ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কূটনীতিক পাড়ায় কঠোর নিরাপত্তা, এখনও আতঙ্ক কাটেনি

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১১ জুলাই ২০১৬

কূটনীতিক পাড়ায় কঠোর নিরাপত্তা, এখনও আতঙ্ক কাটেনি

আজাদ সুলায়মান ॥ গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় ভয়ঙ্কর জঙ্গী হামলার দশ দিন পরও স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি ডিপ্লোমেটিক জোন। থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে গুলশান, বনানী ও বারিধারায়। এখানকার বাসিন্দাদের এখনও তাড়া করছে সেই রাতের ভয়ঙ্কর হামলা। এদিকে ডিপ্লোমেটিক জোনের সার্বিক নিরাপত্তায় আনা হয়েছে ব্যাপক পরিবর্তন। প্রতি শিফটে তিন শতাধিক নিরাপত্তা কর্মী টহল দিচ্ছে। একটার পর একটা টহল পুলিশের নজরদারিতে থাকছে পথচারীরা। অভূতপূর্ব এক নিরাপত্তার ঘেরাটোপে পড়েছে এখানকার বাসিন্দার জীবনযাত্রা। বাসা থেকে গাড়ি নিয়ে বের হতে কিংবা ঢুকতেই নিরাপত্তার চৌহদ্দিতে তল্লাশির মুখে পড়তে হচ্ছে। আর শিশু কিশোরদের মাঝে হররজোনে পরিণত হয়েছে রাজধানীর একমাত্র এই ডিপ্লোমেটিক জোন। এছাড়া গুলশানের অভিশপ্ত ৭৯ নম্বর রোডসহ আশপাশের রোডগুলো এখনও নীরব-নিস্তব্ধ। পথচারীরা ওই এলাকা দিয়ে ইউনাইটেড কিংবা বারিধারায় যেতে আসতে থমকে দাঁড়ায় ওই রোডের মাথায়। দূর থেকে একনজর দেখার বাসনায় তাদের ক্ষণিক থামা। শনি ও রবিবার এমনই চিত্র চোখে পড়ে এই ডিপ্লোমেটিক জোনে। একাত্তর নম্বর রোড ও ৭৯ নম্বর রোডের সংযোগস্থলের চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে রবিবার দেখা যায়- হলি আর্টিজানের লাগোয়া আশপাশ ও সামনের বাসাবাড়িতে যাতায়াতকারীর মাঝে এক ধরনের অজানা ভীতি কাজ করছে। তারা যতটা আতঙ্কিত- তার চেয়ে বেশি ভীতসন্ত্রস্ত। এমনই একজন ৭৯ নম্বর রোডের একটি বাড়ির বাসিন্দা হাসান মাহমুদ বললেন- চোখের সামনে ঘটে গেছে এ ঘটনা। সেই রাতে যা চোখে দেখেছি আর কানে শুনেছি তা মনে হলে এখনও রাতে ঘুমাতে কষ্ট হয়। বাচ্চাদের অবস্থা শোচনীয়। তারা মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত যে এখনও ভয় পায়। তাদের ভয় হয়ত আবারও হামলা হবে। রবিবার ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়- ভয়ঙ্কর হামলার ঘটনাস্থল হলি আর্টিজান বেকারির প্রবেশপথে ৭৯ নম্বর সড়কের মুখে এখনও রয়েছে ব্যারিকেড। টহল পুলিশ সদস্যরা রয়েছেন নিরাপত্তায়। টহল দিচ্ছে র‌্যাব। এ সম্পর্কে গুলশান থানার একজন কর্মকতা জানান, এ রকম পরিস্থিতি থাকবে স্থায়ীভাবেই। নিরাপত্তা নিয়ে বিন্দুমাত্র গাফিলতি বা উদাসীনতা চলবে না। ডিপ্লোমেটিক জোন- গুলশান বনানী ও বারিধারায় বর্তমানে তিন শতাধিক নিরাপত্তা কর্মী প্রতি শিফটে সার্বক্ষণিক ডিউটি করছে। থানা পুলিশ ছাড়াও রয়েছে ডিপ্লোমেটিক কোরের স্পেশাল ফোর্স চ্যান্সারি পুলিশ। পুলিশের একজন ডিসি পদমর্যাদার কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে রয়েছে চ্যান্সারি পুলিশ কূটনীতিকদের বাসাবাড়ি ও জানমালের নিরাপত্তা। এ বিষয়ে একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, গত কয়েকদিন ৭৯ নম্বর রোডের নিয়মিত বাসিন্দাদের বাড়ি থেকে বেরুতে এবং ঢুকতে চেক করা হয়েছে। এই ক’দিনে তারা আমাদের পরিচিত হয়ে গেছেন। তারপরও কোন গাড়ি ঢুকতে হলে এবং যে কোন মানুষ হেঁটে ঢুকতে গেলেও আমাদের তল্লাশির মুখে পড়ছেন। কেউ কেউ একটু বিরক্ত হলেও নিরাপত্তার স্বার্থে সেটা মেনে নিয়েছেন এবং আমাদের সহযোগিতা করছেন। গুলশান ৮নং রোডের বাসিন্দা হেদায়েতুল ইসলাম বলেন, শূটিং ক্লাবের সামনে কিংবা মহাখালী দিয়ে ঢুকলেই নিরাপত্তা চৌকির মুখে পড়তে হয়। পুলিশ যে গাড়িটাকে সন্দেহ হয় সেটাই আটক করে। বিশেষ করে যুবক শ্রেণীর যাত্রীবেশী থাকলে জেরাটা বেশ জোর দিয়েই করে। এ এলাকার বাসিন্দা এ আর খান জাহাঙ্গীর বলেন, কাকলী থেকে বনানী বাজার পেরিয়ে লেকের ওপর থাকা ব্রিজের চেক পোস্টে যেভাবে চেক করা হয়Ñ তাতে শুধু ভয়ই লাগে না-হাসিও পায়। কর্তব্যরত এপিবিএন সদস্যরা রাইফেল উঁচিয়ে দূর থেকেই গাড়ি থামানোর ভয়ঙ্কর সঙ্কেত দেয়। থামার পর গাড়ির বনেট খোলা হয়। খুলতে দেরি হলে সেটারও কৈফিয়ত দিতে হয়। চেক করার পর যদি গাড়িতে কোন কিছু না মেলে তাহলে শুরু হয় জেরার পালা। কোন রোডে বাসা, ভাড়া না স্থানীয় বাসিন্দা, এত রাতে কোথা থেকে আসা ইত্যাদি প্রশ্নবাণে পড়তে হয়। আর যদি গাড়িতে কোন সুদর্শন যুবক খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা থাকে তাহলে গাড়ি থেকে নামিয়ে আলাদাভাবে চলে তল্লাশি। হাতানো হয় তার সারাদেহÑ মানিব্যাগ থেকে আন্ডারওয়্যার বাদ যায় না কিছুৃই। এ ধরনের নিরাপত্তায় কেউ মুখ খুলে কিছু বলতেও পারছে না, মেনেও নিতে পারছে না। তারপরও সবার জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে নীরবে সইতে হচ্ছে। এদিকে রবিবার দুপুরেও হলি আর্টিজানের সামনে গিয়ে দেখা যায়, ওই বাড়িতে এখনও পুলিশের ব্যারিকেড। কৌতূহলী মানুষজন আসছেন। ভেতরে মাথা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করছেন। তাদেরও পুলিশের জেরার মুখে পড়তে হচ্ছে। উল্লেখ্য, গত ১ জুলাই রাতে রাজধানীর গুলশান ২ নম্বর সেকশনের ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়ঙ্কর হামলা চালায় জঙ্গীরা। এতে দুই পুলিশ সদস্য, ১৭ বিদেশী নাগরিক ও তিন বাংলাদেশী নিহত হন। পরে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত অপারেশন থান্ডারবোল্ট অভিযানে পাঁচ জঙ্গী নিহত হয়। অভিযানে জীবিত উদ্ধার করা হয় বিদেশী নাগরিকসহ ১৩ জিম্মিকে। নিহতদের মধ্যে নয়জন ইতালির, সাতজন জাপানী ও একজন ভারতের নাগরিক। বাকি তিনজন বাংলাদেশী, যাদের মধ্যে একজনের যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বও ছিল। সর্বশেষ জঙ্গী সন্দেহে আটক শাওন নামের একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার ঢাকা মেডিক্যালে মারা যান।
×