ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থনীতিতে নারীর অবদান ও প্রাপ্তি

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

অর্থনীতিতে নারীর অবদান ও প্রাপ্তি

সমাজ, সভ্যতা তথা উন্নয়নে নারীরা যুগ যুগ ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় নারী ছিল উৎপাদনের ধারক। উৎপাদন, আয়, সঞ্চয়, বিনিয়োগসহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালিত হতো গোষ্ঠী বা গোত্র প্রধান নারী দ্বারা। তখন পুরুষরা নারীর সহযোগী হিসেবে কাজ করত। আর বর্তমান সময়ে নারী শুধু দেশেই না বিদেশেও কাজের জন্য যাচ্ছে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও। আজ থেকে কয়েক বছর আগেও যে কাজগুলো শুধু ছেলেদের দ্বারাই করা সম্ভব বলে মনে করা হতো এমন কাজও আজ নারীরা সফলভাবে করে চলেছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলধারার কর্মক্ষেত্রগুলোতে নারীর অবদান বেড়েই চলেছে। বর্তমানে ১ কোটি ৬৮ লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা- অর্থনীতির বৃহত্তর এই তিন খাতে কাজ করছেন। অর্থনীতিতে নারীর আরেকটি বড় সাফল্য হলো- উৎপাদন ব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি। মূলধারার অর্থনীতি হিসেবে স্বীকৃত উৎপাদন খাতের মোট কর্মীর প্রায় অর্ধেকই এখন নারী। এ খাতে ৫০ লাখ ১৫ হাজার নারী-পুরুষ কাজ করেন। আর এই নারীকর্মীদের সিংহভাগই শ্রমজীবী। বাকিদের কেউ কেউ উদ্যোক্তা, কেউ চিকিৎসক, প্রকোশলী। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ নির্বাহী ও উচ্চপদেও দায়িত্ব পালন করছেন নারীরা তবে এ সংখ্যা খুব কম। তাছাড়া প্রতিবছর গড়ে দুই লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে যুক্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় কর্মজীবী নারীদের অর্ধেকের বেশি কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন। গত বছর বিবিএসের এক জরিপে দেখা গেছে কৃষি খাতে নিয়োজিত আছেন ৯০ লাখ ১১ হাজার নারী। বিশেষ করে সবজি চাষে নারীদের অবদান ব্যাপক। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ধান উৎপাদনের ২১টি কাজের মধ্যে ১৭টি কাজই করেন নারী। এমনকি এখন পেশা হিসেবে গৃহকর্মকেও বেছে নিচ্ছেন তারা। কলকারখানা তথা শিল্পে নারীদের অংশগ্রহণ পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি। উৎপাদন খাতই যে কোন দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে প্রথম গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি শুরু, নব্বই দশকে দ্রুত এ বাণিজ্য বেড়ে যায়। আজ যা কিছুই দেশ থেকে রফতানি করা হয়, তার মধ্যে আশি ভাগই গার্মেন্টস। প্রায় তিরিশ লাখের চেয়েও বেশি গার্মেন্টস শ্রমিকদের ৮৫ ভাগই মেয়ে। এদের বেশির ভাগই স্বল্পশিক্ষিত বা অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন। বর্তমানে আমাদের দেশের অর্থনীতিকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই গার্মেন্টসের মেয়েরাই। দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি যে, এদেশের শিক্ষিত জনেরা এখনও দেশের অর্থনীতিতে সেরকম অবদান রাখতে পারেনি। যা এই অল্পশিক্ষিত মেয়েরা রেখেছেন। পোশাক কারখানার অনেক কর্মী শূন্যহাতে জীবন শুরু করে এখন সফল উদ্যোক্তা। তেমনই একজন হলেন বেবি হাসান একসময় ছিলেন পোশক কারখানার কর্মী। এখন তার অধীনে কাজ করে প্রায় অর্ধশত কর্মী। এমন আরও অনেক নারীই সফল হয়েছেন এ পেশাতে। তবে কর্মী হিসেবে নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো জায়গায় নারীদের সংখ্যা খুব কম। তাছাড়া সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে নারীরা ঘরে ১০ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকার কাজ করেন। রান্না, বাড়িঘর পরিষ্কার, পরিবারের সদস্যদের পরিচর্যা ও সহায়তা এসব কাজের মধ্যে অন্যতম। এসব কাজ অন্য কাউকে দিয়ে করাতে যত ব্যয় হতো, সেই হিসেবে এর আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে মজুরি না পাওয়ায় জাতীয় আয়ে নারীর এ ধরনের কাজের আর্থিক প্রতিফলন ঘটে না। তাই আমাদের অর্থনীতিতে নারীর অবদান যথেষ্ট মাত্রায় অবমূল্যায়িত এতে কোন সন্দেহ নেই। এমনকি নারীরা যে আয় করে তা তারা ইচ্ছামতো খরচ করতে পারে না। পরিবার ও স্বামীর সঙ্গে আলাপ করে খরচ করতে হয়। এছাড়া মজুরি সমস্যা তো রয়েছেই। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় মজুরিপ্রাপ্তির দিক থেকে মেয়েরা অনেক পিছিয়ে। সমান কাজ করার পরও তাদের মজুরি কম দেয়া হয়। এত বৈষম্যের পরেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অবদান দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাই তো নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. অমর্ত্য সেন বিস্ময়ের সঙ্গে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মতো তথাকথিত একটি পিছিয়ে পড়া দেশের নারীরা কীভাবে এতটা এগিয়ে গেল! ভারতসহ আমাদের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তুলনা করলে এ অর্জন বিস্ময়করই বটে।’ সামগ্রিক বিবেচনায় তাই জাতীয় উন্নয়নে পুরুষের মতো নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা মূল্যায়ন করার আজ সময় এসেছে। তবে শুধু আর্থিক অবদান নয়- নারীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবদানের মূল্যায়ন করাটাও জরুরি। এর ফলে নারীরা যেমন অবমূল্যায়নের হাত থেকে রক্ষা পাবেন অন্যদিকে তারা সমাজ উন্নয়নের সমান ভাগিদার রূপে বিবেচিত হবেন। আর নারী-পুরুষের সম অংশীদারিত্বে দেশ ধাবিত হবে সমতাধর্মী টেকসই উন্নয়নের দিকে।
×