ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মূল হত্যাকাণ্ডে ছিল পাঁচজন ;###;ঘটনাস্থল রেকি করে একাধিকবার

কলাবাগান জোড়া খুনের হত্যাকারীরা দক্ষ ও প্রশিক্ষিত

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৭ এপ্রিল ২০১৬

কলাবাগান জোড়া খুনের হত্যাকারীরা দক্ষ ও প্রশিক্ষিত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির খালাতো ভাই ও বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া ব্লোম বার্নিকাটের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা এবং বর্তমানে ইউএসএইডে কর্মরত জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়কে। তনয় হত্যার টার্গেটে ছিল কিনা সে বিষয়টি এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি তদন্তকারীরা। পরিস্থিতির শিকার হতে পারেন তনয়। হত্যাকা-ে সব মিলিয়ে অন্তত ৭ থেকে অন্তত ৮ জন জড়িত ছিল। তবে মূল হত্যাকা- ঘটায় ৫ জনে। হত্যাকারীরা দক্ষ। এ ঘটনায় পৃথক ২টি মামলা দায়ের হয়েছে। জঙ্গীরা হত্যাকা-টি ঘটিয়েছে বলে অনেকটাই নিশ্চিত তদন্তকারী সংস্থাগুলো। ঘটনাস্থলের আশপাশের বাসার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত আলামতের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। ইতোমধ্যেই আনসার আল ইসলামের নামে হত্যার দায় শিকার করে বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে। হত্যাকা-ের তদন্তে সহযোগিতা করার প্রস্তাব দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। এদিকে হত্যাকা-ের ঘটনায় ২৪ মে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে ঢাকার সিএমএম আদালত। মঙ্গলবার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক, ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলামসহ উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, এটি একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকা-। হত্যাকারীরা ঘটনা ঘটানোর আগে একাধিকবার ঘটনাস্থল রেকি করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। হত্যাকারীরা প্রশিক্ষিত। এ হত্যাকা-ের সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হত্যাকা-ের মিল রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, কোন জঙ্গী গোষ্ঠী হত্যাকা-টি ঘটিয়ে থাকতে পারে। তবে তদন্ত শেষে এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত করে বলা যাবে। রাজশাহীতে শিক্ষক হত্যার ঘটনার তদন্তে অনেক অগ্রগতি হয়েছে বলেও দাবি করেন পুলিশ প্রধান। কলাবাগানে হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে নানামুখী তৎপরতা চলছে। বলেন, জায়গাটা সিকিউ। আশপাশে প্ররোধ করা গেলে খুনীদের আটক করা সম্ভব হতো। পুশের কাজ অপরাধীকে ধরে আইনের আওতায় আনা। সে কাজ আন্তরিকতার সঙ্গে করা হবে। জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদে ‘জিরো টলারেন্স’ রয়েছে। দেশকে যারা অস্থির করতে চায়, তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে প্ররোধে এগিয়ে আসতে হবে। পুলিশের পক্ষে ঘরে ঘরে পাহারা দেয়া সম্ভব নয়। তাই সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যার যার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবারই ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী হতে হবে। তাহলেই পুলিশের পক্ষে নিরাপত্তা দেয়া সহজ হবে। দুপুর একটার দিকে দীপু মনি বেরিয়ে যান। তবে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কোন কথা বলেননি। ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার হিসেবে দায়িত্বরত পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন জানান, ৬ যুবকের তিনজন হাতে পার্সেল নিয়ে বাসায় ঢুকে। তারা নিজেদের কুরিয়ার সার্ভিসের লোক বলে পরিচয় দেয়। এ সময় নিরাপত্তাকর্মী পারভেজ মোল্লা (২০) বাধা দিলে তাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। জুলহাস দরজা খুললে জোর করে ঘরে ঢুকেই তাকে ও তনয়কে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। পরে ফেলে যাওয়া পার্সেলের প্যাকেটগুলোতে নারকেলের ছোবড়া ও কাগজ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, যুবকরা একই ড্রেস পরে গেছে। তাদের সবার পিঠে কালো ব্যাগ ছিল। বয়স আনুমানিক বিশ থেকে পঁচিশ বছরের মধ্যে। ঘটনার পর যুবকরা পিস্তল উঁচিয়ে আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে হেঁটে চলে যায়। ডাকাত ভেবে পিছু নিলে আইডিয়াল কমার্স কলেজের ছাত্র আনোয়ার হোসেন লিংকনকে (১৮) চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আহত করে। কলাবাগান থানার এসআই শামীম আহমেদের নেতৃত্বে থাকা টহল পুলিশের দলের সঙ্গে হত্যাকারীদের গোলাগুলি হয়। এসআই শামীম আহমেদ জানান, মূল রাস্তায় গেলে তারা হত্যাকারীদের ধাওয়া করে ধরার চেষ্টা করেন। সহকারী পুলিশ পরিদর্শক মমতাজ হোসেন একজনকে ঝাপটে ধরেন। অন্য এক হত্যাকারী মমতাজের ডান হাতে ও মাথার বাম দিকে চাপাতি দিয়ে মারাত্মক আঘাত করে। আরও একজন মমতাজকে কোপাতে গেলে তিনি পিস্তল দিয়ে হামলাকারীকে লক্ষ্য করে গুলি চালান। এ সময় এক পুলিশ সদস্যও শর্টগান থেকেও গুলি চালায়। হত্যাকারীরাও তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এক পর্যায়ে হত্যাকারীরা পালানোর জন্য দৌড় দিলে তিনি একজনকে ঝাপটে ধরেন। পেছন থেকে ঝাপটে ধরায় ওই হত্যাকারীর ব্যাগটি হাতে থাকলেও হত্যাকারীরা পালিয়ে যায়। পরে ব্যাগ তল্লাশি করে আমেরিকার তৈরি সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ বোরের একটি অটোমেটিক পিস্তল, ৫ রাউন্ড বুলেট, ম্যাগাজিন, গোলাকৃতির আগ্নেয়াস্ত্র, চাপাতি, লাল চেক গামছা, পুরনো লুঙ্গি, কাপড়ের টুপি, বাংলা ও আরবী লেখা সাদা কাগজের টুকরো ও অফিশিয়াল ব্যাগ পাওয়া যায়। তদন্তকারী সূত্রে জানা গেছে, হত্যার পর সাধারণ মানুষের বেশ ধরতেই হত্যাকারীরা তাদের ব্যাগে লুঙ্গি ও গামছা রেখেছিল। কলাবাগান থানার ওসি ইকবাল হোসেন জানান, হত্যাকা-ের ঘটনায় নিহত জুলহাসের বড় ভাই মিনহাজ মান্নান ইমন একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় অজ্ঞাত ৫/৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত কেউ গ্রেফতার হয়নি। এদিকে মঙ্গলবার লাশের ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, হত্যাকারীরা প্রশিক্ষিত। তারা কোথায় আঘাত করলে দ্রুত মৃত্যু হয়, সেই প্রশিক্ষণ নিয়েই খুনীরা হত্যাকা- দুইটি ঘটিয়েছে। ইতোপূর্বে ব্লগার ও প্রকাশকসহ যাদের হত্যা করা হয়েছে, প্রত্যেকের একই জায়গায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। দু’জনেরই ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছে। এ ধরনের আঘাতের পর কারও বেঁচে যাওয়া সম্ভব নয়। একই স্থানে উপর্যুপরি কয়েকটি আঘাত ছিল। আঘাতে মাথার খুলি কেটে মগজ পর্যন্ত পৌঁছেছে। তনয়ের স্পাইনাল কর্ড ছিঁড়ে গেছে। একই স্থানে অন্তত তিনটি আঘাত করলে মগজ স্পর্শ করে। খুনীরা ভাল করেই জানে এবং জেনেই আঘাতগুলো করেছে। এরপর দুপুর একটার দিকে লাশ দুইটি পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। জুলহাসের প্রথম জানাযা হয় বাসার কাছে তেঁতুলতলা মাঠে। আর দ্বিতীয় জানাযা হয় মার্কিন দূতাবাস কার্যালয়ে। জুলহাসকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। আর খন্দকার মহবুব রাব্বী তনয়ের পিতার নাম খন্দকার নূর রাব্বী। বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানাধীন সারাপুর গ্রামে। তিনি পরিবারের সঙ্গে রাজধানীর মিরপুর থানাধীন পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ৭১৩ নম্বর তালুকদার ম্যানশনের ছয়তলায় বসবাস করতেন। জানাযা শেষে তাকে মিরপুরে দাফন করা হয়। ডিএমপি কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, হত্যাকারীরা জুলহাসকে খুন করতেই এসেছিল। সেক্ষেত্রে জুলহাজের সঙ্গে থাকার কারণেই তনয় পরিস্থিতির শিকার হয়ে খুন হতে পারে। আমাদের কোর্ট রিপোর্টার জানান, কলাবাগানে জোড়া খুনের ঘটনায় দায়ের করা দুই মামলায় ২৪ মে পুলিশকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলেছে ঢাকার সিএমএম আদালত। পরিবার ও পুলিশের দায়ের করা এ দুই মামলার এজাহার মঙ্গলবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে পাঠানো হলে হাকিম নুরুন্নাহার ইয়াসমিন এই তারিখ নির্ধারণ করেন। ওদিকে জুলহাসের বড় ভাই মিনহাজ মান্নান ইমন হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। এদিকে হত্যাকা-ের একদিনের মাথায় মঙ্গলবার বিকেলে আল কায়েদা ভারতীয় উপমহাদেশ (একিউআইএস) শাখা হত্যার দায় স্বীকার করেছে বলে খবর দিয়েছে জঙ্গী তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী ওয়েবসাইট সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ। এর আগেই একিউআইএসের বাংলাদেশ শাখা আনসার আল ইসলামের মুখপাত্র মুফতি আব্দুল্লাহ আশরাফের নামে টুইটারে দেয়া এক বিবৃতিতে হত্যার দায় স্বীকার করে বলেছে, ‘তাদের দুঃসাহসী মুজাহিদীনরা এই দুজনকে হত্যা করেছে’। বিবৃতিতে জুলহাজ মান্নানকে ‘বাংলাদেশে সমকামিতা প্রসারের পথিকৃৎ’ ও ‘সমকামীদের গুপ্ত সংগঠন রূপবানের পরিচালক’ হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়েছে। আর তনয়কে জুলহাজের সহযোগী হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ক্রুসেডার আমেরিকা ও তার ভারতীয় মিত্রদের সাহায্য নিয়ে ১৯৯৮ সাল থেকে এই ভূখ-ের অধিবাসীদের মাঝে সমকামিতার মতো জঘন্য অশ্লীলতা ছড়িয়ে দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছিল এই বেতনভোগী ভৃত্যদ্বয়। সোমবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ৩৫ নম্বর লেক সার্কাস কলাবাগানের আছিয়া নিবাস নামের সাততলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনির খালাতো ভাই জুলহাজ মান্নান (৪২) ও তার বন্ধু খন্দকার মাহবুব রাব্বী তনয়কে (৩২) এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।
×