ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উলফার শিকড় ওপড়ানো কি সহজে সম্ভব? -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ৩০ জুন ২০১৬

উলফার শিকড় ওপড়ানো কি সহজে সম্ভব? -স্বদেশ রায়

কাউন্টার টেরোরিজমের একজন বড় মাপের এক্সপার্টের সঙ্গে ঘরোয়া আলাপ হচ্ছিল দিল্লীতে। সেখানে কথা প্রসঙ্গে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব অসমের (উলফা/আলফা) বর্তমানে বাংলাদেশে কী অবস্থা সে প্রসঙ্গ আসে। কথা হয় সামগ্রিক সেভেন সিস্টারের অন্য টেরোরিস্ট গ্রুপগুলোকে নিয়ে। আলাপের এক পর্যায়ে বুঝতে পারি, তিনি মনে করছেন, বাংলাদেশে এখন ওদের অবস্থান অতি মাইনর। তার সঙ্গে বিতর্কে না গিয়ে শুধু বলি, বাংলাদেশে ওদের টাকাটা কিন্তু আছে। ওরা মিডিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিজনেসে যে বিনিয়োগ করেছে ওই বিনিয়োগ চলমান। প্রথমে তার আচরণে মনে হয় টাকার বিষয়ে খুব একটা গুরুত্ব দেননি, আর এদিকে যেহেতু এক্সপার্ট নই, কোন মতে সাধারণ জ্ঞান রাখি তাই ওই বিষয়ে আর কথা বাড়াইনি। তবে আলোচনা শেষে যখন আমরা উঠব ওই সময় উনি আমাকে লক্ষ্য করে শুধু বললেন, ওদের টাকার পরিমাণ কিন্তু কম নয়। তার কথার উত্তরে একটু হাসি বিনিময় করেই উঠে পড়ি। টাকার নিজস্ব একটা শক্তি আছে। মানব জাতির ইতিহাস লিখতে গিয়ে অধ্যাপক হারারি বলছেন, অর্থ সেই বস্তু এই পৃথিবীতে প্রথম যার ওপর সকলে আস্থা রাখল। মানব সভ্যতার ইতিহাসে অর্থ আস্থার প্রতীক ঠিকই কিন্তু বর্তমানের টেরোরিজম কবলিত বিশ্বে, এই আস্থার প্রতীক অর্থ, টেরোরিস্টদের হাতে টেরোরিজমের ব্লাড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাস্তবে মানব শরীর সচল থাকে যেমন রক্ত প্রবাহের ওপর, টেরোরিজমের নিজস্ব একটি রক্ত প্রবাহ সিস্টেম আছে। আর সেই রক্তই অর্থ। বাংলাদেশ থেকে উলফার কিছু নেতা পালিয়ে গেছেন, কাউকে ডিপোর্ট করা হয়েছে কিন্তু তাদের যে বিশাল অর্থ ছিল, যা তারা পাকিস্তানের আইএসআই-এর মাধ্যমে, পাকিস্তানের বন্ধুদের মাধ্যমে এবং অস্ত্র চোরাচালানের মাধ্যমে এখানে জড়ো করেছিল। ওই অর্থের বড় একটি অংশ তারা বাংলাদেশে বিভিন্ন ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করে। এই বিনিয়োগ তারা প্রথম থেকেই করছিল এবং আওয়ামী লীগ ছাড়া সব সরকার তাদের এই অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছে। অর্থের নিজস্ব শক্তিটা এমন যে, অর্থের পেছনের যদি বড় মাপের লোক না-ও থাকে তার পরেও অর্থ নিজস্ব গতিতে কাজ করতে পারে। তার প্রমাণ এ দেশের মানুষ মীর কাশেম আলীর ক্ষেত্রে পেয়েছে। মীর কাশেম আলীর অর্থ হয়ত জয়লাভ করতে পারেনি, কিন্তু তার অর্থ তো কাজ করেছে- সে কাজ তো দেশের মানুষ দেখেছে। আবার এ দেশের মানুষ দেখতে পেল উলফার অর্থ কতটা শক্তিশালী। উলফার বড় নেতারা এ মুহূর্তে কেউ বাংলাদেশে নেই। অধিকাংশ ভারতের হাতে। যতদূর জানা যায়, শুধু পরেশ বড়ুয়া কখনও মিয়ানমারে, কখনও চীনে ও কখনও পাকিস্তানে থাকে। আর বাংলাদেশে আছে বিভিন্ন ব্যবসায়ে বিনিয়োগকৃত তাদের অর্থ আর কিছু সাধারণ কর্মী- যারা বাংলাদেশের বিশেষ একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে আছে। কিন্তু তার পরেও দিয়াবাড়ি খালে কয়েক দিন আগে যে বিশাল অস্ত্রের মজুদ পাওয়া গেল, ওই অস্ত্র পাওয়ার পরে যতটুকু তথ্য বাইরে এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, অস্ত্র চালানটি আসে উলফার মাধ্যমে এ দেশের জামায়াত-বিএনপির জন্য। দিয়াবাড়ি খালের অস্ত্রের পরিমাণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে এত অস্ত্র এক জায়গা থেকে উদ্ধার হয়নি। জামায়াত সন্ত্রাসী সংগঠন ১৯৭১ থেকে। বিএনপিরও বড় একটি অংশ সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে এবং তারা সংখ্যায় কম নয়। তাছাড়া দেশের সাধারণ ছেলেমেয়েদের ধর্মের নামে বা বিভিন্নভাবে মোটিভেটেড করে সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়ানো হচ্ছে। তাদের জন্য এই অস্ত্র এসেছিল। কিন্তু তার থেকে বড় হলো, উলফা এখনও এত বড় মাপের অস্ত্রের চালান বাংলাদেশে পাঠানোর ক্ষমতা রাখে। তাই যে টেরোরিস্ট সংগঠনটি এত বড় মাপের একটি অস্ত্রের চালান সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে পাঠাতে পারে ওই সংগঠনের অস্তিত্ব বা শিকড় এখানে কত গভীরে তা কারও বুঝতে ভুল হওয়ার কথা নয়। এখান থেকে এও বোঝা যায়, উলফা নেতৃত্ব বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হলেও বাংলাদেশে তাদের অর্থের ও অন্য ধরনের লোক বলের শক্তি কত বড়। কারণ এ রকম বড় একটি অবৈধ অস্ত্রের চালান সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে রাজধানী অবধি নিয়ে আসতে পথে পথে তাদের কত অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে, কত লোক নিয়োজিত ছিল এ কাজে! টেরোরিজম বিশেষজ্ঞরা নিঃসন্দেহে বলতে পারবেন, এত বড় একটা অস্ত্র চোরাচালান এত পথ পাড়ি দিতে তাদের লোকবল কত দরকার হয়েছে। সেই লোকবল তাদের আছে বলেই রাজধানীতে ওই অস্ত্র তারা পৌঁছাতে পেরেছে। এই লোকবল সবই যে তাদের কর্মী তা নয়, পথে পথে তারা অর্থ দিয়েই যোগাড় করেছে বড় একটি অংশ। অর্থাৎ তাদের অর্থের ক্ষমতাই এখানে সব থেকে বড়। এখন প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ ও ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশে বিনিয়োগকৃত উলফার এই সচল অর্থ কীভাবে অচল করা হবে। কীভাবে পথ বন্ধ করা হবে যাতে এই অর্থ তারা ব্যয় না করতে পারে। বাস্তবে ব্যক্তি জঙ্গী থেকে জঙ্গী অর্থের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া আরও কঠিন। কারণ এখানে অর্থের দ্বিমুখী শক্তি। এক, অর্থের অন্তর্নিহিত সচল শক্তি। দুই, যাকে দিয়ে অর্থকে অচল করার চেষ্টা করা হবে তিনিও অর্থের কাছে পরাজিত হতে পারেন। এ জন্য মানুষকে যত সহজে পরাজিত করা যায়, মানুষ সৃষ্ট এই অর্থকে তত সহজে পরাজিত করা যায় না। বিশ্ব পরিসরের উদাহরণে না গিয়েও বাংলাদেশের ছোট্ট পরিসরের ভেতরই এর উদাহরণ আছে। ইসলামী ব্যাংকের অর্থের কাছে প্রতি মুহূর্তে কীভাবে ক্ষমতাসীন থেকে শুরু করে তথাকথিত সুশীল সমাজের ব্যক্তিরা পরাজিত হচ্ছেন তা মনে হয় এখন আর দেশবাসীর অজানা নয়। এমনকি বাংলাদেশে যে সন্ত্রাসীরা নানা পথে মুক্তি পায় সেক্ষেত্রেও একটি বড় ভূমিকা রাখে ইসলামী ব্যাংকের অর্থ। তবে সততা, আন্তরিকতা ও সময়ের ব্যাপ্তি এই তিনের যদি সমন্বয় ঘটে তা হলে ইসলামী ব্যাংকের অর্থের এ শক্তি এক সময়ে এ দেশে পরাজিত হবে। সেক্ষেত্রে সব থেকে বড় সুবিধা হচ্ছে, ইসলামী ব্যাংক চিহ্নিত । তাই সরকার তার কাছ থেকে কোন অর্থ নিলে সরকারকে নিয়ে মানুষ প্রশ্ন তোলে, কোন ব্যক্তি ইসলামী ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ নিলে সাধারণ মানুষ ওই ব্যক্তিকে নিয়ে প্রশ্ন তোলে। মানুষের এই সচেতনতাই কিন্তু ইসলামী ব্যাংকের পরাজিত হওয়ার সব থেকে বড় কারণ। তবে সেখানে অন্যতম শর্ত হচ্ছে, বর্তমানে দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবিরোধী যে সরকারী অবস্থান আছে একে ক্রমান্বয়ে বাড়াতে এবং দীর্ঘায়িত করতে হবে। অন্যদিকে জঙ্গীÑপক্ষরা সরকারে এসে গেলে তখন আবার ইসলামী ব্যাংক বিজয়ী হবে। তবে ইসলামী ব্যাংকের থেকেও বড় সমস্যা উলফার অর্থ। এই অর্থ কিন্তু সরকার চিহ্নিত করতে পারছে না। কারণ এই অর্থ কোন বিশেষ নামে নেই, কিছু ব্যবসায়ীর মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থ স্রোতের সঙ্গে ওই অর্থ মিশে আছে। এখন সরকার ওই ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে পারবেন কিনা তাও যেমন প্রশ্ন তেমনি প্রশ্ন তাদের চিহ্নিত করতে পারলেও তাদের অর্থ প্রবাহের সঙ্গে যে উলফার অর্থ মিশে আছে সেটা চিহ্নিত করা সম্ভব কিনা? পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কোন কিছুই নেই। তবে এ সত্য যে, পৃথিবীতে রাতারাতি কোন কাজ হয় না। বিশেষ করে কোন কোন কাজের জন্য সময়ের প্রয়োজন হয়। কোন কিছু যখন মাটির অনেক গভীরে তাদের শিকড়কে প্রোথিত করে ফেলে তখন সেটা ওপড়ানোর জন্য অবশ্যই সময়ের প্রয়োজন হয়। উলফার অর্থকে পরাজিত করে বাংলাদেশের মাটি থেকে উলফার শিকড় ওপড়ানোর জন্য সেই সময়ের প্রয়োজন। চল্লিশ বছরের সমস্যা চার বছরেই সমাধান হয়ে যাবে এমন ভাবার কোন যুক্তি নেই। তাই এখন সব থেকে বড় বিষয়, বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্ব এবং সরকারের ধারাবাহিকতা সেই সময় পাবে কিনা? ভারতে রাজনৈতিক পালাবদল হলেও উলফা বা অন্যান্য সন্ত্রাসী গ্রুপ যারা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে অবস্থান নিয়েছে তাদের সম্পর্কে ওই দেশের সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি একই থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক পালাবদল হলে উলফা বা ভারতের অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যারা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে অবস্থান নিয়েছে তাদের সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে। উলফা তাদের অর্থ, অস্ত্র চোরাচালান সবকিছু সচল রাখছে এই লটারির ওপর আশা করে। যে কারণে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হওয়া তাদের অনেক সহযোগীকে কিন্তু তারা অনেক অর্থ ব্যয় করে আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে জামিনও করিয়েছে। তারা চেষ্টা করছে যতটুকু হোক সচল রাখা যায় পাশাপাশি তাদের ভবিষ্যত তারা ওই লটারিতেই বেঁধে রেখেছে। ওই লটারিতে উলফা জিতবে কিনা তার আগাম কোন ভবিষ্যত বাণী করা যায় না। তবে এটা বলা যায়, যদি ওই লটারিতে তারা না জেতে, যদি বাংলাদেশে রাজনৈতিক পালাবদল না হয়- একটি দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে জঙ্গীবাদবিরোধী রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা থাকে তাহলে সময়ই উলফার অর্থকে পরাজিত করবে। বাংলাদেশ সরকারকে পুরো সময়ে ওই পরাজিত করার কাজের সহায়ক হিসেবে কাজ করতে হবে। [email protected]
×