ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিএসএমএমইউ চিকিৎসকদের সাফল্য

অস্ত্রোপচারে অপূর্ণাঙ্গ জোড়া শিশু পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠল

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ২১ জুলাই ২০১৬

অস্ত্রোপচারে অপূর্ণাঙ্গ জোড়া শিশু পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অপূর্ণাঙ্গ জোড়াশিশু মোহাম্মদ আলীকে জটিল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ করে মায়ের কোলে তুলে দেয়া হয়েছে। বুধবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খান শিশুটিকে মায়ের কোলে তুলে দেন। অপূর্ণাঙ্গ যমজ হিসেবে জন্ম নিয়েছিল মোহাম্মদ আলী। এখন শিশুটি পুরোপুরি সুস্থ বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের খরচে শিশুটিকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, শিশুটির ভবিষ্যত জীবন গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাসও প্রদান করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বাগেরহাটের দিনমজুর মোঃ জাকারিয়ার স্ত্রী হীরামনি গত ৭ মার্চ জোড়া লাগানো যমজ সন্তানের জন্ম দেন। বাগেরহাটের রামপাল থানার শোলাকুড়া গ্রামের বাড়িতে হীরামনি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় শিশুটির জন্ম দেন। শিশুটি ওই দম্পতির চতুর্থ সন্তান। তাদের আট, তিন ও এক বছর বয়সী তিন মেয়ে রয়েছে। মোহাম্মদ আলীর মা হীরামনি বলেন, জন্মের পর সন্তানের এমন অস্বাভাবিক অবস্থা দেখে সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসকরা ঢাকায় নিয়ে আসার পরামর্শ দেন। তিন দিন বয়সী সন্তানকে নিয়ে তারা গত ১০ মার্চ ঢাকায় চলে আসেন। দুটি বেসরকারী হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু সেখানে কোন আশা দেখা যায়নি। পরে বিএসএমএমইউতে চিকিৎসার জন্য আসেন। বেশ কয়েকবার পরীক্ষার পর গত ২০ জুন মোহাম্মদ আলীর অস্ত্রোপচার হয়। চিকিৎসকদের হাত থেকে সন্তানকে কোলে নিয়ে হীরামনি বলেন, আমার কী যে খুশি লাগছে তা বোঝাতে পারব না। আমি আমার ছেলেকে কোলে নিতে পেরে আনন্দিত। আমি ভাবিনি, আমার সন্তান আমার কোলে ফিরে আসবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, সবাই আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন। সে যেন আপনাদের মতো বড় হয়। শিশুটিকে মায়ের কোলে তুলে দেয়া উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। শিশু মোহাম্মদ আলীকে সুস্থ করে তোলার পেছনে অবদানকারী চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল হাসান খান বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আজ একটি বিশেষ দিন। অপূর্ণাঙ্গ জোড়া শিশুটি পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠেছে। আমরা নতুন মোহাম্মদ আলীকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে পেরে আনন্দিত। দেশে যে এ ধরনের চিকিৎসাসেবার সুযোগ রয়েছে, তা সব মানুষের জানা নেই। যে কোন অস্ত্রোপচারে আমাদের আশঙ্কা থাকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, মোহাম্মদ আলীর মতো জন্ম নেয়া শিশুকে ‘কনজেনিটাল প্যারাসাইটিক টুইন’ বা জোড়া অপূর্ণাঙ্গ যমজ বলা হয়। তার অস্ত্রোপচারে আশঙ্কা একটু বেশি ছিল। তবে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। উপাচার্য আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, চিকিৎসা ও গবেষণা কার্যক্রমের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। অনেক কিছুতে এসেছে নতুনত্ব। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাসেবার মান হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিকমানের। আমেরিকা, ভারত, কেনিয়াসহ কিছু দেশ থেকে অনেক রোগী এ বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করতে আসছে। শুধু মোহাম্মদ আলীর বিষয়টি নয়, অনেক জটিল জটিল রোগের আন্তর্জাতিকমানের চিকিৎসাসেবা প্রদানের ঘটনাও রয়েছে, যা প্রচারের অভাবে আড়ালেই রয়ে গেছে বলে জানান উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খান। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শহীদুল্লাহ সিকদার, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ডাঃ এ এস এম জাকারিয়া স্বপন, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ মোঃ আলী আসগর মোড়ল ও রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল হান্নান। অপূর্ণাঙ্গ যমজের সফল অস্ত্রোপচার ॥ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিএসএমএমইউতে ১৮ সদস্যের চিকিৎসক দল অপূর্ণাঙ্গ যমজ শিশু মোহাম্মদ আলীর অস্ত্রোপচার করে। এতে নেতৃত্ব দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোঃ রুহুল আমিন। পুরো অস্ত্রোপচারটি হাসপাতালে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। অস্ত্রোপচার কক্ষের বাইরে বসে তা দেখেন শিশুটির মা-বাবা। সরাসরি সম্প্রচারিত অস্ত্রোপচারটি গণমাধ্যমকর্মী, রোগীর স্বজন ও দর্শনার্থীরাও দেখার সুযোগ পান। শিশুটির চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। মায়ের কোলে মোহাম্মদ আলীর অস্ত্রোপচারে নেতৃত্ব দেয়া অধ্যাপক মোঃ রুহুল আমিন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে জোড়া লাগানো শিশুর সংখ্যা আমরা বেশি দেখতে পাচ্ছি। আগেও এ ধরনের শিশু জন্ম নিত। জন্মের পরই ওই শিশুরা মারা যেত বা মা-বাবা এদের লুকিয়ে রাখতেন। সমাজ তাদের ‘ডাইনি’ বলে ডাকত। এ ধরনের জোড়া লাগানো শিশুদের খোঁজ পেলে আমরা অস্ত্রোপচার করতে প্রস্তুত । তিনি আরও বলেন, মোহাম্মদ আলীর ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারে জটিলতা ছিল। সেসব কাটিয়ে ওঠার পর অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে। পরিবেশ পরিবর্তন, খাদ্যাভাসসহ বিভিন্ন কারণে জোড়া লাগা শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে থাকতে পারে বলে জানান অধ্যাপক মোঃ রুহুল আমিন। এর আগে গত ২০ জুন অপূর্ণাঙ্গ জোড়াশিশুর অস্ত্রোপচারের জন্য মেডিক্যাল টিম গঠন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু সার্জারি বিভাগ। আরেকটি শিশুর শরীরের প্রায় অর্ধেক অংশ নিয়ে জন্মায় মোহাম্মদ আলী। সে একটি পূর্ণাঙ্গ শিশু কিন্তু তার ওপর ভর করে আছে আরেকটি শিশুর পেটের নিচের অর্ধেকসহ শরীরের নি¤œাঙ্গ। উর্ধাঙ্গের মাথা, বুক ও দু’হাত নেই। আংশিক বা অপূর্ণাঙ্গ শিশুটি তার আংশিক অস্তিত্ব নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ শিশুর ওপর ভর করে বেঁচেছিল। ১৮ সদস্যের মেডিক্যাল টিমের উপদেষ্টা সার্জন হিসেবে আছেনÑপেডিয়াট্রিক বা শিশু সার্জারি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাঃ শফিকুল হক, অধ্যাপক ডাঃ মোঃ মতিউর রহমান ও অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। সার্জিক্যাল টিমে রয়েছেন- পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাঃ মোঃ রুহুল আমিন, অধ্যাপক ডাঃ মোঃ তোসাদ্দেক হোসেন সিদ্দিকী, সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ কে এম দিদারুল ইসলাম, ডাঃ দিনেস প্রসাদ কৈরালা, ডাঃ একেএম খায়রুল বাসার, ডাঃ নূর মোহাম্মদ ও ডাঃ মাফিয়া আফসিন লাজ। এ্যানেসথেসিয়া টিমে আছেন এনেসথেশিয়া, এনালজেসিয়া এ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাঃ দেবব্রত বণিক, সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাঃ মোঃ আব্দুল হাই, সিনিয়র কনসালটেন্ট ডাঃ মনজুরুল হক লস্কর, ডাঃ মোঃ আব্দুল আলীম ও ডাঃ সাফিনা সুলতানা সম্পা এবং নবজাতক বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মধ্যে রয়েছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য ও নবজাতক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ সহিদুল্লা, নবজাতক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাঃ মোঃ আব্দুল মান্নান ও সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ সঞ্জয় কুমার দে।
×