ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দুর্নীতি, সন্ত্রাসসহ পাঁচ বাধা উন্নয়নে

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২৪ এপ্রিল ২০১৬

দুর্নীতি, সন্ত্রাসসহ পাঁচ বাধা উন্নয়নে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশের উন্নয়নে পাঁচটি বাধা রয়েছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। এগুলো হচ্ছে- দুর্নীতি, সন্ত্রাসী কর্মকা-, জলবায়ু পরিবর্তন, দ্রুত নগরায়ন এবং শিক্ষিত বেকার। উন্নয়ন এগিয়ে নিতে হলে এ বিষয়গুলোর দিকে বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন। বিআইডিএস ক্রিটিক্যাল কনভারসেশন ২০১৬, দ্য ব্যাংলাদেশ জার্নি শীর্ষক দু’দিনের অর্থনৈতিক সম্মেলনে মূল প্রবন্ধে এসব বিষয় তুলে ধরেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. কেএস মুর্শিদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের গল্প সঠিকভাবে বলা হয় না। এ গল্প শক্তিশালী এবং সাফল্যময় গল্প, যা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের নজর কেড়েছে। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যে দেশ বিশ্বের অন্যতম পোশাক তৈরির হাব, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাফল্য এনেছে। তাছাড়া দারিদ্র্য নিরসন বিশেষ করে অতিদারিদ্র্য হ্রাসে সাফল্য এসেছে। বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মাইলফলক স্থাপন করতে পেরেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি অর্জন, বৈষম্য হ্রাস, মানবীয় জীবনযাপন, জন্মহার নিয়ন্ত্রণ, সবুজ বিপ্লব ও খাদ্য নিরাপত্তা, এনজিওদের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণের বিকাশ, রেমিটেন্স এবং শ্রমিক রফতানি, তৈরি পোশাক এবং অন্যান্য রফতানি পণ্য, স্বাস্থ্য অবকাঠামো স্থাপন, শিক্ষার মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় অগ্রগতি অর্জন করেছে। শনিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা পর্যালোচনা করতে বিআইডিএসের তাত্ত্বিক গবেষক, নীতিনির্ধারকদের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের মতামত জানতে এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, পরিকল্পনা বিভাগের সচিব তারিক-উল-ইসলাম এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর সৈয়দ সাদ আন্দালিব। প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, অব্যাহত উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা শূন্যে নেমে আসবে। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশে^ অর্থনীতিতে বাংলাদেশ হবে ২৩তম শক্তিশালী দেশ। আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে এ দেশের কৃষক, কামার, জেলে, তাঁতীসহ খেটে খাওয়া মানুষ। তিনি বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিয়ে কে কী বলছে তা নয় বরং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে আমরা কী করছি তার ওপর বিশ^াস রাখুন। প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে স্বপ্নরেখা সামনে রয়েছে বাংলাদেশ তা স্পর্শ করবেই। তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের অগ্রপথে জাহাজকে ডোবানোর এবং ভিন্ন পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। পরবর্তীতে নতুন নেতৃত্ব সেটাকে আবার সঠিক পথে নিয়েছে। এক সময় তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হতো, বাংলাদেশকে নানা রকম পরীক্ষাগার বানানো হয়েছিল, কিন্তু আমরা সে জায়গা থেকে উঠে এসেছি। অনেক কিছু অর্জন করেছি। আমরা ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেন। কিন্তু এটি ঠিক নয়। আমাদের এ অর্জনকে বড় করে দেখতে হবে। আমরা যা করছি সবকিছুর উপরে মানুষের মঙ্গলের জন্য। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্য। বর্তমান সরকার ২০২১ সালের মধ্যে কত বিদ্যুত প্রয়োজন হবে, ২০৩০ সালের মধ্যে কত এবং ২০৪০ সালের মধ্যে কত বিদ্যুত লাগবে সে বিষয়ে হিসাব করেছে। সেটি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু থেকে চলে গেছে। আমরা নিজেরাই কাজ শুরু করলাম। এর মাধ্যমে আমরা অনেক বড় হয়েছি। ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের জার্নি পথে মানুষের মন-মানসিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। গ্রামীণ রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক বৈষম্য হ্রাসে ভূমিকা রাখছে। কিন্তু পরিবর্তন আনতে হবে শিক্ষাক্ষেত্রে। মানসম্মত শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। তিনি বলেন, মধ্যম আয়ের দেশে যেতে হলে উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। মধ্যম আয়ের দেশে শুধু পুঁজিগতভাবে আয় করা নয়, মানসম্মত জীবনযাপনকেও বোঝায়। সামনের দশকে বাংলাদেশকে নতুন জার্নি শুরু করতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গ্রহণযোগ্য ও মানসম্মত নির্বাচন প্রয়োজন। তারিক-উল-ইসলাম বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম জার্নি, দ্বিতীয় জার্নি শুরু হয় স্বাধীনতার পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশকে তুলে আনা, তৃতীয় জার্নি শুরু হয় আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশকে যুক্ত করা এবং চতুর্থ জার্নি বর্তমানের অগ্রগতি। সব জার্নিতেই বাংলাদেশ সফল হয়েছে। আগামীর জার্নিতেও সফল হওয়ার জন্য এখন থেকেই কাজ শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, সরকার যেমন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র ও পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তেমনি অতিদারিদ্র্য উন্নয়নে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে। এর মাধ্যমে দেশে একটা পরিবর্তন আসবে। সাদ আন্দালিব বলেন, এখনকার জার্নি হচ্ছে তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করা, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য আমলাতান্ত্রিকতা দূর করা, দীর্ঘমেয়াদী খাদ্য নিরাপত্তা, অবকাঠামো উন্নয়ন, রফতানি পণ্য বহুমুখীকরণ, বিদ্যুত ও গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো, মানব উন্নয়নে কার্যকর শিক্ষা, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করা এবং ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টকে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা নেয়া। তাহলেই বাংলাদেশ কাক্সিক্ষত সাফল্যে পৌঁছাতে পারবে। পরবর্তীতে আরও দুটি সেশনে বাংলাদেশের শিক্ষা ও আঞ্চলিক কানেকটিভিটি নিয়ে আলোচনা হয়। দ্বিতীয় শেসনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের ড. আনোয়ারা বেগম। তিনি বিলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে অবশ্যই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। যে শিক্ষার মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন ঘটবে সে শিক্ষাকেই গুরুত্ব দিতে হবে। সেক্ষেত্রে কার্যকরভাবে শিক্ষা আইন এবং খসড়া শিক্ষা আইন ২০১৬ বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক শিক্ষা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিমূলক শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের পেশাদারিত্ব বাড়াতে বেতন বাড়ানো প্রয়োজন, শিক্ষক নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে কার্যকর মনিটরিং বোর্ড এবং প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। তৃতীয় সেশনে আঞ্চলিক কানেকটিভিটি বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মোহাম্মদ ইউনুস। তিনি বলেন, বাংলাদেশ হচ্ছে আঞ্চলিক হাব, যেটি বিশ্বের ৪০ শতাংশ মানুষের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে। বাংলাদেশ ভুটান, চীন, ভারত, মিয়ানমার এবং নেপালের মধ্যে যুক্ত রয়েছে নানা খাতভিত্তিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। যেমন- সার্ক, বিমসটেক, বিসিআইএম এবং বিবিআইএন-এমভিএ ইত্যাদি।
×