ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাটকের জাদুকর

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

নাটকের জাদুকর

বহু বছর আগে যে প্রাঙ্গণে যিনি ছিলেন নিতান্তই দর্শনার্থী, আজ বহু বছর পরে এসে তিনি সেখানকার অতিথি। তাকে সংবর্ধনা দেয়া হবে বলে প্রাঙ্গণ সেজেছে, প্রাঙ্গণ নেচেছে! ‘সারাদিন বাড়িতেই আছি। যে কোন সময় চলে আসেন’- সকালে জানিয়েছিলেন নাট্যকার মাসুম রেজা। কিন্তু এই ‘যে কোন সময়’ যে দুপুর গড়িয়ে বিকেলের পথে হাঁটবে, সেটা হয়তো আন্দাজ করতে পারেননি তিনি। তাই মাঝে মধ্যে খোঁজ, ‘কতদূর?’ রাজধানীর মোহাম্মদপুরের যেখানে মাসুম রেজা থাকেন, জায়গাটা নিরিবিলি, ঝঞ্ঝাটমুক্ত। শৈল্পিকও। বিল্ডিংগুলোর নাম শুনলেই কান জুড়িয়ে যায়। এই যেমন মাসুম রেজার বিল্ডিংটার নাম ‘নীহারিকা’। বনলতা, শাপলা- এগুলোও আছে। প্রশ্ন তাই ঘোরা স্বাভাবিক, বিশেষ করে তিনি যখন আলাপে আলাপে জানিয়ে দেন, ফ্ল্যাটটি তার নিজের এবং এখানে আছেন দীর্ঘ বছর ধরে। বলা হয়, এই নামগুলোর পেছনে তার কোন হাত আছে কিনা! তিনি হাসেন, শব্দ করে, ছোট ড্রয়িংরুমজুড়ে তার হাসি ছড়িয়ে যায়। বলেন ‘আমি জানি না’। আগে এসব নামধাম ছিল না। বিদেশের মাটিতে বহু বছর কাটিয়ে দেশে এলেন যখন, দেখলেন কিছু আশ্চর্য সুন্দর নাম লেগে আছে গোটা প্রজেক্টের গায়ে। ফেসবুক খুলেই বসে ছিলেন মাসুম রেজা। কতজন কত কথা লিখছে! কত প্রশংসা, শুভকামনা! লাগছে ভাল? সেটাই তো স্বাভাবিক। ‘সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব পুরস্কার ঘোষণার পর বিতর্ক তৈরি হয়। একে দেয়া উচিত হয়নি, সে বেশি যোগ্য ছিল- এসব। আমার ক্ষেত্রে এমন কিছুই হয়নি। এটাই সবচেয়ে বেশি ভাল লাগছে’- সোফার এক কোনায় বসে বলছিলেন মাসুম রেজা। তার সোজাসুজি একটা টেবিল, ডেস্কটপ, আরও দু’তিনটি সোফা, বইয়ের তাক, তাকভর্তি বই। এখানে বসেই সেরা সেরা গল্পগুলো, চিত্রনাট্যগুলো লিখে ফেলেন? ‘সেরা’য় অত মনোযোগ দেন না, ইচ্ছাকৃত এড়িয়ে গিয়ে বলেন শুধু, ‘এটাই আমার ওয়ার্কিং স্টেশন’। পুরস্কারপ্রাপ্তির প্রথম খবরটাও এখানে বসে শুনেছিলেন মাসুম রেজা। তিনি রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি। ছাত্রজীবনে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে। পথে নেমেছেন, মিছিল করেছেন। তার গল্প, তার নাটক সংগ্রামে গতি ঢেলেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেই জড়িয়ে পড়েন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে। তিনি সাংগঠনিকও। যেখানেই থেকেছেনÑ কুষ্টিয়া, রাজশাহী, বিদেশ-বিভুঁইÑ নাট্যসংগঠন দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। সে সব দিনের গল্প শোনাচ্ছিলেন, ঠা-া স্বরে, থেমে থেমে। কিন্তু আমরা জানতে চাই তার নাটক লিখতে আসার গল্প। আর দশজন সৃজনশীল মানুষের ক্ষেত্রে যেটা হয়, কবিতা দিয়েই প্রথম শিল্পবোধটা বের হয়। মাসুম রেজারও একই অবস্থা ছিল। প্রথম জীবনে কবিতা লিখতেন। নাটক লেখার ইচ্ছা হলো প্রথম ঢাকায় আসার পর। হাতের তালুতে ছেড়ে দিয়ে থুতনির ভর, দৃষ্টি স্থির করে তার কুষ্টিয়া থেকে প্রথম ঢাকায় আসার গল্প শোনা হবে বলে অপেক্ষা। ‘বহু আগের কথা তো, ওই সময় একজন ঢাকায় আসবে, এটা নিয়ে মোটামুটি গ্রামে বেশ আলোচনা হতো ক’দিন ধরে। অনেক আলোচনার জন্ম দিয়ে আমি ঢাকায় এলাম ঘুরতে...।’ বেশিরভাগের তো ইচ্ছা থাকে জাদুঘরটা দেখবে, চিড়িয়াখানাটা, মাসুম রেজার ইচ্ছা ছিল দেখবেন বাংলা একাডেমি! কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় বাংলা একাডেমি দেখতে আসা একজন তরুণ, প্রথম ঢাকায় পা রাখা একজন কবি, খুব শান্ত পায়ে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ জুড়ে হাঁটছে, চোখ তার সম্পূর্ণটুকু মুগ্ধতা ঢেলে তাকিয়ে আছে প্রতিটি ইটে-গাছে-দেয়ালে। বহু বছর পরে এসেও মাসুম রেজার স্মৃতিতে ওই দৃশ্যগুলো, ছবিগুলো, স্মৃতিগুলো জ্বলজ্বলে হয়ে দেখা দেয়। দিচ্ছে ক’দিন ধরে আরও বেশি। ওইদিন সন্ধ্যায় তিনি প্রথম মঞ্চ নাটক দেখলেন, এবং বলে দিলেন, ‘এমন নাটক তো আমিও লিখতে পারি।’ সেই যে বলে ফিরে গেলেন কুষ্টিয়া, তারপর থেকে মাসুম রেজা নাটকের। নাটকেই বলছেন যা বলার। তার দর্শন, বিশ্বাস, ভাবনা- ছড়িয়ে পড়ছে নাটকের সংলাপজুড়ে, কাহিনীজুড়ে। দীর্ঘ বছর ধরে তিনি শুধু টিভি নাটকই লিখে যাচ্ছেন। তিনটি সিনেমার চিত্রনাট্যও অবশ্য বেরিয়েছে তার কলম থেকে। কিন্তু মাসুম রেজার পরিচিতি ছড়িয়েছে, উড়ে বেড়িয়েছে টিভি নাটক থেকেই। ‘আর কিছুই করিনি। আমাদের দেশে এখন খুব কম চিত্রনাট্যকারই আছেন, যারা শুধু লিখেই যাচ্ছেন। অনেকে পরিচালনা করছেন, অভিনয় করছেন’- কিন্তু মাসুম রেজাকে এসব কিছুই টানেনি। এত লেখা তার! সব কি আছে সংগ্রহে? তিনি একটি নিচু তাকের দিকে তাকালেন। সেখানে বহু বই। সবই মাসুম রেজার চিত্রনাট্যের সঙ্কলন। ‘আগে ছিল না। পরে অন্যান্যরা উদ্যোগ নিয়ে এই বইগুলো করেছে’- তিনি দেখান এবং ‘চা খাবে? আমি বানাই তাহলে’ বলে ভেতরে চলে যান। বহু বছর আগের সেই আগন্তুকের হাতে বাংলা একাডেমি এবার পদক তুলে দিয়েছে। নাটকে অবদানের জন্যই। লোকে বলে, তিনি টিভি নাটকের জাদুকর। জাদুকরই তো!
×