ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

শাকিল আহমেদ

যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদী আচরণ

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ১৩ জুলাই ২০১৬

যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদী আচরণ

যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের ইতিহাস খুব পুরনো নয়। আব্রাহাম লিঙ্কনের আগ পর্যন্ত কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকের হাহাকার ছিল মার্কিন ইতিহাসের চরম এক কালো অধ্যায়। মানুষের শরীরের চামড়ার রঙের ওপর ভিত্তি করে যে বৈষম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবস্থা সেটাই বর্ণবাদ (রেসিজম) নামে সমধিক পরিচিত। এর সূত্রপাত ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক দখল ও আধিপত্যের মধ্য দিয়ে। ‘ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গরা জন্মগতভাবেই উৎকৃষ্ট’ এই মতাদর্শ তৈরি করা হয়েছে ইউরোপের বাইরে ঔপনিবেশিক দখল, অশ্বেতাঙ্গদের শৃঙ্খলিতকরণ এবং শোষণশাসন নিশ্চিত করবার জন্য। পঞ্চদশ শতকের শেষ থেকে ক্রমান্বয়ে আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশিয়া ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে আসে। আমেরিকায় এই দখল নিশ্চিত করবার জন্য সেখানকার উচ্চ সভ্যতার নির্মাতা আদিবাসীদের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ মানুষকে হত্যা করা হয়। অন্যদিকে আফ্রিকার কালো মানুষদের দাসে রূপান্তর করা হয় এবং তাদের নিয়ে যাওয়া হয় আমেরিকায়। ইউরোপীয় বণিকদের জন্য দাসবাণিজ্য খুবই লাভজনক হয়ে ওঠে। বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিও সেসময় থেকে তার ডালপালা ছড়িয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের ‘নিকৃষ্ট মানুষ’ কিংবা ‘সবাক জীব’ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও সেসময় থেকেই ইউরোপীয় মননে দৃঢ়ভিত্তি লাভ করে। কালো মানুষদের ওপর সবরকমের নৃশংসতা এই দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারাই সমর্থিত হয়। কয়েকশ বছরে এটি বহু বহু বর্বরতার জন্ম দেয়। এই দৃষ্টিভঙ্গির শেকড় এতটাই গভীরে প্রোথিত যে, এখনও এর অবসান হয়নি। উনিশ শতকে দাসপ্রথা রদ হলেও কয়েকদশক আগে পর্যন্তও যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের প্রতি বিদ্বেষ ও বৈষম্যমূলক বিধিব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই কার্যকর ছিল। বহু জায়গায় লেখা থাকত ‘কুকুর ও কৃষ্ণাঙ্গ প্রবেশ নিষেধ’। বর্ণবাদী নির্যাতনের ইতিহাস ভয়াবহ। এর অর্থ এটা নয় সকল শ্বেতাঙ্গ এর সহযোগী কিংবা এই ব্যবস্থার সুবিধাভোগী। বৈষম্য ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের আন্দোলন সবরকম বৈষম্য-নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক বড় অনুপ্রেরণা। সেই আন্দোলন নতুন ঐক্য ও পরিচয় তৈরি করেছিল যার সঙ্গে শ্বেতাঙ্গরাও ছিলেন। অবজ্ঞা, অবহেলা, সুযোগের অভাবই যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের একটা বড় অংশকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। একজন কৃষ্ণাঙ্গ বাবা হওয়ার সময়ই জানতেন, ছেলেকে শেখাতে হবে, পুলিশের সঙ্গে কী করে কথা বলতে হয়। আরও শেখাতে হবে, গ্রেফতার এড়ানোর ফন্দি-ফিকির। যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের ফার্গুসন শহরতলির কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনযাপন এমনই। কৃষ্ণাঙ্গরা ফার্গুসনে গাড়ি চালাতে ভয় পান। কারণ যে কোন সময় পুলিশ তাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করতে পারে। কৃষ্ণাঙ্গ হলে ‘যে কোন সময় আপনার মৃত্যু হতে পারে, জেলে যেতে পারেন বা জরিমানা গুনতে হতে পারে। রোজকার জীবনে এ ভীতি মজার বিষয় নয়।’ যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব জাস্টিস স্ট্যাটিসটিকস জানায়, ২০০৩ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত গ্রেফতারসংক্রান্ত দুই হাজার ৯৩১টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। নিহতরা বেশির ভাগই পুরষ এবং তাঁদের বয়স ২৫ থেকে ৪৪ বছরের মধ্যে। নিহতদের ৩২ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ। যদিও মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৩ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ। বিচার বিভাগের দেয়া তথ্যমতে, শেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ ও হিসপানিকদের ট্রাফিক তল্লাশির সময় অন্তত তিন ভাগ বেশি থামানো হয়। প্রতি তিনজন আফ্রিকান আমেরিকানের মধ্যে অন্তত একজনকে জীবনে একবার হলেও জেলে যেতে হয়। শেতাঙ্গ সহপাঠীদের কাছ থেকে হয়রানির শিকার হয় কৃষ্ণাঙ্গ স্কুল শিক্ষার্থীরাও। ডারেল আলেক্সন্ডার (৫৬) নামের এক অবসরপ্রাপ্ত নার্স জানান, ‘কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ হওয়ার কারণে আমি জানি, যে কোন সময় আমাকে গুলি করা হতে পারে। ন্যায়বিচার মেলে না, ফলে তরুণরা ক্ষুব্ধ এবং তাদের ক্ষোভ প্রকাশের অধিকার আছে। এদিকে গত ২৮ ফেব্রুয়ারির ২০১৬ অস্কার অনুষ্ঠান বর্জন করেছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক স্পাইক লি এবং অভিনেত্রী জাডা পিংকেট স্মিথ। তাদের অভিযোগ, গতবারের মতো এবারো প্রধান পুরুষ এবং মহিলা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য যারা মনোনীত হয়েছেন, তারা সবাই শ্বেতাঙ্গ। বরাবরের মতো এবারো কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অবহেলিত। ইন্টারনেট-ভিত্তিক ভিডিও স্ট্রিমিং প্রতিষ্ঠান নেটফ্লিক্সের প্রযোজনায় তৈরি ‘বিস্টস অব নো নেশন’ চলচ্চিত্রের জন্য গোল্ডেন গ্লোবের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন ব্রিটিশ কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা ইদ্রিস এলবা। কিন্তু একাডেমি বিচারকদের উৎসাহিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। তবে ব্রিটেনের টিভি ও চলচ্চিত্রে বিভিন্ন জাতি ও বর্ণের প্রতিনিধিত্বের বৈষম্য নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি। ১৯৭৬ সালে যখন রকি ছবিটি মুক্তি পায়, সেটি ১০টি অস্কার মনোনয়ন পেয়েছিল। জিতেছিল তিনটি পুরস্কার। ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সিলেভিয়েস্টার স্ট্যালোন। গোল্ডেন গ্লোব জিতেছেন। কিন্তু রকির পুরনো শত্রু এ্যাপোলো ক্রিডের ছেলের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করেছেন সেই মাইকেল বি জর্ডানকে লক্ষ্যই করেননি একাডেমির ছয় হাজার সদস্য। কনকাশন ছবিতে অভিনয়ের জন্য গোল্ডেন গ্লোবে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার মনোনয়ন পেয়েছেন উইল স্মিথ। একজন চিকিৎসকের ভূমিকায় অভিনয় করে ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি। অথচ অস্কারে কোন মনোনয়ন পাননি উইল স্মিথ। সামাজিক দিক থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের এখনও ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হলেও শিক্ষার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র এখন সবচেয়ে এগিয়ে আছে কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা। মার্কিন শিক্ষা বিষয়ক সংস্থা ন্যাশনাল সেন্টার ফর এ্যাডুকেশন স্ট্যাটিস্টিকসের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মোট প্রাপ্ত ডিগ্রীগুলোর মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা ৬৬ শতাংশ ব্যাচেলর ডিগ্রী, ৭১ শতাংশ মাস্টার্স ডিগ্রী এবং ৬৫ শতাংশ ডক্টরেট ডিগ্রী পেয়েছেন। কলেজে যাওয়ার হারও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের। পূর্বের তুলনায় ১০-১৫ শতাংশ বেড়েছে । একই সময়ে শ্বেতাঙ্গদের কলেজ যাওয়ার হার অনেকটাই কমেছে। আগের ৮৪ শতাংশ থেকে নেমে এখন ৬০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক বছরে কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের ক্ষেত্রে পড়াশোনার চিত্রটাই পাল্টে গেছে। শ্বেতাঙ্গ, এশীয়, হিস্পানিক পুরুষ বা নারী সবার মধ্যে এগিয়ে রয়েছেন তারা। পড়াশোনাতে এগিয়ে। তবে বৈষম্য আছে চাকরিতে। সেখানে কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের অবস্থান একেবারেই সন্তোষজনক নয়। নারীরা অনেক সময়ই কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে পুরুষদের হেনস্থার শিকান হন। আর যদি তারা কৃষ্ণাঙ্গ, এশীয় বা হিস্পানিক হয়ে থাকেন, তবে তো কথাই নেই। বহুবার এ নিয়ে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও কাজ তেমন কিছুই হয়নি। বেসরকারী ক্ষেত্রে মাত্র ৮ শতাংশ পদে চাকরি পাচ্ছেন কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা। এর মধ্যে মাত্র দেড় শতাংশই উচ্চপদে পৌঁছতে পারেন। এক জরিপ অনুসারে, ২০১৪ সালে সাধারণ শ্রমিক বা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পদে এশীয়, কৃষ্ণাঙ্গ এবং হিস্পানিক নারীরা মিলে মাত্র ১৭ শতাংশ পদে নিয়োগ পেয়েছেন। প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী বা ব্যবস্থাপক পদে এই হার কমে এসেছে ৪ শতাংশের নিচে। বড় সংস্থার পরিচালনা পর্ষদে সংখ্যাটা কমে যাচ্ছে ৩ শতাংশেরও কম। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গরা আজও অত্যাচারিত। গত ৫ জুলাই মঙ্গলবার লুইজিয়ানার ব্যাটন রুজে ৩৭ বছর বয়সী এ্যাল্টন স্টের্লিংকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। পরদিন রাতে মিনেসোটার শহরতলী সেন্ট পলে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত ফিলান্ডো ক্যাস্টিল (৩২) হাসপাতালে মারা যান। এরপর শুরু“হয় প্রতিবাদ। সবচেয়ে মজার কথা হলো একটা ছবি অনেক কথা বলে যায়। কখনও কখনও একটা ছবি লাখ কথা বলে দেয়। লুসিয়ানার, ব্যাটন রোডে পুলিশ হেড কোয়ার্টারের ঠিক সামনে প্রতিবাদ সভা চলছিল। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের উপর পুলিশি অত্যাচার, অভব্যতার প্রতিবাদে সেøাগানে উত্তপ্ত এলাকা। একদিকে পুলিশ, অন্যদিকে বিক্ষোভকারীরা। হঠাৎই এক তরুণী কিছু এগিয়ে আসেন। তার হাতে কোন অস্ত্র ছিল না। একেবারে সোজা দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ। কিন্তু পুলিশের ওসবে বিশ্বাস নেই। একেবারে দাঙ্গা সামলানোর পোশাক পরে, হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে মহিলাকে গ্রেফতার করলেন পুলিশকর্মীরা। নারীর নাম ইসহিয়া ইভান্স। ২৮ বছরের এই নারী হলেন নিউইয়র্কের নার্স। এ রকম ধরনের প্রতিবাদে এটাই তিনি প্রথমবার গিয়েছিলেন।
×