ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আদিবাসীদের ‘কারাম’ উৎসব

হাজার বছরের ঐতিহ্য মাদলের তাল, নাচে গানে ভরপুর

প্রকাশিত: ০৪:৪৮, ১০ অক্টোবর ২০১৬

হাজার বছরের ঐতিহ্য মাদলের তাল, নাচে গানে ভরপুর

বিশ্বজিৎ মনি ॥ নওগাঁ অঞ্চলের আদিবাসীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ‘কারাম’ পালনের ২১ বছর পূর্ণ হলো। সম্প্রতি নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার নাটশাল গ্রামের ফুটবল খেলার মাঠটি যেন সেদিন আনন্দে নেচে উঠেছিল। নানা সাজে সেজে-গুজে আদিবাসী তরুণ-তরুণীরা মাদলের তালে তালে নেচে-গেয়ে গোটা এলাকাকে মুখরিত করে তোলে। আদিবাসীদের সুরে সুর আর তালে তাল মিলিয়ে অনেক বাঙালীকেও মাঠে নাচতে দেখা গেছে। উত্তরাঞ্চলের ওঁড়াও, সাঁওতাল, মুন্ডা, মালো, মাহাতো, ভুঁইমালি, পাহান, রাজোয়ারসহ নানা বর্ণ ও গোত্রের আদিবাসীরা হাজার বছর ধরে কারাম উৎসব পালন করলেও নওগাঁর এই নাটশাল মাঠে ২১ বছর আগে সাংগঠনিকভাবে শুরু হয় এই ধর্মীয় কারাম উৎসবের। প্রতিবছর ভাদ্র মাসের উদিত চাঁদের পূর্ণিমার রাতে কারাম পুজো (ডালপূজা) পালন করেন তারা। পূর্ণিমার রাতে রাতভর চলে কারাম পুজো (ডালপূজা)। আর পরদিন আদিবাসী সমাবেশ, আলোচনা সভা ও নৃত্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। জাতীয় আদিবাসী পরিষদ নানা কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে এবারও কারাম উৎসব পালন করেছে। এ বছর দু’দিনব্যাপী কর্মসূচীর মধ্যে ছিল ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে ‘কারাম’ ডালে পুজো অর্চনা। এ উপলক্ষে আদিবাসী পরিবারগুলোতে আয়োজন করা হয় নানা ধরনের উন্নতমানের খানা-পিনার। সেই সঙ্গে তাদের নিজস্ব ভাষায় গান আর নাচ। খানা-পিনার পাশাপাশি এই নাচ-গানকে তারা তাদের ধর্মীয় উৎসব কারাম পুজোর অংশ হিসেবেই মেনে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। আদিবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাস মতে, বৃক্ষ তাদের নানা বিপদ-দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে। আর এই বিশ্বাস থেকেই আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে কারাম উৎসব (ডালপূজা) পালন করে আসছে। পরদিন সকাল থেকেই আদিবাসীদের গন্তব্যস্থল হয়ে উঠে মহাদেবপুরের গোপালপুর মৌজার নাটশাল খেলার মাঠ। ধর্মীয় চেতনায় নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর, পতœীতলা, বদলগাছী, সাপাহার, পোরশা, নিয়ামতপুর, ধামইরহাট উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী জয়পুরহাট, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে আদিবাসীরা নাটশাল খেলার মাঠে এসে সমবেত হতে থাকেন। বিকেল ৩টার মধ্যে মাঠ কানায় কানায় ভরে ওঠে। সেখানে আদিবাসীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। বিকেলে তারা শুরু করে তাদের ঐতিহ্যপূর্ণ নিজস্ব জাতিসত্তায় প্রচলিত গান ও নাচ। তরুণ-তরুণীরা একে অপরের হাত ধরে সারিবদ্ধ হয়ে কোমর দুলিয়ে মাদলের তালে তালে যখন নৃত্য শুরু করে, তখন এক অপরূপ দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। হাজার হাজার দর্শক-জনতা মাঠের চারপাশে দাঁড়িয়ে এই নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করে। এই নাচ-গান চলে রাত অবধি। উদ্যমী ও কঠোর পরিশ্রমী আদিবাসীরা শিক্ষায় নিজেদের পুরোপুরি সম্পৃক্ত করতে না পারলেও সততা আর সরলতায় তারা অনেক এগিয়ে রয়েছে একথা বলতে দ্বিধা নেই। জোতদারের অনুর্বর জমিতে সোনালী ফসলে ভরে দিতে যে পরিমাণ শ্রম দরকার, কর্মঠ আদিবাসীরা তা দিতে কোন কার্পণ্য করে না। তাদের ঘামঝরা শ্রমে দেশে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য জোতদার, মজুতদার ও জমিদার গোষ্ঠীর। এই কারাম উৎসবকে ঘিরে প্রতিবছরের মতো এবারও নাটশাল মাঠে গ্রামীণ মেলা বসে। খাবারের হরেক রকম মিঠাই সামগ্রীর পাশাপাশি দোকানিরা শিশুদের খেলনা, চুড়ি-ফিতা, প্রসাধনীসহ হরেক রকম মনভোলানো সামগ্রীর পসরা সাজিয়ে বসে সেখানে। বেচা-কেনাও হয় বেশ। শিশু ও তরুণীরা সেসব দোকানে ঝুঁকে পড়ে তাদের পছন্দের সামগ্রী কিনতে। সেখানে আদিবাসী আর বাঙালীদের যেন এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। এই কারাম উৎসব উপলক্ষে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ সেখানে আলোচনা সভার আয়োজন করে। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নওগাঁর ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রাশিদুল হক। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সবিন মুন্ডা, অধ্যাপক (অব) কবি আতাউল হক সিদ্দিকী, আদিবাসী পরিষদের উপদেষ্টা জয়নাল আবেদীন মুকুল, জাতীয় আদিবাসী যুব পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নরেন পাহান প্রমুখ। অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা রবীন্দ্রনাথ সরেন তার বক্তব্যে বলেন, সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন অত্যন্ত দ্রুত গঠন করতে হবে এবং আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য কমপক্ষে একশ’ কোটি টাকার বাজেট রাখতে হবে। এবার কারাম উৎসবে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত আদিবাসীদের ১৪টি নৃত্যদল অংশ গ্রহণ করে।
×