ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ডা. ইমরান এইচ সরকার

ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও দেশ গড়ার আন্দোলনের তিন বছর

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও দেশ গড়ার আন্দোলনের তিন বছর

২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ দাঁড়িয়েছিল ইতিহাসের দায় মোচনের প্রশ্নে ইস্পাতসম দৃঢ়তা নিয়ে। শাহবাগের জনসমুদ্র থেকে এই আন্দোলন আজ ছড়িয়ে গেছে বিশ্বময়। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন সেই ইতিহাসেরই গর্বিত উত্তরাধিকার, যে ইতিহাস হাজার বছরের বাঙালীর হার না মানার দৃঢ় সংগ্রামের চিরন্তন ইতিহাস, যে ইতিহাস মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের ইতিহাস। গণজাগরণ মঞ্চ যে মিলনের মোহনায় এনে দাঁড় করিয়েছে এদেশের সর্বস্তরের মানুষকে, মুক্তির চিরন্তন আকাক্সক্ষার শপথে লাখ লাখ মানুষের শোণিতধারায় বাজিয়েছে যে মহাসঙ্গীত, সেই সঙ্গীতের সুরে বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়েছে ভূ-গোলকের এই ক্ষুদ্র অথচ আত্মমর্যাদায় সূর্যপ্রতিম জনপদটির দিকে। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার নৃশংস গণহত্যাসহ অন্যান্য অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হওয়ার পরও লঘু দণ্ড ঘোষিত হলে সারা বাংলায় প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। গণমানুষের এক অনন্য উদ্বোধনে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা বাঙালীদের মাঝে। দিন গড়াতে থাকলে শাহবাগই হয়ে উঠে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ছাত্র-যুব সংগঠনগুলোসহ সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে গড়ে উঠে গণজাগরণ মঞ্চ। ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় আমাদের প্রথম মহাসমাবেশ। সেদিনের জনস্রোত, উদ্বেল সেøাগান আর শপথের অবিনশ্বর শব্দমাল্য ইতিহাসের এক অনন্য সূর্যোদয়। ১০ ফেব্রুয়ারি মহান জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পীকার আবদুল হামিদের কাছে সুনির্দিষ্ট ছয় দফা দাবি সংবলিত স্মারকলিপি প্রদান করে গণজাগরণ মঞ্চ। ছয় দফা দাবিগুলো ছিলÑ ১. অবিলম্বে কাদের মোল্লাসহ একাত্তরের ঘাতক দালাল সকল যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে; ২. কাদের মোল্লার বিচারের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দাবি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে বিবাদীপক্ষের মতো রাষ্ট্রপক্ষও যাতে সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য আপীল করতে পারে; ৩. বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এবং যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী জামায়াত-শিবিরসহ ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে; ৪. যেসব রাজনৈতিক দল, শক্তি, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার চেষ্টা করছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করছে এবং তাদের সঙ্গে আঁতাত করছে, তাদেরও আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে; ৫. ’৭৫-এর পরে সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন যে সমস্ত যুদ্ধাপরাধী রাজাকার আলবদরকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে তাদের সকলকে পুনরায় গ্রেফতার করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের আওতায় আনতে হবে; ৬. যুদ্ধাপরাধীদের বিভিন্ন ব্যবসায়ী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হবে। জামায়াত-শিবিরের দেশী-বিদেশী সকল আয়ের উৎস খুঁজে বের করে বন্ধ করতে হবে। উল্লিখিত ছয় দফার মধ্যে বেশ কয়েকটি দাবি পূরণ হলেও এখনও আমাদের দাবি সম্পূর্ণ পূরণ হয়নি। জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি এখনও নিষিদ্ধ হয়নি। তাদের আর্থিক উৎসগুলো সম্বন্ধে এখনও কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি রাষ্ট্র। তিন বছর দাবি আদায়ের জন্য যথেষ্ট সময় হতে পারত, যদি রাষ্ট্রযন্ত্র আন্তরিক থাকত। কিন্তু রাষ্ট্রের ভেতরেই যেহেতু আমরা দোদুল্যমানতা লক্ষ্য করছি, সেহেতু আন্দোলনের প্রশ্নে আপোসহীনভাবে এগিয়ে যাওয়াই হবে আমাদের আগামী দিনের প্রত্যয়। এই সুনির্দিষ্ট ছয় দফাকে সামনে রেখেই অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ভেদ-বৈষম্যহীন উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে গণজাগরণ মঞ্চ। চলমান এই আন্দোলনে গণজাগরণ মঞ্চের মূল প্রেরণাই ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। অহিংস চেতনাকে ধারণ করে রাজনীতির মৌলিক প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আপোসহীন রাখার আন্দোলন আমরা করছি। গণজাগরণ মঞ্চ থেকে বারবার বলা হয়েছে, দেশের সরকারী বা বিরোধী দলÑ যারাই রাজনীতি করুক না কেন, মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনায় তাদের কোন দ্বিমত থাকতে পারে না। অর্থাৎ, সরকারী বা বিরোধী দলসহ বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে হতে হবে স্বাধীনতার পক্ষের। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যে গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র কাঠামোর কথা বলা হয়েছে, স্বাধীনতার চেতনার সেই কাক্সিক্ষত রাষ্ট্র গঠনের লড়াই এখনও চালিয়ে যাচ্ছে গণজাগরণ মঞ্চ। রাষ্ট্রে ক্রিয়াশীল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী যে দর্শন, তাকে পরাজিত করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ দিয়েই। তাই গণজাগরণ মঞ্চ গত তিন বছরে বেশ কয়েকটি রোডমার্চ করেছে, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে প্রান্তিক মানুষের কাছে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের দর্শন পৌঁছে দেয়ার কাজ করেছে। এই অব্যাহত কর্মধারা পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করেছি, সামাজিক বৈষম্যের সুযোগে একদিকে যেমন রাজনীতিতে বাড়ছে দুর্বৃত্তায়ন, কালো টাকার প্রভাব, তেমনি আমাদের প্রান্তিক মানুষ সুশিক্ষা আর বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা-চেতনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। সেই শূন্যস্থান পূরণ করছে মৌলবাদী অপশক্তি। তারা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিষবাষ্প ছড়িয়ে ভয়ঙ্করভাবে আক্রান্ত করছে সাধারণ মানুষের চিন্তার গতিপথকে। তাই আমরা ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ অব্যাহত রেখেছি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস আর জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে। আমরা বিশ্বাস করি, বিজ্ঞানভিত্তিক ও কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মৌলবাদ কখনোই মাথাচাড়া দিতে পারে না। সেই লক্ষ্যে কার্যকর গণতন্ত্রায়নের জন্য যেমন গণজাগরণ মঞ্চ ভূমিকা পালন করছে, তেমনি রাজনৈতিক পথরেখায় স্বাধীনতাবিরোধী, জঙ্গীবাদ, মৌলবাদের আশ্রয়দাতারা যেন প্রবেশ করতে না পারে, সে সংগ্রামও অব্যাহত রেখেছে। সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নেও গণজাগরণ মঞ্চ সচেতন থেকেছে সব সময়। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে গণজাগরণ মঞ্চ তার সবটুকু সাধ্য নিয়ে কাজ করে। ফিল্ড হাসপাতাল পরিচালনা, রেসকিউ টিম গঠন, উদ্ধার তৎপরতায় নিয়মিত বাহিনীকে সহযোগিতাসহ নানা ধরনের কাজ করেছে। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, রাষ্ট্রকে কল্যাণকর ও মানবিক হিসেবে গড়ে তোলার দায় কেবলই সরকারের নয়, সাধারণ মানুষেরও এতে অংশগ্রহণ প্রয়োজন। একইভাবে আমরা এও বিশ্বাস করি, জবাবদিহিতার প্রশ্নে স্বচ্ছতা ও সদিচ্ছা না থাকলে রাষ্ট্র কখনোই শক্তিশালী হতে পারে না। গণজাগরণ মঞ্চ বিশ্বাস করে মত-পথ-ধর্ম-বর্ণ-জাতি-লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান অধিকার ও মানবিক মর্যাদায়। তাই যখন পহেলা বৈশাখের জাতীয় ঐতিহ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয় নারী নিপীড়নের মাধ্যমে, গণজাগরণ মঞ্চ এর প্রতিবাদে রাজপথে নেমেছে। সারাদেশে একের পর এক মন্দির-মসজিদে হামলা, ভিন্নমতের মানুষের ওপর হামলা, বোমাবাজির বিরুদ্ধে গণজাগরণ মঞ্চ সোচ্চার থেকেছে সব সময়। গণজাগরণ মঞ্চ বিশ্বাস করে মানুষের চিন্তা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতায়। যখন আইনের অপপ্রয়োগ করে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, আর তার বলি হন প্রবীর শিকদারের মতো মানুষেরা, গণজাগরণ মঞ্চ প্রতিবাদে দাঁড়িয়েছে। এই তিন বছরের আন্দোলনে আমরা হারিয়েছি আমাদের অনেক সহযোদ্ধাকে। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি যখন বুঝতে পেরেছে তাদের সমূলে বিনাশ অনিবার্য, তখনই ন্যক্কারজনকভাবে তারা হত্যা করতে থাকে আমাদের সহযোদ্ধাদের। রাষ্ট্রযন্ত্রের চাপিয়ে দেয়া কালো আইন সাতান্ন ধারায় গ্রেফতার করা হয় চারজন ব্লগারকে। একদিকে শুরু“হয় স্বাধীনতাবিরোধীদের মুক্তচিন্তার মানুষ হত্যা, অন্যদিকে হত্যাকারীদের না ধরে মুক্তচিন্তা আর মত প্রকাশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্র সাতান্ন ধারায় জারি করতে থাকে একের পর এক ব্যারিকেড। মুক্তচিন্তার পথ রুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা যায় নাÑ এ সত্য গণজাগরণ মঞ্চ সুস্পষ্টভাবে তার প্রতিবাদে জানিয়েছে। আমাদের সহযোদ্ধা হত্যার বিচার এখনও সম্পন্ন করেনি রাষ্ট্র; আহত সহযোদ্ধারা ক্ষতচিহ্ন নিয়ে এখনও দুর্নিবার চালিয়ে যাচ্ছেন আন্দোলন। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় যে সুনির্দিষ্ট ছয় দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন আমরা শুরু করেছি ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, তা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবেই। জাফর মুন্সি, রাজীব হায়দার, আরিফ রায়হান দীপ, জগৎজ্যোতি তালুকদার, অভিজিত রায়, অনন্ত বিজয়, ওয়াশিকুর রহমান, নীলয় নীলÑ তাঁদের ত্যাগ আমাদের আগামী দিনের আন্দোলনের পথে অজেয় প্রেরণা। লেখক : গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র
×