষ্ঠিত আশ্রমগুলোতে হিন্দু সম্প্রদায়ের এই ধর্মীয় বিধানকে কাজে লাগানো হচ্ছে সন্তানদের সংসারে বোঝা হয়ে না থেকে আশ্রমে গিয়ে আশ্রয় নিতে, যদিও সব ধর্মেই পিতামাতার প্রতি যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন ও কর্তব্য পালনের তাগিদ দেয়া হয়েছে। মুলাদী, বরিশাল থেকে
×