ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফাঁসির দড়িতে নিজামী

প্রকাশিত: ০৭:১৭, ১১ মে ২০১৬

ফাঁসির দড়িতে নিজামী

বিকাশ দত্ত/মশিউর রহমান খান/আরাফাত মুন্না ॥ চার দশক আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে ইতিহাসের দায় ঘুচল বাংলাদেশের, শেষ হলো নিজামীপর্বের। মঙ্গলবার রাত ১২টা ১০ মিনিটে কুখ্যাত এই যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির। এর আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নিজামীর সঙ্গে শেষ দেখা সম্পন্ন করেছেন নিজামীর পরিবারের সদস্যরা। নিজামী হলেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া পঞ্চম ব্যক্তি। একই সঙ্গে তিনি প্রথম কোন দলীয় প্রধান ও দ্বিতীয় সাবেক মন্ত্রী, যুদ্ধাপরাধের জন্য ফাঁসিতে ঝুলে যার দণ্ড কার্যকর হলো। আলবদর নেতা থেকে পরিণত বয়সে যুদ্ধাপরাধীর দায়ে অভিযুক্ত সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর সর্বোচ্চ নেতা বনে যাওয়া নিজামী রাষ্ট্র গঠনের সরাসরি বিরোধিতা করেও গাড়িতে উড়িয়েছেন মন্ত্রীর পতাকা। মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী নিধন ও গণহত্যায় নেতৃত্ব দেয়া আলবদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীকে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি মন্ত্রী পদে বসায়। আবার মন্ত্রী হয়েও জড়িয়েছেন নানা অপরাধের সঙ্গে। ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায়ও পেয়েছেন সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর চারদলীয় জোট সরকারের আমলের মন্ত্রী নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। ট্রাইব্যুনালে এর মধ্যে আটটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এরমধ্যে চার অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড এবং চারটিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। প্রমাণিত অভিযোগগুলোর মধ্যে তিনটিতে মৃত্যুদণ্ড ও দুটিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং তিনটি অভিযোগ থেকে খালাস দিয়ে রায় ঘোষণা করে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। পরে এ রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন জানান নিজামী। ৫ মে ওই আবেদন খারিজ করে দেয় সর্বোচ্চ আদালত; যার মধ্য দিয়ে তার দণ্ড কার্যকরে আইনী বাধা কাটে। সোমবার বিকেলে রিভিউ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রারের কার্যালয় থেকে ট্রাইব্যুনালে পৌঁছায়। সেখানে আনুষ্ঠানিকতা শেষে রায় পৌঁছে যায় কারাগারে। নিয়ম অনুযায়ী বদরপ্রধান নিজামীর সামনে এরপর খোলা ছিল কেবল নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়া। তবে প্রাণভিক্ষা না চাওয়ায় নিজামীর দণ্ড কার্যকর হয় মঙ্গলবার রাতেই। মঙ্গলবার রাত ১২টা ২৬ মিনিটে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির সাংবাদিকদের বলেন, ১২টা ১০ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। তিনি বলেন, রাত ১২টা ১ মিনিটেই মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসির মঞ্চে তুলে গলায় ফাঁস পরানো হয়। আর এরপর ফাঁসি দিয়ে ঠিক রাত ১২টা ১০ মিনিটে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। দণ্ড কার্যকরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাত ১২টা ৩৫ মিনিটে নিজামীর লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য দুটি এ্যাম্বুলেন্স কারাগারে প্রবেশ করে। পরে রাত দেড়টার দিকে দুটি এ্যাম্বুলেন্স ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের হয়, যার একটির মধ্যে রয়েছে নিজামীর লাশ। এ সময় এ্যাম্বুলেন্স দুটির নিরাপত্তায় র‌্যাব ও পুলিশের ছয়টি গাড়ি নিয়োজিত ছিল। যথাযথ নিরাপত্তায় কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী নিজামীর লাশ পৌঁছে দেয়া হবে পাবনায় নিজামীর গ্রামের বাড়িতে। পরিবারের শেষ দেখা ॥ ফাঁসি কার্যকরের আগে শেষ দেখা করতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে গেছেন মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর স্বজনরা। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা ৫০ মিনিটে কারাফটকে পৌঁছান নিজামীর ২৬ জন স্বজন। এর ৫/৭ মিনিট পর প্রক্রিয়া শেষে কারাগারের ভেতরে যান তারা। স্বজনদের মধ্যে নিজামীর স্ত্রী শামসুন্নাহার নিজামী, বড় ছেলে ব্যারিস্টার নাজীব মোমেন, মেজ ছেলে ডাঃ খালেদ, মেয়ে, দুই পুত্রবধূ, চার ভাতিজা, এক চাচা, এক খালা, দুই বোন, এক ভাইসহ মোট ২৬ জন সদস্য রয়েছেন। কারাফটকে তাদের নিয়ে আসা গাড়ির ড্রাইভার বিষয়টি জানিয়েছেন। প্রথম গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো-চ ১৬-০২৫৭) ৫ জন, দ্বিতীয় গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো-চ ৫৩-১৪৬৪) ২ শিশুসহ ৭ জন ও তৃতীয় গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো ঘ-১১-৮৬৩৮) আরও ২ শিশুসহ ১৪ জন আসেন। প্রক্রিয়া শেষে ২৬ স্বজনকেই ভেতরে ঢুকতে দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। এর আগে সন্ধ্যা ছয়টা ৩৫ মিনিটে রাজধানীর বনানীর জে ব্লকের ১৮ নম্বর রোডের ৬০ নম্বর বাড়ি ‘মিশন নাহার’ থেকে তিনটি গাড়িতে কারাগারের পথে রওনা হন তারা। প্রাণভিক্ষা চাননি নিজামী ॥ যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদ-ে দ-িত মতিউর রহমান নিজামী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেননি জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, মৃত্যুদ- কার্যকর করতে আদেশ কারা কর্তৃপক্ষকে দেয়া হয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জামায়াত আমিরের মৃত্যুদ- কার্যকরের তোড়জোড়ের মধ্যে মঙ্গলবার রাত ৮টা ১০ মিনিটে মন্ত্রী এ কথা বলেন। স্বজনদের ডেকে পাঠানো এবং কারাফটকে নিরাপত্তা জোরদারের মধ্যে মঙ্গলবার নিজামীর মৃত্যুদ- কার্যকরের ইঙ্গিত মিললেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় তা নিশ্চিত হওয়া গেল। এর আগে আরও দুই কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেও বিফল হওয়ায় নিজামী আর সেই সুযোগ গ্রহণ করেননি বলে সূত্র জানিয়েছে। যেভাবে ফাঁসি কার্যকর ॥ রিভিউ রায়ের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ফাঁসির দড়ি এড়াতে নিজামীর সামনে একটাই পথ ছিল রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়া। মঙ্গলবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মাধ্যমে জানা যায়, তিনি ক্ষমা চাননি। এর আগে বিকেলেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কারাগারে পৌঁছায় নিজামীর ফাঁসি কার্যকর করতে সরকারের নির্বাহী আদেশ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সে আদেশও তাকে পড়ে শোনানো হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় ফাঁসি কার্যকরের চূড়ান্ত প্রস্তুতি। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেষ দেখা করার পর কনডেম সেলে গিয়ে নিজামীকে গোসল করিয়ে রাতের খাবার দেয়া হয়। স্বজনদের সাক্ষাতের পর কারাগারের মাওলানার মাধ্যমে তওবা পড়িয়ে নেন কারা কর্তৃপক্ষ। এ সময় তার কাছ থেকে তার শেষ কোন কথা থাকলে তাও শুনে নেন কারা কর্মকর্তারা। এরপর ধর্মীয় রীতি অনুসারে নিজামীকে তওবা পড়ান কেন্দ্রীয় কারাগারের পুকুরপাড় জামে মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মনির হোসেন। এর আগেই তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন করেন কারা চিকিৎসক ডাঃ বিপ্লব কান্তি পাল ও ডাঃ আহসান হাবীব। সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির রাতেই তার ফাঁসি কার্যকর করা হবে বলে নিজামীকে জানিয়ে দেন। তিনি বলেন, এটাই আপনার শেষ রাত। এখন আপনাকে তওবা পড়তে হবে। মাওলানা মনির হোসেন তাকে বলেন, আপনার কৃতকর্মের জন্য আদালত আপনাকে ফাঁসির রায় দিয়েছে। আপনি একজন মুসলমান। এ কারণে আপনি আল্লাহ’র এই দুনিয়ায় কৃতকর্মের জন্য তওবা করেন। এরপর ইমাম সাহেব তাকে তওবা পড়ান। তওবা পড়ার মিনিট চারেক পর কনডেম সেলে জল্লাদরা আসেন। রাত পৌনে বারোটার দিকে তারা নিজামীকে নিয়ে যান ফাঁসির মঞ্চে। আগে থেকেই মঞ্চের পাশে রাখা ছিল মরদেহ বহনের জন্য এ্যাম্বুলেন্স। ফাঁসির মঞ্চে নেয়ার পর তার মাথায় পরানো হয় একটি কালো রংয়ের টুপি। এই টুপিটিকে বলা হয় ‘যমটুপি’। ফাঁসির মঞ্চে তোলার পর নিজামীর দুই হাত পেছন দিকে বাঁধা হয়। এ সময় ফাঁসির মঞ্চের সামনে উপস্থিত ছিলেন কারা কর্তৃপক্ষ, সিভিল সার্জন ও একজন ম্যাজিস্ট্রেট। ফাঁসির মঞ্চে প্রস্তুত ছিলেন জল্লাদও। মঞ্চে তোলার পর তার দুই পা-ও বাঁধা হয়। পরানো হয় ফাঁসির দড়ি। কারা কর্তৃপক্ষের হাতে ছিল একটি রুমাল। রুমালটি হাত থেকে নিচে ফেলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জল্লাদ ফাঁসির মঞ্চের লিভারে টান দেন। লিভারটি টান দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফাঁসির মঞ্চের নিচে চলে যান নিজামী। এ সময় তিনি মাটি থেকে ৪-৫ ফুট শূন্যে ঝুলে থাকেন। এতে মুহূর্তের মধ্যেই তার ঘাড়ের হাড় ভেঙ্গে মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে যায়। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর মরদেহ তোলার পর কারা চিকিৎসক ডাঃ বিপ্লব কুমার ও ডাঃ আহসান হাবীব, ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন ডাঃ আবদুল মালেক মৃধার তত্ত্বাবধানে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন। এ সময় তার ঘাড়ের রগ কাটা হয়। নিজামীর ফাঁসির লিভারে টান দিয়ে ঐতিহাসিক এ দায়িত্ব পালন করেন প্রধান জল্লাদ রাজু। অন্য তিনজন জল্লাদ ছিলেন তার সহযোগী। এরা হলেন- মাসুম, আবুল ও ইকবাল। জল্লাদ রাজু এর আগে মুজাহিদ ও কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকরেও জল্লাদের ভূমিকা পালন করেন। ফাঁসি কার্যকর করার সময় ফাঁসির মঞ্চে ও কারাগারের ভেতরে ছিলেন অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল মোঃ ইকবাল, ঢাকার জেলা প্রশাসক (ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট) মোঃ সালাউদ্দিন, ঢাকার সিভিল সার্জন ডাঃ আব্দুল মালেক মৃধা, ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ, কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির, জেলার নেসার আলম, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (পশ্চিম) শেখ নাজমুল আলম, র‌্যাবের পক্ষ থেকে একজন এবং ডেপুটি জেলার। ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার শেখ মারুফ হাসানের নেতৃত্বে পুলিশের ১২ সদস্যের দলও ছিলেন কারাগারের ভেতরে-বাইরে। কারাগারে বাড়তি নিরাপত্তা ॥ যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ- কার্যকর নিয়ে আলোচনার মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে, ভিড় বেড়েছে সাংবাদিকদের। মঙ্গলবার কারাফটক ও আশপাশের এলাকায় বাড়তি পুলিশ নিয়োজিত করা হয়। নিরাপত্তায় রয়েছে র‌্যাব সদস্যরাও। লালবাগ বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সঞ্জীব কুমার রায় জনকণ্ঠকে বলেন, যেহেতু কারাগারের ভেতরে একজন ফাঁসির দ-প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী রয়েছেন এবং কারাগারের ফটকে শতাধিক সংবাদকর্মী ভিড় করেছেন তাই আমরা বাড়তি পুলিশ নিয়োজিত করেছি। এছাড়া কারাগারের দেয়ালের চারদিকে নিরাপত্তা বাড়িয়েছি। ফাঁসি সংশ্লিষ্টদের বৈঠক ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের চূড়ান্ত প্রস্তুতি হিসেবে এর আগে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে জরুরী বৈঠক শেষ হয়। মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর বকশীবাজার কারা অধিদফতরে ফাঁসির প্রস্তুতি নিয়ে এ জরুরী বৈঠক করেন কারা কর্মকর্তারা। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল মোঃ ইকবাল, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি গোলাম হায়দার, কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির, জেলার নেসার আলমসহ বেশ কয়েক কারা কর্মকর্তা। সাকা-মুজাহিদের মঞ্চেই ফাঁসি ॥ যে মঞ্চে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল দুই কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদকে, সেই একই মঞ্চেই ফাঁসির দড়িতে ঝুলানো হয়েছে নিজামীকে। দাফনের প্রস্তুতিও সম্পন্ন ॥ মন্মথপুর গ্রাম। পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ধোপাদহ ইউনিয়নের একটি গ্রাম। এটি যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর নিজ গ্রাম। এ গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে নিজামীর লাশ দাফন করার কথা রয়েছে। পরিবার ও স্বজনরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সে অনুযায়ী মন্মথপুর গ্রামে অবস্থিত পারিবারিক কবরস্থানে কবরও খোড়া হয়েছে। নিজামীর ভাতিজা শহিদুল হক, চাচাত ভাই বাচ্চু খান জানান, মৃত লুৎফর রহমানের ৩ ছেলে মেয়ের মধ্যে নিজামী সবার ছোট। ছায়া খাতুন ও হাজরা খাতুন নামে তার দুই বড় বোন রয়েছেন। এর মধ্যে হাজরা খাতুন অনেক আগেই মারা গেছেন। তারা আরও জানান, পৈত্রিক সম্পত্তি বলতে গ্রামে তার একটি টিনের ঘেরা ও ছাউনি বিশিষ্ট একটি বাড়ি রয়েছে। এছাড়া একটি পারিবারিক কবরস্থান রয়েছে। সেই কবরস্থানে নিজামীর দাদা, বাবা, মা, বোনসহ সব স্বজনের কবর দেয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী এখানে নিজামীর লাশ দাফন করার কথা রয়েছে। যে অভিযোগে দ- ॥ আট অভিযোগে তিনি (নিজামী) ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন, তার মধ্যে ১, ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে তিনি খালাস পেয়েছেন। আর ২, ৬, ৭, ৮ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে তার দ- বহাল রয়েছে। এর মধ্যে ২, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে পাবনার বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে পাকিস্তানী সেনারা হত্যা ও ৩০-৪০ নারীকে ধর্ষণ; পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা এবং পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী গণহত্যার দায়ে নিজামীর ফাঁসির রায় বহাল রেখেছে আপীল বিভাগ। ৪ নম্বর অভিযোগে পাবনার করমজা গ্রামে নয়জনকে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদ- হলেও আপীলে তিনি খালাস পেয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ে ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে আটক, নির্যাতন, হত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও সংঘটনে সহযোগিতার চারটি অভিযোগে নিজামীকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়েছিল। সর্বোচ্চ আদালত প্রথম দুটিতে খালাস দিয়ে পরের দুটিতে সাজা বহাল রেখেছে। নিজামীর দ- পঞ্চম ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে নিজামীর দ- হবে আপীল বিভাগের নিষ্পত্তিকৃত মামলাগুলোর মধ্যে পঞ্চম। এর আগে ৪ জনের দ- কার্যকর করা হয়েছে। তারা হলেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী । বিচার কার্যক্রম ॥ মতিউর রহমান নিজামীকে ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে একই বছরের ২১ জুলাই তদন্ত শুরু হয়। ২০১০ সালের ২ আগস্ট মানবতাবিরোধী মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। একই বছরের ১১ ডিসেম্বর ফরমাল চার্জ আদালতে উপস্থাপন। হত্যা, গণহত্যা ধর্ষণসহ ১৬টি অভিযোগ গঠন ২০১২ সালের ৮ মে। প্রথম দফায় প্রসিকিউশন পক্ষ ২০১৩ সালের ৩ নবেম্বর থেকে ৬ নবেম্বর পর্যন্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। এরপর ৭ নবেম্বর থেকে চার দিন আসামিপক্ষের যুক্তিতর্কের জন্য দিন রাখা হলেও তারা নিজামীর আইনজীবীরা আসেননি। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১৩ নবেম্বর নিজামীর পক্ষের সিনিয়র আইনজীবীরা আদালতে না আসায় মামলার রায় যে কোন দিন দেয়া হবে মর্মে অপেক্ষমাণ (সিএভি) রেখে দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর ১৪ নবেম্বর আসামিপক্ষের আইনজীবীরা ট্রাইব্যুনালের আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। ওই আবেদনের শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল ফের যুক্তি উপস্থাপনের সময় দেন। ১৯ নবেম্বর নিজামীর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন সম্পন্ন করেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। ২০ নবেম্বর আসামিপক্ষের আইনজীবী যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। এর পর ট্রাইব্যুনাল ২০ নবেম্বর আদেশে ১৩ নবেম্বরের সিএভি আদেশই বহাল রাখেন। দ্বিতীয় দফায় প্রসিকিউশন পক্ষ ১০, ১১ ও ১২ মার্চ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। আর আসামিপক্ষ ১২, ১৯, ২০ ও ২৩ মার্চ চার দিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। আসামিপক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ২৩ মার্চ শেষে প্রসিকিউশন পক্ষ পাল্টা যুক্তিতর্ক শুরু করেন। ২৪ মার্চ ২০১৪ সালে যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়। বিচার শেষে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল যে রায় দেন তাতে প্রসিকিউশনের আনা ১৬ অভিযোগের মধ্যে আটটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এই আট অভিযোগের মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর ঘটনায় নিজামীর ফাঁসির রায় হয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ২৩ নবেম্বর সর্বোচ্চ আদালতে আপীল করেন নিজামী। পরে গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর নিজামীর মামলায় শুনানি শুরু হয়ে চলে ২৫ নবেম্বর পর্যন্ত। পরে ৩০ নবেম্বর নিজামীর আপীলের যুক্তিতর্ক শুরু করে ২ ডিসেম্বর আসামিপক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করে। পরে চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি আপীলের রায় প্রদান করা হয়। একই বছরের ১৫ মার্চ আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ নিজামীর মৃত্যুপরোয়ানা জারি করেন। পরে নিজামী রিভিউ আবেদন দাখিল করতে মৃত্যুপরোয়ানার কার্যক্রম স্থগিত থাকে। গত ৫ মে মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ খারিজ করে দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপীল বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এক শব্দের এই রায় ঘোষণা করেন।
×