ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিক্রি হচ্ছে ডিও প্রথায়

চিনির দাম বাড়ছে ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১১ জুন ২০১৬

চিনির দাম বাড়ছে ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে

এম শাহজাহান ॥ চিনি বিক্রিতে বিতর্কিত সেই ডিও প্রথা অনুসরণ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মিল মালিকরা আড়ৎ ব্যবসায়ীদের ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) দিচ্ছে। আর আড়ৎ ব্যবসায়ীরা ডিও দিচ্ছেন পাইকারদের। উৎপাদন পর্যায় থেকে পাইকার এবং খুচরা ব্যবসায়ীর কারসাজির কারণে বাড়ছে চিনির দাম। কারসাজি হয়ে থাকে বলে বিতর্কিত ডিও বাতিল করে পরিবেশক প্রথা চালু করেছিল সরকার। কিন্তু সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোয় আবারও চিনি বিক্রি হচ্ছে ডিও প্রথায়। এতে খুচরা বাজারে প্রতিকেজি চিনির দাম উঠেছে ৬৫-৬৮ টাকা। তাই ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে চিনি ব্যবসায়ীর দিকে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, পর্যাপ্ত মজুদ সত্ত্বেও শুধু রমজান মাসে অতিমুনাফা করার জন্য চিনির কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করা হচ্ছে। কারসাজির এ প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ছেন মিল মালিক থেকে আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের ছলচাতুরীর কারণে বাজারে ৪২ টাকার চিনি বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৬৮ টাকায়। ফলে এবারও সিন্ডিকেটের কব্জায় রমজানের বাজার। চিনির পাশাপাশি ডাল, ছোলা এবং ভোজ্যতেলের পর্যাপ্ত মজুদ সত্ত্বেও কোন পণ্যের দামই যৌক্তিক পর্যায়ে নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উৎপাদক, আমদানিকারক, পাইকার কিংবা খুচরা পর্যায়ে যে যার মতো মজুদ, কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি ও দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছে। বিশেষ করে রমজান মাস কেন্দ্র করে ঢাকার মৌলভীবাজার এবং চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্র। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক উর্ধতন কর্মকতা জনকণ্ঠকে বলেন, চিনি বিক্রিতে আবারও ডিও প্রথা অনুসরণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ এসেছে। গুটিকয়েক মিল মালিক ও আড়ৎ ব্যবসায়ী এই প্রক্রিয়া যুক্ত আছেন। এ কারণে বেড়ে যাচ্ছে চিনির দাম। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। তিনি বলেন, বড় সমস্যা ঢাকার মৌলভী বাজার এবং চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে। এই দুই মার্কেটেই ডিও প্রথা চালু করেছে কিছু ব্যবসায়ী। বিষয়টি তদন্ত করতে মাঠে রয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। অভিযোগ প্রমাণিত হলে দায়ী ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রসঙ্গত, চিনি নিয়ে কারসাজির কারণে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে মীর গ্রুপের অফিস ও গুদাম সম্প্রতি সিলগালা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। ওই সময় মীর গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম ও সেল্স ম্যানেজার জানে আলমকে ১০ লাখ করে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির দুই কর্মচারী মফিজুল হক ও সজল সেনগুপ্তকে কারসাজিতে সহযোগিতা করার দায়ে এক সপ্তাহ করে কারাদ- দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিলুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত এ অভিযানে র‌্যাব সদস্যরাও অংশ নেন। অভিযানের পর ম্যাজিস্ট্রেট জানান, মীর গ্রুপের ডিও এবং অন্যান্য কাগজপত্র পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণপারের একটি মিল থেকে ৪৬ টাকা ৮০ পয়সায় চিনি কিনে পাইকারি বাজারে ৫৮ টাকা ৫০ পয়সা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে দেখা যাচ্ছে, তারা প্রতিকেজি চিনিতে ১১ টাকা ৭০ পয়সা মুনাফা করছে। অতিরিক্ত টাকাটা কেন নেয়া হচ্ছে এবং এই কারসাজির সঙ্গে আর কারা যুক্ত, বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। জানা গেছে, বন্দরনগরী চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও ঢাকার কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রমজানকে ঘিরে কয়েশ’ কোটি টাকার অতি মুনাফা করতে তৎপর হয়ে উঠেছে। যদিও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, পেঁয়াজ, ডালসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছেদেশে । তাই চাহিদা বাড়লেও সঙ্কট হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তবে কারসাজি করে পণ্যের দাম বাড়ানো হলে দায়ী ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। জানা গেছে, চিনি ডিও প্রথার মাধ্যমে বিতরণ করার ফলে কারসাজির সুযোগ পাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। ফলে রিফাইনারি থেকে পাইকারি ব্যবসা পর্যন্ত ডিও বাজার ঘিরে অসাধু চক্র গড়ে উঠেছে। এতে চিনির দাম বেড়ে যাচ্ছে। ডিও প্রথায় কারসাজি হওয়ার সুযোগ তৈরি হয় বলে ভোজ্যতেল ও চিনির ক্ষেত্রে এই প্রথা বাতিল করে দেয় সরকার। তারপরও বাতিলকৃত এই প্রথা অনুসরণ করে চিনির দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। যদিও অভিযোগের ভিত্তিতে সম্প্রতি দেশের সব বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের গতিবিধির ওপর তীক্ষè নজর রাখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানকে ডেকে কড়া হুঁশিয়ারিও দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআইয়ের সাŸেক প্রথম সহসভাপতি আবুল কাশেম আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, চিনির দাম বৃদ্ধির জন্য গুটিকয়েক ব্যবসায়ীরাই দায়ী। এখানে বড় ধরনের কারসাজি হয়ে থাকে। তিনি তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, গত চার পাঁচ বছর আগে চিনি নিয়ে এ ধরনের সঙ্কট তৈরি হয়েছিল। এফবিসিসিআইয়ের কার্যকর পদক্ষেপের ফলে তখন চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ওই সময় কারসাজির অভিযোগে ১২ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছিল। এদিকে, বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সম্প্রতি দ্রব্যমূল্য নিয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে রমজানে চিনির দাম বাড়বে না, সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে-এমন আশ্বাস দিয়েছিল চিনি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা ও সিটি গ্রুপ। কিন্তু তারা কথা রাখেনি। রমজানের আগমুহূর্তে কারখানায় যান্ত্রিক ত্রুটির অজুহাতে চিনির সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। প্রতিষ্ঠান দুটি বাজারে চিনির সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে চিনির দাম। দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে খুচরা বিক্রেতারা দুষছেন পাইকারদের। পাইকাররা দুষছেন উৎপাদক ও আমদানিকারকদের। আর উৎপাদকরা ও আমদানিকারকরা বাজার ব্যবস্থায় অনিয়মের জন্য দায়ী করছেন পাইকার ও খুচরা বিক্রেতাদের। বাংলাদেশ কনজ্যুমারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান জানান, রমজান মাস সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চাহিদা বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা পণ্যমূল্য নিয়ে বাজারে নিত্যনতুন কৌশলও একের পর এক প্রয়োগ করে যাচ্ছেন। তাদের এই অপতৎপরতা বন্ধে সরকারী নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন।
×