ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২

নাজনীন বেগম

নারীর অধিকার হরণ

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ১০ জুন ২০১৬

নারীর অধিকার হরণ

কোন সমাজের বৈষয়িক সমৃদ্ধির পাশাপাশি মানসিক চেতনার বিকাশ আবশ্যকীয় পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচিত হলেও বাস্তবে এর চিত্র অন্যরকম। যান্ত্রিক সভ্যতার ক্রমান্বয়ে সমাজের বস্তুগত সংস্কৃতি যেমন করে অবারিতভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যায়, ঠিক সেভাবে মানুষের চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ, মনোজগতের বিকাশ সমান তালে চলতে পারে না। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন এর ফলে বস্তুগত সংস্কৃতি এবং মানুষের চিন্তার জগতের মধ্যে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়। যাকে প্রতীকমূলক সংস্কৃতির পশ্চাদবর্তিতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যেমন উল্লেখ করা হয়ে থাকে জন্মনিয়ন্ত্রণের সমস্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বাংলাদেশে প্রচলিত থাকা সত্ত্বেও একে গ্রহণ করার মানসিকতার অভাবে জনসংখ্যা এখনও আমাদের অন্যতম সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সেভাবে আমাদের দেশে নারীর অগ্যযাত্রা, ক্ষমতায়ন, নারী শিক্ষা, পেশাগত জগতের সাফল্যÑসব মিলিয়ে নারী স্বাধীনতার যে ইতিবাচক প্রভাব তার আড়ালে, আবডালে এখনও নিপীড়নের যে দুঃসহ চিত্র আমাদের তাড়িত করে তা সত্যিই বেদনাদায়ক। রক্ষণশীল, ধর্মাশ্রিত কোন সমাজ যখন তার সমস্ত অপসংস্কারগুলো জিইয়ে রেখে নারীদের সামনে চলার পথকে মুক্ত করতে বলে সেটা কি কখনও সম্ভব? কারণ পুরো সমাজ কাঠামো নির্ধারণ করে নারী-পুরুষ উভয়ের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথপরিক্রমাকে। পিছিয়ে পড়া কোন সমাজে দুর্বল অংশ সব সময়ই তার অধিকার ও স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত থাকে। আমাদের দেশে জন্ম থেকেই কন্যাসন্তানই দুর্বলতম অবস্থানে থাকে। শৈশব থেকে তার বেড়ে ওঠা, গড়ে ওঠা, পারিবারিক অবস্থা, শিক্ষাকার্যক্রম, পেশাগত জীবনে নিজেকে সম্পৃক্ত করা এবং শেষ অবধি এক সময় সাংসারিক জীবনে প্রবেশ করা একটি নারীর সঙ্গে একজন পুরুষের এখনও অনেক ফারাক। একজন নারী যিনি একাধারে মা, গৃহিণী, ডাক্তার, শিক্ষিকা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, পুলিশ অফিসার, সেনা অফিসার ইত্যাদি অনেক কিছুই। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন নারী। তার বাবা-মায়ের সংসারে সে যখন বড় হয় সেখানে ভাইয়ের সঙ্গে একটা তারতম্য নিয়েই তাকে বড় হতে হয়। প্রতিদিনের খাবার থেকে শুরু করে তার লেখাপড়া, আনুষঙ্গিক অন্য সুযোগ-সুবিধাসহ নানা মাত্রিকে নারীরা কোন না কোনভাবে বঞ্চনার শিকার হয়। যখন ছেলের লেখাপড়ার জন্য বাবারা নিজেকে সর্বস্বান্ত করে দেয়, কিন্তু মেয়ের ব্যাপারে এ ধরনের নজির থাকলেও তার সংখ্যা খুবই কম। মেয়ের বিয়ের জন্য বাবা-মা নিজেদের অনেক সহায়-সম্পদ হারায় এটা ঠিক। সেটা কিন্তু তাকে পাত্রস্থ করার জন্য সামাজিক প্রথাকে মেনে নিয়েই। এর পরও মেয়েরা এই প্রথাসিদ্ধ বাতাবরণ থেকে মুক্ত হচ্ছে, নিজেদের তৈরি করছে, বৃহত্তর সামাজিক আঙ্গিনায় যথাযথ ভূমিকাও রাখছে। মেয়েরা আজ বৈষয়িকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, নিজেদের আসন মজবুত করছে সন্দেহ নেই, কিন্তু সাংসারিক ভূমিকায় মা হিসেবে তিনিও তাঁর ছেলেমেয়ের পার্থক্যকে অতিক্রম কতখানি করতে পারছেন তা সত্যিই বিবেচনার বিষয়। পারিবারিকভাবে একটি মেয়ে যখন তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয় সেখানে মা যদি শিক্ষিত এবং কর্মজীবী হন তাহলে সত্যিই বুঝতে হবে রক্ষণশীল সমাজের গৎবাঁধা শেকড় থেকে আধুনিক মা-ই নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি। এর সংখ্যা এখন অনেক কমে গেলেও একেবারেই নেই তাও বলা যাবে না। সমাজ প্রগতির সবক্ষেত্রে অবদান রেখেও সনাতন মানসিকতা লালন করার কারণেই আধুনিক মায়েরাও কার্যক্ষেত্রে পিছিয়ে আছেন। নারী-পুরুষের ভেদাভেদের মূল শেকড়টি উপড়ে ফেলতে না পারলে নারী-শিক্ষিতা, আধুনিক এবং সচেতন হলেও নারী স্বাধীনতার অবারিত পথও সেভাবে নির্দেশিত হবে না। বৈষয়িক এবং অর্থনৈতিক সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক জগতেরও উৎকর্ষ সাধন করতে হবে। তা না হলে সমস্ত অর্জনই ব্যর্থ হয়ে যাবে। নারীত্বের সমস্ত বিকাশ ঘটিয়েও মনুষ্যত্বের মাপকাঠিতে তার ন্যায্য অধিকার আদায় করা যেমন তার নিজের দায়ভাগ, একইভাবে পরিবারের এমনকি সমাজেরও। পরিবার বলতে নারী-পুরুষের যৌথ প্রচেষ্টায় একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। শুরু থেকেই নারী-পুরুষের অসাম্য বৈষম্যকে একেবারে নির্মূল করতে হবে।
×