ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভারতকে জয়ের নায়ক বিরাট কোহলি

প্রকাশিত: ০৮:০৪, ২০ মার্চ ২০১৬

 ভারতকে জয়ের নায়ক বিরাট কোহলি

স্পোর্টস রিপোর্টার, কলকাতা থেকে ॥ শুরুতে তুমুল বেগে বাতাস বইতে থাকল। এরপর ভারতের আকাশ অন্ধকার করে ঝড় আসতে থাকল। তারপর ঝরল অঝর ধারায় বৃষ্টি। আড়াই ঘণ্টা আগে এমনই অবস্থা হলো, মনে হলো ভারত-পাকিস্তান ম্যাচটি হবেই না। সেই বৃষ্টি পৌনে এক ঘণ্টা পর থামল। ২ ওভার করে কেটে ১৮ ওভারে ম্যাচও হলো। কিন্তু ঝড় যেন পাকিস্তান ক্রিকেটারদের ওপর দিয়ে তখনও বইতে থাকল। ম্যাচ শেষ হতেই ঝড়ের সেই বহমান গতি থামল। কিন্তু ভারতের বিপক্ষে বিশ্বকাপে প্রথমবার জিতে ইতিহাস গড়ার স্বপ্ন যে এবারও দেখছিল পাকিস্তান, সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। বিরাট কোহলির ছবির মতো সাজানো অপরাজিত ৫৫ রানের ইনিংসে ৬ উইকেটের হারে স্বপ্নের অপমৃত্যু আবারও ঘটল। ম্যাচ শুরু হলো দেড় ঘণ্টা পর ৯টায়। তার ২০ মিনিট আগে টস হলো। তাতে ভারত জিতে গেল। ম্যাচ শুরু হওয়ার আগেই জয় মিলল। ম্যাচ শেষে জয়ের ধারা অব্যাহতই থাকল। এবার জয় মিলল ম্যাচে। পাকিস্তান আগে ব্যাট করে শোয়েব মালিকের ২৬, আহমেদ শেহজাদের ২৫ ও উমর আকমলের ২২ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ১৮ ওভারে ১১৮ রান করে। ভারত বোলাররা এতটাই চাপে রাখে পাকিস্তান ব্যাটসম্যানদের। মালিক, শেহজাদ ও উমর যদি কোনভাবে দ্রুত আউট হয়ে যেতেন, ভারতের পথ আরও সহজ হয়ে যেত। ভারত সেখানে কোহলির ৫৫ রানের সঙ্গে যুবরাজ সিংয়ের ২৪ রানে ১৫.৫ ওভারে ৪ উইকেট হারিয়ে ১১৯ রান করে জিতে। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার প্রথমবারের মতো ইডেন গার্ডেনে বিশ্বকাপের ম্যাচ হয়। ‘আনাচে-কানাচে’ ভরা স্টেডিয়ামের সিঁড়ি, রেলিংয়েও দর্শকরা ঠাঁই নেয়। বোঝা গেল, টিকেট ছাড়া এখানেও দর্শক ঢুকল এবং তাতে করে স্টেডিয়ামে দর্শক ধারণক্ষমতা যতই বলা হোক ৬৬ হাজার, তা এক লাফে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের চার ডবল, এক লাখে গিয়ে দাঁড়াল। আর ‘ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া’ বলে যে গর্জন উঠল; তাতে কান ঝালাপালা হয়ে যাওয়ার যোগাড় হলো। পাকিস্তান নির্বাক হয়ে থাকল। তাদের পক্ষে আওয়াজ তোলার যে কাউকেই মিলল না! তখনই আসলে পাকিস্তান ক্রিকেটাররা ‘দুর্বল’ হয়ে পড়ল। ক্রিকেট মানসিকতার খেলা। চাপের খেলা। যে দল মহাযুদ্ধে ¯œায়ুচাপ সামাল দিয়ে এগিয়ে যেতে পারে, তারাই শেষে জিতে। ভারত যেন কোন চাপ নিয়েই খেলল না। পুরো চাপ পাকিস্তান ক্রিকেটারদের গায়ে জড়িয়ে দিল। অথচ শুক্রবার ভিন্ন চিত্রই মিলেছিল। বাংলাদেশের বিপক্ষে দুর্দান্ত জয় পেয়ে পাকিস্তান যেন ভারতের বিপক্ষে খেলতে নামার আগে হেসে-খেলেই সময় কাটিয়ে দিল। অনুশীলনে সিরিয়াস হতে দেখা গেল না। একের সঙ্গে আরেকজন খুনসুটি করতেই বেশি দেখা গেল। ভাবখানা এমন, ‘ইডেন গার্ডেনে তো সব সময়ই নির্ধারিত ওভারে জয় আমাদেরই হয়। এবারও আমরাই তো জিতব।’ অথচ ভারত ক্রিকেটাররা ঠিক তার উল্টো পথে হেঁটেছেন। যতই বিশ্বকাপের ইতিহাস তাদের পক্ষেই থাকুক। পাকিস্তানকে বিশ্বকাপে একবারও জিততে না দেক, অনুশীলনে নামা থেকে শেষ পর্যন্ত সিরিয়াস থাকলেন ভারত ক্রিকেটাররা। ব্যাটিং-বোলিং-অনুশীলন পুরোদমে করে গেলেন। তার ফলও ভালভাবেই মিলল। বোলিং-ফিল্ডিংয়ে পাকিস্তান ব্যাটসম্যানদের চাপ দিতে থেকে খেলে গেলেন। ব্যাটিংয়ে ধীরে ধীরে কোন ঝুঁকি না নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলেন। ২৩ রানেই ৩ উইকেট পতন ঘটলেও বিরাট কোহলি ও যুবরাজ সিং মিলে দলকে ১২ ওভারে ৮৪ রানে নিয়ে গেলেন। এমন সময়ে যুবরাজ (২৪) আউট হলেন ঠিকই, কিন্তু কোহলি ম্যাচ জেতাতে উইকেটে আঁকড়ে থাকেন। শেষ পর্যন্ত অপরাজিতও থাকেন। ৩৭ বলে ৭ চার ও ১ ছক্কায় তার করা ৫৫ রানে ১৩ বল বাকি থাকতেই জয়ও মিলে যায় ভারতের। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার বিশ্বকাপের ফলাফলও ‘ভারত ১১-০ পাকিস্তান’ দাঁড়িয়ে গেল। ইডেন গার্ডেনে যে কখনই নির্ধারিত ওভারের ম্যাচে পাকিস্তানকে হারাতে পারেনি ভারত, সেই ইতিহাসও বদলালো। তবে ম্যাচ শুরু হওয়ার আগেই ইতিহাস রচনা করল ইডেন গার্ডেন। যা কখনও কোন দিন হয়নি; সেই কাজটিই করে দেখালেন এখন ইডেন গার্ডেনের ‘হর্তা-কর্তা’ ভারতের সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলী। একসঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটারদের মিলনমেলা ঘটিয়ে দিলেন। একটি মঞ্চ তৈরি করলেন। সেই মঞ্চের মাঝখানে কলকাতার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে দাঁড় করালেন। তার হাত দিয়ে চাদর ও ফুলের তোড়া দিয়ে সংবর্ধনা দিয়ে একপাশে দাঁড় করানো হলো ভারতের সাবেক ক্রিকেটার সুনীল গাভাস্কার, শচীন টেন্ডুলকার ও বীরেন্দর সেবাগকে এবং আরেক পাশে পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান, ওয়াসিম আকরাম ও ওয়াকার ইউনুসকে রাখলেন। সঙ্গে রাখলেন ভারতের সিনেমা জগতের ‘বাদশা’ অমিতাভ বচ্চন ও পাকিস্তানের গজল সম্রাট সাফকাত আমানত আলীকে। থাকলেন অমিতাভের ছেলে অভিষেক বচ্চনও। খেলা শুরু হওয়ার আগে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত গাইলেন অমিতাভ ও পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত গাইলেন সাফকাত। যা নতুনরূপেই সবার সামনে আবির্ভূত হলো। দুই দলের ক্রিকেটারদের দুই পাশে রেখে মাঝখানে দাঁড়িয়ে এ দুজনের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার আগে সংবর্ধনার পর পাকিস্তানের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ইমরান খান বললেন, ‘ভারতের মাটিতে ইডেন গার্ডেনে আমি শেষ ম্যাচটি খেলেছিলাম (১৯৮৯ সালে)। ম্যাচটিতে জিতেছিলাম। সে রকম কিছুই হোক আশা করি।’ ইডেন গার্ডেনে প্রথমবারের মতো ভারতের বিপক্ষে বিশ্বকাপের ম্যাচ খেলা পাকিস্তান জিতুক, সেই আশাই প্রকাশ করেন ইমরান। তার আশা পূরণ হয়নি। তবে ভারতের সেরা ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকর যে বলেছেন, ‘আশা করছি আবার বিশ্বকাপে আমরাই জিতব।’ তার সে আশা পূরণ করে দিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনিরা। ইমরান খান আরও বলেন, ‘কলকাতাবাসীকে ধন্যবাদ। ক্রিকেট আজ আমাদের এক মঞ্চে এনেছে। ইডেন যেন ক্রিকেটের আলোকিত অধ্যায় হয়ে থাকবে চিরদিন।’ এক মঞ্চে ঠিকই দুই দেশের সাবেক ক্রিকেটাররা দাঁড়ালেন। নিজেদের মধ্যে কুশল বিনিময়ও করলেন। কিন্তু ম্যাচ শুরু হতেই কী আর সেই এক হয়ে থাকা গেল। তখন তো আবার আলাদাই হয়ে যেতে হলো। রবীচন্দন অশ্বিন আগের দিন সংবাদ সম্মেলনেই বলে দিয়েছেন, ‘এ ম্যাচটি সীমান্ত দ্বন্দ্বের চেয়েও বড় কিছু। যেখানে ভারতের মানুষের আবেগ জড়িত।’ তা শুনে পাকিস্তান কোচ ওয়াকার ইউনুস বলেছেন, ‘ইতিহাসের বদলও হয়।’ কিন্তু কোথায়। সেই আবেগ, দ্বন্দ্বের বিষয়টি কী ভারত ক্রিকেটারদের মাথাতে থাকেনি। ভালভাবেই থেকেছে। তাই তো ভারত ক্রিকেটাররা যেন মহাযুদ্ধেই নেমেছিল। আর সব সময়ের মতো ভারতই বাজিমাত করেছে। নিজের দলের জয়ের কামনাই তো আসলে করেছেন ভারতের সাবেক ক্রিকেটাররাসহ সবাই। তাতে ভারতেরই জয়জয়কার হলো। উড়তে থাকা পাকিস্তানকে উড়িয়ে দিয়ে জিতল ভারতই।
×