ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শামীম হাসান

নারীর গল্পগাঁথা

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ২৫ জুলাই ২০১৬

নারীর গল্পগাঁথা

একটা দেশের উন্নতি হলো কি হলো না তা যা দিয়ে মাপা হয় তার নাম জিডিপি বা গ্রস ডমেস্টিক প্রডাক্ট। একটি দেশের এক অর্থবৎসরে যত ধরনের ও যত পরিমাণের পণ্য উৎপাদিত হয়, সেবা প্রদান করা হয় বা কাজ করা হয় তার আর্থিক মূল্যের সমষ্টিই হলো জিডিপি। জিডিপি হিসাবায়ন একটি জটিল প্রক্রিয়া। কোন্ জিনিস এখানে অন্তর্ভুক্ত হয়নি? চারদিকে তাকালে মনুষ্য তৈরি যা দেখি সবই। জুতার শুক তলি, শার্টের বোতাম হতে শুরু করে বিশাল জাহাজ নির্মাণ, ধোপা-নাপিত হতে শুরু করে কৃষক-শ্রমিক, ডাক্তার-প্রকৌশলীর শ্রমমূল্য বা বেতন সবই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু বিশাল এই তালিকার মধ্যে এমন একটি নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি যাকে ছাড়া সমাজ-সংসার অচল। এই নামটি হলো গৃহিণী। অর্থাৎ গৃহিণীর গৃহস্থালি কাজ। জিডিপিতে এই কাজের মূল্য ধরা হয়নি। অর্থাৎ একজন গৃহিণী মাথার ঘাম পায়ে ফেলে স্বামী-সন্তান পরিবারের জন্য যে কাজ তার কোন আর্থিক মূল্য নেই। তার সারাদিনের-সারাজীবনের কাজ ষোলো আনাই মিছে। নারীর দুঃখগাথা শুরু এখান থেকেই। সকল পেশা বা কাজের নির্দিষ্ট একটি নাম আছে। কিন্তু নারী নিজ ঘরে যত কাজই করুক না কেন তা কোন পেশার মধ্যে পড়ে না। যদিও পেশা নামক স্থানে আমরা গৃহিণী শব্দটি লিখি। গৃহিণী কি আসলে কোন পেশার নাম? অথচ গভীরভাবে একটু ভাবলেই বুঝতে পারব গৃহিণীর আড়ালে একজন নারী কতজন পেশাজীবীর কাজ করে থাকে। বাবুর্চির মতো রান্না-বান্না করা, আয়ার মতো সন্তান লালন-পালন ও শুশ্রƒষা করা, ধোপার মতো কাপড় ধোয়া, শিক্ষকের মতো বাচ্চাদের পড়াশোনা করানো, বাড়ির কেয়ারটেকারের দায়িত্ব পালন করা, বাড়িঘর পরিষ্কার পরিছন্ন করা, বাজার করা, সামাজিকতা রক্ষা করা, আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, পরিবারের পরামর্শক, স্বামীর বন্ধু, জীবনসঙ্গী-শয্যাসঙ্গী ইত্যাদি আরও কত কাজ করে থাকে একজন গৃহিণী। অথচ প্রতিটি কাজের জন্য পেশাজীবী নিয়োগ করলে তার শ্রমমূল্য বা বেতন কিন্তু ঠিকই জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হতো।জিডিপির মত জটিল বিষয় না হয় বাদ দেয়া হলো, একজন স্বামী কি গৃহিণীর কাজের মূল্যায়ন করে থাকে? তার কাজের অর্থ মূল্য প্রদান করে? সাধারণত যেসকল স্ত্রী চাকরি করে বা নির্দিষ্ট পেশার সঙ্গে জড়িত তাদের আয়কে মূল্যায়ন করা হয়। গৃহিণীর কোন আর্থিক স্বাধীনতা নেই। স্বামী যেভাবে নাচায় সেভাবেই নাচে। কোন কোন স্বামী নারীকে টাকা কড়ি ঠিকই দেয় কিন্তু মাঝে মধ্যে বুঝিয়ে দিতে ভুলে না যে এটা ভালবাসার আড়ালে এক ধরনের দয়া। লাটাই হাতে রেখে ঘুড়ির স্বাধীনতা দেয়া আর কি! টাকা কড়িও না হয় বাদ দিলাম। কিন্তু সংসারে কোন সমস্যার সৃষ্টি হলেই স্বামী মহাশয় যখন হুংকার দিয়ে বলে, সারাদিন ঘরে বসে থেকে কি কর? তখন নারী এ দুঃখ কোথায় রাখে? এ তো গেল অনেক প্রকার কাজ করেও গৃহিণী নামক বেকার নারীর কথা। এখন আসি আমি বাইরের গৃহিণী বা চাকরিজীবী নারীর কথা। সাধারণত সবাই ধরে নেয় যে সংসারে স্বামী-স্ত্রী দুজনে চাকরি করে তাদের সংসার কতই না সুখের। এ ধরনের সংসারে একটু অশান্তি হলেই আমরা ভাবি- সুখে থাকতে ভুতে কিলায়। ইঙ্গিতটি কিন্তু নারীর দিকেই। আসলে কি তাই? নারী মাত্রই জন্মগত বা প্রাকৃতিকভাবেই ঘর কেন্দ্রিক। তাই নারী যখন কর্মস্থলে বা বাইরের জগতে যায় তখন সবই তার প্রতিকূল পরিবেশ। অনেক হিসাব-নিকাশ করে চলতে হয়। চাকরি করতে গেলে অনেক পুরুষ সহকর্মী বা ক্লায়েন্টের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কথা বলতে হয়। সেই কথা বলা বা মেশার মাত্রা যদি হেরফের হয় তবেই সর্বনাশ। যদি কম হয় তবে কেউ দেমাগি বা অহঙ্কারী বলে দূরে সরিয়ে রাখবে। কেউ কেউ টিপ্পনি কাটবে- নাচতে এসে আবার ঘোমটা। আর যদি বন্ধুসুলভ মনোভাব নিয়ে একটু বেশি মিশে তবে ভাববে হাতের মুঠোয় পেয়ে গেছি। হাসি হাসি ভাব দেখলে অন্যরকম ইঙ্গিতে মনে করবে। ভাবখানা এমন ইচ্ছে করলেই যা খুশি তা.... বাইরের মানুষ সে তো বাইরেরই মানুষ, যা ভাবে ভাবুক। কিন্তু নিজের পুরুষ মানুষ? অফিসে কোন কাজে বা মিটিংয়ের কারণে বাসায় ফিরতে দেরি হলে নারীকে স্বামীর বা পরিবারের বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। যা এক সময়ে সন্দেহ বা মনোমালিন্য পর্যন্ত গড়ায়। একে তো অফিসের অতিরিক্ত কাজে ক্লান্ত, কোথায় একটু শান্তি পাবে। তা না, উল্টো বাসায় ফিরতে হয় মাথা নিচু করে। যেন কোন অপরাধ করে এসেছে। অথচ অফিসের এই বিলম্ব যদি স্বামীর ক্ষেত্রে ঘটে তখন ভাবখানা এমন যেন দ্বিগীজয় করে এসেছে। অন্যদিনের চেয়ে সেদিন তার বিশেষ খাতির যতœ করতে হয়। স্বামী যদি বাসায় অফিসের কলিগ বা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে কথা বলে বা ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাহলে কিচ্ছু না। এটা তার পপুলারিটি বা গুড ইমেজ হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু এই কাজ একজন নারী করলে তার সংসার টিকে রাখাই মুশকিল। ভাবখানা এমন যেন, নারীর তো বিয়ের পর বন্ধু-বান্ধব থাকতে নেই। সুখ-দুঃখ শুধুই স্বামীর সঙ্গে শেয়ার করতে হবে। কিন্তু তার নিজস্ব পুরুষটি জানে না নিজস্ব ছাড়াও আরও কিছু থাকে। কর্মক্ষেত্রে স্বামীর চেয়ে যদি স্ত্রী বেশি সফলতা পায় তবেই শুরু হয় ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব। এই নীরব যন্ত্রণায় কত নারী যে শেষ হয়েছে সে খবর কে রাখে। পুরুষ নারীকে অধঃস্তন দেখতেই পছন্দ করে। চাকরিজীবী স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে বাসায় ফিরলে স্বামী কাপড় পাল্টিয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দেয় আরাম-আয়েশের জন্য। আর স্ত্রী বেচারীর ছুটতে হয় রান্না ঘরে অথবা সন্তানদের যতœ নিতে। আসলে একজন নারীর কোন ছুটি নেই। চাকরিজীবী নারীরা তো তবুও ভাগ্যবান যে তারা চাকরি করে। কিন্তু সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়েও যখন স্বামীর বা স্বামীর পরিবারের মানসিকতার কারণে ঘরে বসে থাকতে হয় নারীকে। বিয়ে করে বিসর্জন দিতে হয় তার স্বপ্ন, আশা-আকাক্সক্ষাকে। প্রতিভাবান হওয়া সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে চার দেয়ালের মধ্যে কর্মবিমুখ এবং পর নির্ভরশীল হয়ে জীবনযাপন করতে হয়। নারীর স্বপ্ন ভঙ্গের এই দুঃখ বোঝে কয়জনে? যে সন্তান লালন পালন করার জন্য একজন নারী তিল তিল করে ক্ষয় করে তার শরীর ও মন। কোন কারণে স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য বা বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে স্বামী এমনভাব করে যেন সন্তান শুধুই তার একার। বংশের বাতি। অথচ যে নারী সন্তান ধারণ করল জন্ম দিল, লালন-পালন করল, তার যেন সন্তানের ওপর অধিকারই নেই। উনিশটি হাড় একসঙ্গে ভেঙ্গে যাওয়ার কষ্টের সমপরিমাণ প্রসব বেদনার কষ্ট পুরুষ বুঝবে কি করে? একজন কন্যাশিশু যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, মা-বাবা ও আপনজনের আদর ভালবাসায় বড় হয়, যে বাড়ির পরতে পরতে তার শৈশব-কৈশরের স্মৃতি জড়িত, বিয়ের পর জানতে পারে মা-বাবার এই ঘর নাকি তার আপন নয়। স্বামীর বাড়িই তার আপন ঘর। মা-বাবার সংসারে সে নাকি কিছু দিনের মেহমান। তাই বুকের সব কষ্ট ভুলে তিল তিল করে গড়ে তোলে আপনঘর অর্থাৎ স্বামীর ঘর। কিন্তু আপন ঘরটি তার কতটুকু আপন তা স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য হলেই টের পায়। কোথায় তোমার ঘর গো নারী, কোথায় তোমার ঘর.... পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি, লালসা, ইভটিজিংয়ের প্রতিনিয়ত শিকার হয় মেয়েরা। পথভ্রষ্ট নারী-পুরুষ পাপাচারে বা ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। কিন্তু ফতোয়া জারি হয় শুধু নারীর বেলায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা বিভিন্নভাবে শোষিত বঞ্চিত, নিগৃহীত অথবা নির্যাতিত হচ্ছে। নারী স্বাধীনতার কথা বললেও নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে কি? আর অধিকার? পিতা-মাতার সম্পত্তিতেই তো নারীর পূর্ণ অধিকার পায় না। হিন্দু ধর্মে তো নারীরা উত্তরাধিকার হয় না। কোন কোন ধর্মে তো আবার নারীকে শয়তানের প্রতিভূ, নরকের দ্বার বিবেচনা করা হয়। নারীর সফল ভূমিকার কারণে একটি পরিবার তথা পারিবারিক মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে এটা মানতে সমাজের মানুষ এখনও নারাজ। নিমাই ভট্টাচার্যের লাল মেম সাহেব আমাদের সমাজেও আছে কিন্তু আমরা তার খোজ রাখি না। একজন নারীর ভালবাসা, আত্মত্যাগ ও পরিশ্রমের কারণে একজন পুরুষের অনেক বড় হওয়ার কাহিনী হলো এই লাল মেম সাহেব উপন্যাস। নারী মা, নারী কন্যা, নারী স্ত্রী/প্রেয়সী, নারী বোন, খালা, ফুফু। সকল ভালবাসার উৎস হল নারী। তাই নারীর অবহেলা মানে নিজের ভালবাসাকেই অবজ্ঞা করা। তাছাড়া মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক হচ্ছে নারী। তাই এই অর্ধেককে দমিয়ে রেখে কখনই উন্নতি সম্ভব নয়।
×