ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অধিনায়ক কৃষ্ণা রানী সরকার;###;তোফায়েল আহমেদ

‘এশিয়ার প্রতিষ্ঠিত শক্তি হতে চাই’

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

‘এশিয়ার প্রতিষ্ঠিত শক্তি হতে চাই’

বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম তখন কৃষ্ণা-কৃষ্ণা রবে মেতে উঠেছে। সেই আনন্দের উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের পুরো দেশে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ব্রেকিং নিউজে ভাসছে কৃষ্ণা রানী নামটি। অথচ কৃষ্ণার মা নমিতা রানীর মুখে একটু খানি হাসি নেই। ‘ওই যে ওখানটায় বল নিয়ে পড়ে গেল মেয়েটা।’- তীব্র লোডশেডিং এর মধ্যেও যতটুকু খেলা দেখতে পারেন মেয়ের, ততক্ষণ দেখেন একটা গোলের জন্য কিভাবে ছোটাছুটি করছে তার বুকের ধন। টেলিভিশন ক্লোজ আপে কিশোরী মেয়ের ক্লান্ত মুখখানা যখন স্পষ্ট হয়, নমিতা রানীর বুক যেন আরও ব্যাকুল হয়ে উঠে। কত দিন কাছ থেকে দেখেন না মেয়েকে। মুখ খানাও কেমন শুকিয়ে গেছে এই কদিনেই! টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার উত্তর পাথালিয়া গ্রামের নমিতা রানী সরকারের গেল কটা দিন কেটেছে এভাবেই। এএফসি অনুর্ধ ১৬ আঞ্চলিক মহিলা ফুটবলের বাছাইয়ে মেয়ে যে একের পর এক ম্যাচে দুর্দান্ত খেলে সবার মন জয় করেছে, দেশকে অন্য উচ্চতায় তুলে ধরেছে, এই কথাগুলোও যেন সান্ত¡না হতে যথেষ্ট নয় তার জন্য। তাই ম্যাচ শেষে সব ব্যস্ততার পর একটু মুক্ত হয়ে যখন মেয়ে ফোন করে বাড়িতে, মার তখন প্রথম জিজ্ঞেসা- ‘ব্যথা পাইছিলা অনেক?’ মেয়ে মাকে অভয় দিতে চান, ‘না, মা। ওই একটু লেগেছিল। ওটা তো তখনই সেরে গেছে ...।’ কিন্তু মায়ের উতলা মন কি আর সেই কথাকে বিশ্বাস করতে পারে? নমিতা রানীরও বিশ্বাস হতে চায় না। স্বামী বাসুদেব চন্দ্র সরকার স্ত্রীকে বলেন, ‘মেয়ে আমাদের অনেক বড় খেলোয়াড় হইছে। সারা দেশে ওর নাম ছড়াইছে।’ নমিতা রানী সরকারের অবুজ মন কি তখন একটু হলেও হালকা হয়? এএফসি অনুর্ধ ১৬ আঞ্চলিক ফুটবলের বাছাইয়ে সত্যিই সবার হৃদয় কেড়েছে কৃষ্ণা রানী সরকার। টুর্নামেন্টে দেশের হয়ে সর্বাধিক ৮ গোল এই কিশোরীর। ফরোয়ার্ড লাইনে তার গোল করার কৌশল, পায়ের কারুকাজ, প্রতিপক্ষের রক্ষণকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়া, সবই ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রতি ম্যাচে তাকে সামলাতেই হিমশিম খেয়েছে প্রতিপক্ষের রক্ষণ শিবির। বিদেশী দলগুলোর কোচরা তাই আলাদা করে প্রশংসা করেছেন এই ফরোয়ার্ডের। অধিনায়কত্বের ব্যাটন ছিল তার হাতে। দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়াটা তাই অপরিহার্যই ছিল তার জন্য। কৃষ্ণা সেটিই পালন করেছে অক্ষরে অক্ষরে। ইরানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে পরফর্মেন্স খুব একটা ভাল হয়নি। বল নিয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণ কাঁপিয়ে দিতে পারলেও সহজ-সহজ সব সুযোগ হচ্ছিল। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই তাই কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন ওঠিয়ে নেন তাকে। কিন্তু পরের ম্যাচ থেকেই কৃষ্ণা যেন বদলে এক চরিত্র। সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ৫-০ গোলে জেতা ম্যাচে গোল করেছে ২টি। কিরগিজস্তানের বিপক্ষে ১০-০ তে জেতা ম্যাচে হ্যাটট্রিক। চাইনিজ তাইপের বিপক্ষে বাঁ পায়ের নান্দনিক এক গোল। আরব আমিরাতের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে আরও ২টি। আট গোল করা কৃষ্ণা এখন সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের ফুটবলের রানী। আক্ষরিক অর্থেই এএফসি অনুর্ধ ১৬ আঞ্চলিক মহিলা ফুটবলের বাছাই দুই হাত ভরে দিল কৃষ্ণা রানী সরকারকে। স্বাভাবিকভাবেই টাঙ্গাইলের মেয়ে তাই খুব রোমাঞ্চিত। জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় পাওয়া গেল সুখী এক কিশোরীকে, ‘সত্যিই এই টুর্নামেন্ট স্বপ্নের মতো ছিল আমার জন্য। আমার অধীনে বাংলাদেশ টিম টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলতে যাচ্ছে এটাই সবচেয়ে বড় আনন্দ। সেরা গোলদাতা এটা ভাবতেও ভাল লাগছে।’ যে করেই হোক গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে মূল পর্বে ওঠাটা বাংলাদেশ দলের মধ্যে এক ধরনের প্রতিজ্ঞা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। টুর্নামেন্টের আগে যে কোন সদস্যের সঙ্গে কথা বলতে গেলে ওদের একটাই কথা, ‘আমরা অনুর্ধ ১৪ তে দুই দুইটা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। এই টুর্নামেন্টেও তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চাই।’ অধিনায়ক কৃষ্ণার প্রতিজ্ঞাও ছিল এমনই। কিন্তু নিজে যে এতটা আলো কাড়বেন এটা নাকি ভাবেনি ও, ‘ভাবিনি দেশের সেরা গোলদাতা হব আমি। যেহেতু হয়ে গেছি ব্যক্তিগতভাবে তাই এটা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। তবে দল হিসেবে আমরা সবাই ফুটবল ফেডারেশনকে ভাল কিছু উপহার দিতে পেরেছি। দেশকে ভাল একটা জায়গায় নিয়ে গেছি। এই আনন্দটাই সবচেয়ে বেশি।’ নেপালে এএফসি অনুর্ধ ১৪ আঞ্চলিক ফুটবলের প্রথম শিরোপাটাও এসেছিল কৃষ্ণার অধিনায়কত্বে। অনুর্ধ ১৬ মূল পর্বে উত্তীর্ণ হওয়াটাও তার হাত ধরে। কৃষ্ণা তাই একটু বেশিই খুশি। ইরানের বিপক্ষে একটু খারাপ পারফর্মেন্স। কিন্তু এরপর কি দুর্দান্তভাবেই না ফিরে আসা। কিভাবে সম্ভব হলো তা? কৃষ্ণা বলল সেই গল্প, ‘প্রথম ম্যাচই ইরানের সঙ্গে ছিল। ওরা অনেক বড় টিম। এই ম্যাচ নিয়েই আমাদের চিন্তাটা বেশি ছিল। যেহেতু আমি বাংলাদেশের অধিনায়ক, তাই অনেক বড় একটা বোঝাও ছিল মাথার উপরে। এ কারণে একটু আপসেট ছিলাম, কি না কি হয়। এজন্যই কিছু কিছু জায়গায় ভুল হয়েছে ওই ম্যাচে। তবে তারপর স্যাররা আমাদের বুঝিয়েছেন। বলেছেন, ‘একটা ম্যাচ খারাপ হয়েছে এটা কোন বিষয় নয়। পরের ম্যাচ ভাল খেল, সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমার ন্যাচারাল খেলাটাই তুমি খেল।’ স্যারদের এসব কথা শুনেই আমার আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে।’ সেই আত্মবিশ^াস এমই যে প্রতি ম্যাচেই যেন গোলের ক্ষুধা তীব্র থেকে তীব্র হয়েছে কৃষ্ণার। এ বিষয়ে প্রশ্ন করতেই কৃষ্ণা খুব সুন্দর করে উত্তর দেয়, ‘যেহেতু আমি গোল পজিশনে খেলি, তাই গোলের ক্ষুধাটা থাকাই উচিত।’ কৃষ্ণার আত্মবিশ্বাস মাখা এই কণ্ঠ যেন বাতাসের সুরই বদলে দেয়। এএফসি অনুর্ধ ১৬ ফুটবলের এই আসর কৃষ্ণাকে দিয়েছে তারকা খ্যাতি। সেই সম্পর্কে জানতে চাইলে নমব শ্রেণী পড়ুয়া ছাত্রী জানালেন, এমনটাই চেয়েছিলেন তিনি, ‘আমার নামটা সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে, এটা অনেক ভাল লাগার। সবাই এখন কৃষ্ণাকে চিনে। যে নাও চিনত বা বুঝে, তার মুখেও এখন কৃষ্ণার নাম। আসলে আমার স্বপ্নও ছিল, যদি কোন জায়গার কোন কিছু হতে পারি, তাহলে যেন বড় কিছুই করতে পারি। পত্রিকা-টেলিভিশনের হেডলাইনে আমার নাম উঠবে, বাংলাদেশের সবাই আমাকে চিনবে। সেই স্বপ্ন আমার সত্যি হয়েছে।’ অথচ কৃষ্ণার যখন ফুটবল শুরু, তখন কত বাধাই না পার করতে হয়েছে তাকে। ছোট ভাইয়ের ফুটবল নিয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় খেলতে খেলতেই খেলাটার প্রতি ভাল লাগা তৈরি। এরপর তো খেলতে শুরু করা একেবারে ছেলেদের সঙ্গেই। পড়াশোনা নেই, সারাদিন খেলা আর খেলা। মা তাই বকতেন। বাসায় ফিরতে দেরি হলে প্রহার করতেও ছাড়তেন না। ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলি বলে পাড়ার অনেকেই কটূ কথা বলত, বকাঝকা করত। কিন্তু কৃষ্ণা কখনও দমে যায়নি। ২০০৯ সালে উত্তর পাথালিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হয়ে বঙ্গমাতা আন্তঃপ্রাথমিক ফুটবলে খেলার পর থেকেই ঘুরে যায় তার ভাগ্যের চাকা। চোখে পড়েন গোপালপুর সূতী ভিএম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক গোলাম রায়হান বাপনের। যিনি কৃষ্ণার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে ভর্তি করিয়ে দেন নিজ স্কুলে। নিজ বাড়িতে রেখেও ফুটবল শিখিয়েছেন কৃষ্ণাকে। তার মাধ্যমেই টাঙ্গাইল জেলা দলে সুযোগ পাওয়া কৃষ্ণার। সেখান থেকে একের পর এক ধাপ পেরিয়ে ২০১৩ সালে ওর সুযোগ পাওয়া বাংলাদেশ অনুর্র্ধ ১৪ দলে। সেবার খেলেছে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত এএফসি অনুর্ধ ১৪ আঞ্চলিক ফুটবলে। ২০১৫ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত একই টুর্নামেন্টের পরের আসরে তো দলকে নেতৃত্বই দিয়েছে ও, করেছে চ্যাম্পিয়ন। মাঝে অনুর্ধ ১৬ তে খেলেছে, ২০১৪ পাকিস্তান সাফে প্রথমবারের মতো গায়ে জড়িয়েছে জাতীয় দলের জার্সি। কৃষ্ণার ছুটে চলার গল্প করতালি দেয়ার মতোই। নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পেছনে বাবা-মার দেখানো স্বপ্নই বড় প্রভাব বলে জানালো কৃষ্ণা, ‘যখন থেকে ফুটবলে ভাল করছি, বাবা-মা তখন থেকেই সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার লক্ষ্যটাই আমাকে দেখিয়েছেন। বাবা-মার সেই কথাগুলোকেই অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়ে আমি ফুটবলে পা বাড়িয়েছি।’ কৃষ্ণা স্বপ্ন দেখেন দেশকে অনেক উঁচুতে নিয়ে যাওয়ার, ‘এশিয়া ফুটবলে বড় শক্তি হয়ে ওঠাটাই আমাদের বড় চাওয়া। আমাদের সঙ্গে সিনিয়র আপুরা যখন সম্পৃক্ত হবে জতীয় দল তখন অনেক শক্তিশালী হবে। আমরা সবাই মিলে ফুটবলকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চাই, যেন ফুটবলের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে সবাই চেনে। বয়সভিত্তিক ফুটবলে আমরা ভাল করতে শুরু করেছি। আমাদের সবার ইচ্ছে বয়সভিত্তিক বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করা।’ আর কৃষ্ণার ব্যক্তিগত চাওয়া ব্রাজিলের মার্তার মতো বড় ফুটবলার হওয়া, ‘মার্তা আমার প্রিয় খেলোয়াড়। তার মতো বড় ফুটবলার হতে চাই।’
×