ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মূল্যায়নবঞ্চিত নোমান কি বিএনপি ছাড়ছেন? অনুসারীদের চরম ক্ষোভ

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৯ আগস্ট ২০১৬

মূল্যায়নবঞ্চিত নোমান কি বিএনপি ছাড়ছেন?  অনুসারীদের  চরম ক্ষোভ

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে এবারও স্থান হলো না রাজপথের পোড়খাওয়া প্রবীণ নেতা আবদুল্লাহ আল নোমানের। সে তুলনায় অনেক পরে রাজনীতিতে আসা চট্টগ্রামের আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও চকরিয়ার সালাউদ্দিন আহমেদ স্থান করে নিয়েছেন দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামে। এ নিয়ে চরম ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে নোমান অনুসারীদের মধ্যে। ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুযায়ী আমীর খসরু এখন আবদুল্লাহ আল নোমানের চেয়ে বড় নেতা, এ বিষয়টি মানতেই পারছেন না তার অনুসারীরা। এছাড়া যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পুত্র হুম্মাম কাদের চৌধুরী কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় দেখা দিয়েছে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা। দলে সিনিয়র নেতার অবমূল্যায়ন, জুনিয়রের পদোন্নতি এবং যুদ্ধাপরাধী পরিবারের প্রতি মমত্ববোধÑএ তিনটি বিষয় ক্ষুব্ধ করেছে দলের একাংশকে। এই অংশটি মনে করছে, খসরুকে উপরে স্থান দেয়া মানে প্রকারান্তরে নোমানকে অপমান করার শামিল। ফলে তার রাজনীতি থেকে সরে যাওয়া উচিত। আবদুল্লাহ আল নোমানও রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় কিংবা বিএনপি থেকে সরে যাবার নীতিগত সিদ্ধান্ত একপ্রকার নিয়ে ফেলেছেন বলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায়। এদিকে, পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের পর বড় ধরনের ওলটপালট হয়ে গেছে চট্টগ্রাম নগর বিএনপিতে। ওয়ানম্যান ওয়ান পোস্ট সিদ্ধান্ত কার্যকরের ফলে পাল্টে গেছে বিএনপির মহানগর কমিটির নেতৃত্ব। চট্টগ্রামে বিএনপির প্রধান নেতা বলতে দীর্ঘদিন ধরে আবদুল্লাহ আল নোমানকেই মনে করা হয়ে আসছে। আরও অনেক নেতা থাকলেও তাকেই ধরে নেয়া হয় বৃহত্তর চট্টগ্রামে বিএনপির কা-ারী। এক সময় বামপন্থী (চীনপন্থী) রাজনীতি করা নোমান বিএনপির শুরু থেকেই চট্টগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও সংগঠক। এমনকি বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে জাগদলেও ছিলেন তিনি। সব মিলিয়ে রাজনীতির মাঠে তার বিচরণ প্রায় পাঁচ দশক। ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। মার্জিত আচরণের কারণে দল এমনকি দলের বাইরেও রয়েছে এই নেতার জনপ্রিয়তা। কিন্তু কেন্দ্রে অবমূল্যায়িত হয়ে এখন চট্টগ্রামেও তার অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। তার অনুসারীদের মধ্য থেকে জোরালো দাবি উঠেছে যথাযথ পদে স্থান দিয়ে মূল্যায়ন করার। অনেকেই ক্ষোভের সঙ্গে বলছেন, যে দলে নোমান ভাইয়ের মতো নেতার মূল্যায়ন হয় না সে দলে আমরাও থাকব না। আবদুল্লাহ আল নোমানকে স্থায়ী কমিটিতে না নিলে চট্টগ্রাম মহানগরী ও নগরীর বিভিন্ন থানা কমিটিতে থাকা নোমান অনুসারী নেতারা গণপদত্যাগ করতে পারেন বলেও আভাস মিলেছে। নিজের সিদ্ধান্তের বিষয়ে নোমান সাংবাদিকদের খোলাখুলিভাবে না বললেও তিনি তার অনুসারী নেতাকর্মীদের মতামত নিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই শক্ত কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারেন বলে জানিয়েছে ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির একাংশের নেতারা সংবাদ মাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে তাদের প্রিয় নেতার যথাযথ মূল্যায়নের দাবি জানিয়ে বলেছেন, বিএনপি প্রতিষ্ঠাকাল থেকে নিরলস পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন আবদুল্লাহ আল নোমান। চট্টগ্রামসহ সারাদেশে দলকে সুসংগঠিত করতে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। চট্টগ্রামে বিএনপির রাজনীতিতে অনেকেই যুক্ত হয়েছেন নোমানের হাত ধরে। কিন্তু সদ্য ঘোষিত বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে তার স্থান না হওয়ায় নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ, হতবাক, মর্মাহত ও বিস্মিত হয়েছেন। চট্টগ্রামসহ সারাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের মনোবেদনা উপলব্ধি করে আবদুল্লাহ আল নোমানকে প্রাপ্য মর্যাদায় আসীন করে দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতির প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেবেন বলে বিবৃতিতে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বিবৃতিদাতারা হলেন- বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির শ্রমবিষয়ক সম্পাদক এ এম নাজিম উদ্দিন, মহানগর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, পাহাড়তলী থানা বিএনপির আহ্বায়ক সামশুল আলম, কোতোয়ালি থানা বিএনপির সভাপতি এম এ সবুর, খুলশী থানা বিএনপি ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম চট্টগ্রামের আহ্বায়ক এ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার, কাজী বেলাল উদ্দিন, মোঃ আলী, আহমেদ উল আলম চৌধুরী রাসেল, আবদুল মান্নান এবং বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, শ্রমিকদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের শতাধিক নেতা। বিএনপির ৫০২ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পেয়েছেন চট্টগ্রামের ২৫ নেতা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা প্রবীণ রাজনীতিক ও মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ আল নোমানের স্থায়ী কমিটিতে স্থান না হওয়া। কেননা, আগের কাউন্সিলেও তার স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়া নিয়ে জল্পনাকল্পনা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রামকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা চলে যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীকে স্থায়ী কমিটির সদস্য বানিয়ে। ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় অনুযায়ী সাকা চৌধুরীর মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে। চট্টগ্রামের কোটার এ পদটিতে কে আসছেন এ আলোচনায় ঘুরেফিরে আসে আবদুল্লাহ আল নোমান ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর নাম। নানা কারণে খসরু দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বেশ ঘনিষ্ঠ বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। তবে মাঠের রাজনীতিতে আবদুল্লাহ আল নোমান দীর্ঘদিন ধরে যে ভূমিকা রেখে আসছিলেন এবং সিনিয়র হিসেবে তিনিই স্থায়ী কমিটির সদস্য হবেন তা অনেকেই ধারণা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জায়গা হয়নি নোমানের, স্থান করে নিলেন খসরু। অনেক জুনিয়র নেতা দলের যুগ্ম মহাসচিব কক্সবাজারের সালাউদ্দিন আহমেদও স্থায়ী কমিটির সদস্য হয়েছেন। কিন্তু নোমানকে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে আগের সেই ভাইস চেয়ারম্যান পদ নিয়েই। এ বঞ্চনা মানতে পারছেন না তার অনুসারীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নেতারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, এমন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে শুধু আবদুল্লাহ আল নোমান নয়, চট্টগ্রামকেও অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। কারণ, প্রায় চার দশক ধরে রাজনীতি করছেন নোমান। চট্টগ্রামে বিএনপির মূল নেতা বলতে তাকেই বোঝায়, যার গ্রহণযোগ্যতা দলের বাইরে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত রয়েছে। নোমানকে স্থায়ী কমিটিতে না এনে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র দুই নেতাকে সর্বোচ্চ ফোরামে স্থান দেয়ার বিষয়টিকে নানাভাবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কেননা, ঘোষিত কেন্দ্রীয় কমিটিতে ভাইস চেয়ারম্যান পদে সাকা চৌধুরীর ছোট ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও নির্বাহী সদস্য পদে সাকাপুত্র হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে স্থান দেয়া হয়েছে। আবদুল্লাহ আল নোমানের অবমূল্যায়ন এবং একই সঙ্গে সাকা চৌধুরীর ছোট ভাই ও পুত্রকে গুরুত্বপূর্ণ পদে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি বিএনপির অনেক সমর্থকই মানতে পারছেন না। কারণ, এর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর প্রতি বিএনপি নেত্রীর এক ধরনের দুর্বলতা প্রমাণিত হয়। আরেক যুদ্ধাপরাধী আবদুল আলিমের পুত্রও স্থান পেয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে। দুই যুদ্ধাপরাধী পরিবারকে স্থান দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত যদি কার্যকর হয় সেক্ষেত্রে আবদুল্লাহ আল নোমানের মতো একজন মুক্তিযোদ্ধার স্থান দলের সর্বোচ্চ ফোরামে না হওয়াটাকে তারা অনেকটা স্বাভাবিক হিসেবেই দেখছেন। নোমান স্থায়ী কমিটির সদস্য না হওয়ায় দারুণ হতাশ তার অনুসারী তৃণমূলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। তবে স্থায়ী কমিটিতে আরও দুটি পদ শূন্য থাকায় কিছুটা আশাবাদী থাকার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। বিএনপির ৫০২ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে রয়েছেন চট্টগ্রামের ২৫ নেতা। এরমধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য হয়েছেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন চারজন Ñএম মোরশেদ খান, আবদুল্লাহ আল নোমান, মীর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন ও গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী। বাকিদের স্থান হয়েছে সম্পাদকম-লী ও নির্বাহী সদস্য পদে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা হয়েছেন চট্টগ্রামের চারজন। তারা হলেন সাবেক হুইপ সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম, গোলাম আকবর খন্দকার, সাবেক সংসদ সদস্য বেগম রোজী কবির ও এসএম ফজলুল হক। এদিকে, ওয়ানম্যান ওয়ান পোস্ট নীতি কার্যকর হওয়ায় পাল্টে গেছে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির নেতৃত্ব। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী স্থায়ী কমিটিতে চলে যাওয়ায় মহানগর কমিটির সভাপতি পদটি ছাড়তে হয়েছে। সাধারণ সম্পাদক ডাঃ শাহাদাত হোসেনকে করা হয়েছিল কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। কিন্তু তিনি কেন্দ্রে যেতে আপত্তি জানিয়ে মহানগর কমিটির দায়িত্ব নেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলে তাকে করা হয় মহানগর বিএনপির সভাপতি। সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন আবুল হাশেম বক্কর। প্রথমে ঘোষিত কমিটিতে তাকেও কেন্দ্রীয়সহ সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছিল। তিনিও কেন্দ্রে না গিয়ে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এক নেতার দুই পদ না রাখার সিদ্ধান্তের ফলে মহানগর বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তন ঘটেছে। মহানগর কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি আবু সুফিয়ান সভাপতি হতে পারেন এমন আলোচনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তাকে ডিঙ্গিয়ে শীর্ষ পদে উঠে আসেন ডাঃ শাহাদাত। রাজনীতিতে আবু সুফিয়ান ডাঃ শাহাদাতের সিনিয়র। ফলে ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত আবু সুফিয়ানও রাজনীতি থেকে সরে যাচ্ছেন বলে এক প্রকার নিশ্চিত করেছেন তার ঘনিষ্ঠরা। মহানগর কমিটির এমন ওলটপালট নিয়েও নগর বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এর বহিঃপ্রকাশ মাঠে কেমন হয় তা এখন দেখার বিষয়। তবে সোমবার বিকেলে মহানগর কমিটির নতুন সভাপতি ডাঃ শাহাদাত হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্করকে অভিনন্দন জানিয়ে চট্টগ্রামে মিছিল বের করে তাদের অনুসারীরা। এ মিছিলে দলের সকল অংশের নেতাকর্মী ও সমর্থককে দেখা যায়নি।
×