ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জাকারিয়া স্বপন

‘নরকের আগুনে’ পুড়ছে বাংলাদেশ!

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৪ জানুয়ারি ২০১৬

‘নরকের আগুনে’ পুড়ছে বাংলাদেশ!

২০১৬ সালে আমার প্রথম লেখা এটি। কিন্তু এমন একটি বিষয় নিয়ে এখনই লিখতে বসব তার জন্য মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। মাথায় যেহেতু বিষয়টি ঢুকেই গেছে, তাই সেটা নামিয়ে ফেলাই শ্রেয় বিধায় বছরের প্রথম দিনেই এটা নিয়ে লিখতে বসেছি। টেক্সাসের অস্টিন থেকে ফয়সাল আর শায়লা ঢাকায় এসেছে। স্বামী-স্ত্রী দু’জনই বুয়েটে আমার সহপাঠী এবং সেরা বন্ধু। জগতে কিছু মানুষ থাকে যাদের সঙ্গে কিভাবে যেন জীবন জড়িয়ে যায়, দীর্ঘদিন দেখা না হলেও সম্পর্কে কোন দূরত্ব তৈরি হয় না। সকাল-বিকেলের টানাপোড়েন সেই সম্পর্কে আঁচড় দেয় না। দেখা হলেই মন ভাল হয়ে যায়। যতটা সময় সঙ্গে থাকা যায় সেটুকুই যেন প্রাপ্তি। ঢাকায় পা দিয়েছে এটা জানার পর থেকেই মন ছুটে যাচ্ছিল কখন দেখা হবে। তারপর যখন ফোনে পাওয়া গেল তখন আর তর সইছে না। একবার দেখা হলো, তাতে মন ভরল না। কিন্তু দ্বিতীয়বার দেখার স্পট আর পাওয়া যায় না। তাদের আত্মীয়-স্বজনরা ভিড় করে থাকে। উপায়ান্তর না পেয়ে গভীর রাতে গিয়ে হানা দিলাম ওর বাসায়। ফয়সালদের বাসা ঢাকা কলেজ আর ল্যাবরেটরি স্কুলের মাঝ দিয়ে যে রাস্তা গিয়েছে (নায়েম রোড) তার শেষ মাথায়। মিরপুর রোড থেকে যেই মুহূর্তে ঢাকা কলেজের পাশে প্রবেশ করলাম বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল। গাড়ি আস্তে চালাতে শুরু করি। দেয়ালের প্রতিটি ইট যেন আমার চেনা, পাশের ড্রেনের ওপর যে মাছিগুলো উড়ে যাচ্ছে তারা যেন আমার পিছু নিয়েছে। ছোট ছোট গাছগুলো যে শীতের ধুলায় সাদাটে হয়ে আছে, কতদিন তাদের গোসল হয় না, স্ট্রিট লাইটের আলোতে সেই পাতাগুলো যেন অভিবাদন জানালো। আর বিশাল আকৃতির যে বৃক্ষগুলো ঝিরঝির শব্দে যা বলার চেষ্টা করছে তা শোনার জন্য গাড়ির গ্লাস নামিয়ে দিলাম। এই সেই রাস্তা, এই সেই কলেজ, এই সেই বিশাল গেট, এই সেই বৃক্ষরাজি- যাদের সঙ্গে আমার কলেজ জীবন কেটেছে। ঢাকা কলেজের কথা উঠলেই আমি আবেগতাড়িত হয়ে পড়ি। ময়মনসিংহ থেকে এসএসসি পাস করে একটি কালো ট্রাঙ্ক নিয়ে কাঁপা-কাঁপা বুকে হোস্টেলে উঠেছিলাম। আর সেদিনই ক্যাম্পাসে মারামারি লেগে গেল। ক্লাসের গ্যালারি থেকে দেখতে পেলাম লম্বা লাঠি, হকিস্টিক, রামদা নিয়ে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করছে ছাত্ররা। ঢাকা কলেজের যে ইতিহাস ছোটবেলা থেকে পড়ে পড়ে বড় হয়েছিলাম, যার মাটিতে পা রেখে নিজেকে ধন্য হব বলে মা-বাবার শেষটুকু নিয়ে ঢাকায় এসেছিলাম সেই ক্যাম্পাসে এই রণক্ষেত্র দেখে কিভাবে রিএ্যাক্ট করতে হবে তা ভুলে গেলাম। রাতে আরও ভয়াবহ ঘটনা ঘটল। নিজের রুমে গিয়ে দেখি খাটে বিছানা নেই। রুম অন্যদের দখলে। আমাদের থাকার জায়গা হলো মাটিতে তোশক বিছিয়ে। হয়ত বয়সের কারণেই হবে - তখন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা ছিল অসীম। ঢাকা কলেজ ইন্টারমিডিয়েটের জন্য বিখ্যাত। বোর্ডের বেশিরভাগ স্ট্যান্ড করে এই কলেজ থেকে। ইন্টারমিডিয়েট এবং ডিগ্রীর ছাত্রদের আলাদা থাকার জায়গা। কিন্তু আমাদের কিছু রুমে ডিগ্রীর ছাত্ররা জায়গা করে নিয়েছে। রাতে মশারি টানিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছি, তখনই পুরো ভবনটি ভীষণ শব্দ করে কেঁপে উঠল। হুড়মুড় করে উঠে সবাই বারান্দায়। অনেক মোটরসাইকেল নিচে মহড়া দিচ্ছে। আর কেউ একজন তিনতলায় এসে ওপর থেকে সিঁড়িঘরের মধ্যেই ককটেল ফাটিয়ে দিয়েছে। জীবনে এই প্রথম ককটেলের শব্দ এত কাছ থেকে উপভোগ করলাম। পরবর্তী সময় ঢাকা কলেজে আরও অনেক কিছুই দেখতে হয়েছে। অনেক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে কলেজ ক্যাম্পাস ছাড়তে হয়েছিল। পরবর্তীকালে আর খুব একটা যাওয়া হয়নি ঢাকা কলেজে। জানি না গ্যালারিগুলো এখন কেমন আছে, জানি না করিডোরগুলো কি নতুন গেঁয়ো ছাত্রদের পদদলিত হয়ে মুখরিত হয় কিনা। তবে এটুকু বলতে পারি, ঢাকা কলেজের যে সর্বনাশা অধঃপতন শুরু হয়েছিল তার শুরুটা আমরা পেয়েছিলাম। যে কারণে এখনও যদি ঢাকা কলেজের কোন প্রাক্তন ছাত্রকে দেখি প্রথমেই জিজ্ঞেস করিÑ কোন্ ইয়ার? ভেবেছিলাম জীবনের সবচে বড় অধঃপতনটি দেখে ফেলেছি। নাহ্, বাকি আছে আরও কিছুটা। দুই. নায়েম সড়কটির শেষ মাথা বন্ধ। তাই স্বাভাবিক গাড়ি চলাচল হয় না। যাদের প্রয়োজন শুধু তারাই ওই পর্যন্ত যায়। রাস্তা থাকে নিরিবিলি। কিন্তু কেউ কি অনুমান করতে পারেন সেই নিরিবিলি রাস্তার দিনের বেলার চিত্রটি কেমন? বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হই যে, ওই রাস্তাটির বেশিরভাগ ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্রদের দখলে থাকে। এটা হলো তাদের সিগারেট খাওয়া, আর নীলক্ষেত থেকে আনা চটি বই পড়ার জায়গা। তারা ওখানে নির্বিঘেœ উন্মুক্ত পরিবেশে সিগারেট ফুঁকছে। একজন দু’জন নয়- শত শত ছাত্র। এটাই হলো স্মার্টনেস। গাছের নিচে বসে চটি বই পড়ছে স্কুলের অসংখ্য ছাত্র। রাস্তার পাশ দিয়ে যারা হেঁটে যান তাদের নজরে এগুলো আসে। কেউ কিছু বলেন না। তারা দিনের আলোয় দেখতে পান ভবিষ্যত প্রজন্ম কোন্ দিকে যাচ্ছে। সেক্স নিয়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের এক ধরনের বালখিল্যতা আছে। তারা ‘সেক্স’ শব্দটি শুনলেই ভীষণভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি, তারা পুরো বিষয়টির ভেতরে পর্যন্ত যাননি। বর্তমানের ফেসবুককেন্দ্রিক মানুষের কোন বিষয়ের গভীরে যাওয়া এমনিতেও ধর্ম নয়, ক্ষমতাও নেই। বেশিরভাগ মানুষ কোন একটি বিষয়ের পূর্ব ধারণা নিয়েই তর্ক করতে থাকে। কিন্তু আমি মনে করি, সেক্স নিয়ে এত রিএ্যাক্ট করার কিছু নেই। সেক্স একটি প্রাকৃতিক বিষয়। এটা সম্পর্কে প্রতিটি মানুষের সঠিক জ্ঞান থাকাটা জরুরী। বিশেষ করে বর্তমান সময়ের ছেলেমেয়েদের কাছে যেভাবে তথ্য আসছে তাতে সঠিক তথ্যগুলো জানাটা জীবনের জন্য জরুরী। নইলে ভুল তথ্য নিয়ে উল্টাপাল্টা জীবনযাপনে নিজের জীবন তো যেতেই পারে, সঙ্গে আরও অসংখ্য মানুষের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। নীলক্ষেতে যে বইগুলো পাওয়া যায় সেগুলো সঠিক তথ্য দেয় না। এই ধরনের বই আমি ঢাকা কলেজে পড়ার সময়ও দেখেছি। এগুলো বাস্তব জীবনবিবর্জিত। এর মাধ্যমে আমাদের ছেলেমেয়েরা বরং ভুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারে। সেটা ঠেকানোর জন্য প্রয়োজন অভিভাবক এবং শিক্ষকদের আরও অগ্রসর হওয়া। এটাকে একটা টাবু হিসেবে রেখে দিয়ে, সমাজে অসুস্থ বিষয়কে বাহিত না করে এটার মুখোমুখি হওয়াটা জরুরী। তাদের সঠিক শিক্ষাটা দিতে পারলে এই বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সিগারেট? এই পৃথিবীতে যে কয়েকটি বিয়ষকে আমি ঘৃণা করি তার মধ্যে অন্যতম হলো সিগারেট। এর থেকে নোংরা কাজ সমাজে এত ব্যাপক আকারে আছে কিনা আমার সন্দেহ আছে। সিগারেট যে শুধু নিজের জীবনকেই নষ্ট করছে তা তো নয়। যারা আশপাশে আছে। তাদের জীবনকেও তো ধ্বংস করছে। অন্যের জীবন নষ্ট করার এই অধিকার তাদের কে দিয়েছে? তিন. বাংলাদেশের কতভাগ মানুষ সিগারেট কিংবা ধূমপানে অভ্যস্ত তা কেউ জানেন? আমাদের এই দেশে এগুলো নিয়ে কোন গবেষণা হয় না। তাই সঠিক তথ্য পাবার উপায় নেই। তবে কয়েকটি উদাহরণ দেই, তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে। আমার দীর্ঘদিনের একটি স্বপ্ন ছিল ধূমপানমুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করা। ছোট একটি প্রতিষ্ঠান; কিন্তু কেউ ধূমপান করে না। সেই আশা নিয়ে তৈরি করলাম প্রিয়.কম। আমি বেছে বেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ছেলেমেয়েদের চাকরি দেই দুটি কারণে। এক, এরা ফ্রেশ। এদের তৈরি করে নিতে পারলে নতুন কিছু করা সম্ভব। পুরনোদের ব্রেনে নতুন কিছু দেয়াটা খুব কঠিন। আর দ্বিতীয় কারণটি হলো, ফ্রেশ ছেলেমেয়েরা জীবনযাপনেও ফ্রেশ হবে। অন্তত ধূমপান করবে না। কিন্তু বিধি বাম। যেই চমৎকার ফ্রেশ ছেলেগুলোকে চাকরি দিলাম এই ভেবে যে, ওরা সিগারেট খায় না; দেখা গেল তাদের বড় একটি অংশ ধূমপানে অভ্যস্ত। মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছে, কিংবা এখনও ছাড়েনি; কিন্তু সিগারেট ফুঁকছে। আমার স্বপ্ন ধূলিসাত হয়ে গেল। তাদের বললাম, যদি খেতে হয় সামনেই খাও। লুকিয়ে কাজটি করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমি তো জানি, ভেতরে আমার কতটা রক্তক্ষরণ হচ্ছে। মিডিয়া প্রতিষ্ঠানে ধূমপান বন্ধে ব্যর্থ হয়ে এবারে হাত দিলাম সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে। হিউম্যান রিসোর্সের কর্মীদের বললাম, এই প্রতিষ্ঠান হবে ধূমপানহীন। আমরা ইঞ্জিনিয়ার নেব যারা সিগারেট খাবে না। অনেক উৎসাহে প্রায় ২৫ জনের মতো ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে ফেললাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে যে তথ্যটি ভেসে এলো তা হলো প্রায় অর্ধেকের বেশি ইঞ্জিনিয়ার নিয়মিত ধূমপান করে। এর বেশিরভাগই বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার। দেশের সবচেয়ে মেধাবী বলেই এদের আমরা জানি। কিন্তু কলেজ কিংবা বুয়েট জীবনে এসে সিগারেট ধরে ফেলেছে। কী করা যায় এদের নিয়ে? একদিন খুব মন খারাপ করে একজন সহকর্মীকে বললাম, আচ্ছা আমরা যদি বিজ্ঞাপনে লিখে দেই ‘ধূমপানহীন প্রতিষ্ঠান’ তাহলে কি আমরা যথেষ্ট ভাল সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পাব না? ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিল। এখন আমার সঙ্গে কাজ করতে এসেছে। হেসে দিয়ে বলল, ‘নাহ, পাবেন না। আমাদের যে সংখ্যক ভাল সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার দরকার তাদের মধ্যে নন-স্মোকার এত পাওয়া যাবে না।’ এর জবাবে কী বলা যেতে পারে আমার জানা ছিল না। চুপ করে থাকি। আর মনে মনে বলি, এ কোন্্ দেশে এসে পড়লাম আমি! ‘সিলিকন ভ্যালি’ যেহেতু আমার দ্বিতীয় শহর, তাই কিছু হলেই আমার চোখে ভেসে ওঠে ওখানকার ছবি। গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবতে থাকি, আচ্ছা ওখানে আমার বিল্ডিংয়ে কতজন কর্মী সিগারেট খেতেন? এখনও স্পষ্ট মনে আছে, একটি বিশাল ভবনে যেখানে ৩০০ থেকে ৫০০ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার কাজ করতেন, সেখানে হাতেগোনা কিছু মানুষকে দেখতাম নিচে ভবনের বাইরে এসে নির্দিষ্ট জায়গায় সিগারেট খেতেন। খুব বেশি হলে ১০, আরও বেশি হলে ২০, নয়ত ২৫ জন। এর বেশি তো অবশ্যই নয়। এবং তারা সব সময় সচেতন থাকতেন যেন তাদের সিগারেটের যন্ত্রণা অন্যদের সহ্য করতে না হয়। কাজের ভেতর ঘনঘন উঠে গিয়ে সিগারেট খেতেন না। মুখে বাজে গন্ধ নিয়ে মিটিংয়ে আসতেন না। এবং কেউ বিরক্ত হচ্ছে কি না, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি থাকত। আমাদের ভেতর সেই ভদ্রতাগুলো নেই, সৌজন্যবোধ নেই, অন্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন নেই। আমরা কোন রকম সঙ্কোচ ছাড়াই অন্যের মুখের ওপর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে পারি। আরেকটি মানুষকে যে এটা কতটা যন্ত্রণা দিচ্ছে সেটা বোঝার সামান্যতম বুদ্ধি এবং হৃদয় প্রকৃতি এদের দিয়েছে বলে আমার মনে হয় না। আমার ধারণা, বর্তমান বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ ধূমপান করে। আমি বিভিন্ন সময় আমার চারপাশে তাকিয়ে দেখিÑ বেশিরভাগ মানুষ ধূমপান করছে। তরুণ বয়েসী ছেলেদের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, এখন ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও সিগারেট খেতে শুরু করেছে। সমাজ এগোচ্ছে, মেয়েরা আর পিছিয়ে থাকে কিভাবে! প্রতিযোগিতায় তাদেরও নামা চাই। ঢাকা শহরে নাকি অনেক জায়গা তৈরি হয়েছে, যেখানে গিয়ে ইচ্ছেমতো সিগারেট খাওয়া যায়। ধূমপান করা না করা এটা ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু সংখ্যাটি এখন এতই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, এই সমাজে আপনি আর সুস্থ জীবনের কথা ভাবতেই পারেন না। রাস্তায় বের হন, দেখুন কিভাবে মানুষ ধূমপান করছে। যে শহরে এত নিকোটিন, সেই শহরে আপনি প্রাণভরে অক্সিজেন নেবেন কিভাবে? আর যদি অক্সিজেনই নিতে না পারেন তাহলে সেই জীবন কিসের জীবন? চার. আমরা যারা ধূমপান করি না তাদের কাছে বিষয়টি খুব খারাপ লাগলেও যারা করেন তাদেরও নিশ্চয়ই কোন কারণ রয়েছে। বেশ বড় অংশটিই হয়ত বলবেন, অভ্যাস। তবে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন, বাংলাদেশে জীবন অনেক বেশি স্ট্রেসফুল। এই স্ট্রেসের কারণে মানুষ ধূমপান করে থাকেন। ধূমপান করলে স্ট্রেস কমে তা হয়ত প্রমাণ করা যাবে না; তবে এক ধরনের সাময়িক প্রশান্তি হয়ত হয়। শরীর এবং ব্রেন নিশ্চয়ই নিকোটিন চায় এবং তারা দিনের পর দিন সেই নিকোটিনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দেন। প্রাপ্তবয়ষ্ক একজন মানুষ স্ট্রেস কমানোর জন্য ধূমপান করেন এটা হতে পারে। আর্থিক কষ্ট, কাজের চাপ, প্রেমিকার ধমক, স্ত্রীর দাবি, পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রত্যাশা, অফিসের বসের রক্তমাখা মুখ, তার সঙ্গে ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যাম- সবকিছু মিলিয়ে মানুষের স্ট্রেস তো আছেই। আর একটু ধূমপান হয়ত খানিকটা সময়ের জন্য তাদের ভিন্ন একটা প্রশান্তির জায়গায় নিয়ে যায়। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ ধূমপান শুরু করে তরুণ বয়সে। প্রাপ্তবয়সে এসে নতুন করে ধূমপান শুরু করেছেন এমন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি পাওয়া যাবে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ টিনএজ (আমাদের স্কুলের পড়ার সময়) ধূমপানে আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং কিছু বোঝার আগেই এটাতে নেশা হয়ে যায়। আর এটা এমন একটি কঠিন নেশা যে, সহজেই ছাড়াও যায় না। তরুণ বয়সে মূলত তিনটি কারণে তারা ধূমপান শুরু করে- ১. নিজেকে প্রাপ্তবয়ষ্ক দেখানোর জন্য ২. তাদের বন্ধুদের মতো হতে চেষ্টা করা এবং ৩. স্বাদটা কেমন সেটা দেখার জন্য। তবে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা বলছে, আরও কিছু কারণেও মানুষ ধূমপান করেন- যেমন পিয়ার প্রেসার (অন্যরা করছে, আপনাকেও করতে হবে), সামাজিক সুবিধা (একসঙ্গে ধূমপান করায় তাদের একটি কমিউনিটি তৈরি হয়), মা-বাবা ধূমপায়ী হলে তাদের প্রভাব, বিজ্ঞাপনের প্রভাব, সিগারেটকে অনেকেই ওষুধের মতো ব্যবহার করেন, পাশাপাশি মিডিয়ার এক ধরনের প্রভাব তো রয়েছেই। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে সবকিছুকেই তো প্রভাবিত করা যায়। তাই সিগারেট, বিড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কেন এই মহাসুযোগ ছাড়বে? আর যারা নিজেদের স্ট্রেস কমানোর জন্য সিগারেটকে বেছে নিয়েছেন, একটা সময়ে গিয়ে এই সিগারেটই তাদের মূল স্ট্রেসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ততদিনে আর ফিরে আসার পথ খোলা থাকে না। পাঁচ. ধূমপানের কারণে যে বৈরী পরিবেশ তৈরি হয়েছে তা থেকে কি আমাদের মুক্তি নেই? সরকার একবার একটু সোচ্চার হয়েছিল। একটি আইন করা হয়েছিল যে, উন্মুক্ত পরিবেশে ধূমপান করা যাবে না। একটা জরিমানারও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কয়েকটা দিন একটু হৈচৈ হলো, তারপর যেই লাউ সেই কদু! উন্নত বিশ্বের অনেক দেশই ধূমপানকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। অফিসগুলোয় তো ধূমপান করা যায়ই না, উপরন্তু কেবল নির্দিষ্ট এলাকায় ধূমপান করা যায়। পাশাপাশি একটি নির্দিষ্ট বয়সের নিচের মানুষ দোকান থেকে সিগারেট কিনতে পারেন না। আইডি কার্ড দেখিয়ে সিগারেট কিনতে হয়। এই কাজগুলো নিশ্চয়ই শখ করে করা হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা তো কমছেই না, বরং হু হু করে বাড়ছে। আমি নিজেই ২০০০ সালের দিকে যত মানুষকে সিগারেট খেতে দেখেছি তার থেকে বেশি দেখেছি ২০১০ সালের দিকে। আর এখন ২০১৫ সালটা গেল, চোখে পড়ার মতো মানুষ রাস্তাঘাটে বিড়ি ফুঁকছে। আর স্কুলের বাচ্চারাও যে তাতে সদলবলে যোগ দিয়েছে তা তো ল্যাবরেটরি স্কুলের গলির পথে হাঁটলেই দেখা যাচ্ছে। এর থেকে মুক্তির উপায় কী? আমার ধারণা, ধূমপায়ীদের দ্বারা কখনই ভাল কিছু সম্ভব নয়। যারা ধূমপান করেন না তারাও খারাপ কাজ করতে পারেন। কিন্তু একজন ধূমপায়ী ভাল কোন কাজ করছেন, সেটা হওয়ার কথা নয়। কারণ তিনি নিত্যদিন অন্য মানুষের ক্ষতি করে চলেছেন, এমনকি নিজের সন্তানদের ক্ষতি করছেন। কই, তাতে তো তাদের বিবেক বাধা দেয়নি? তারা তো নিজের সন্তানের ভালর জন্য হলেও ধূমপান বন্ধ করেননি! তারা কি জানেন না, পরোক্ষ ধূমপান অন্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর? এটা জানার পরেও যখন তারা কাজটি করছেন তার অর্থ দাঁড়ায় তাদের লজিক জ্ঞান খুব দুর্বল। ভাল কিছু করার জন্য যে দৃঢ়তা প্রয়োজন তা এদের নেই। নিজের সন্তানদের জন্য যে ভাল কাজ করতে পারে না সমাজের জন্য তারা ভাল কাজ করবে এটা আমি গ্রহণ করি কোন্ যুক্তিতে? আর যে সমাজে অর্ধেকের বেশি মানুষ এমন সেই সমাজের অবস্থাটা কি? একটি জ্বলন্ত নরক! প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে লাখ লাখ সিগারেটের আগুন এই দেশটাকে একটি জ্বলন্ত নরকে পরিণত করেছে। আর সেই নরকের আগুনে জ্বলে পুড়ছি আমরা সবাই। নরকে বসে কোনদিন ভাল কিছু হতে পারে? তাহলে তো নরকের সংজ্ঞাই পাল্টে ফেলতে হবে। মানুষ সচেতন হয়ে ধূমপান কমিয়ে দেবে এটা আর আশা করছি না। বাংলাদেশের মানুষ অন্যের প্রতি সৌজন্যতা দেখিয়ে কারও মুখের ওপর ধোঁয়া ছাড়বে না সেটাও আশা করছি না। বাংলাদেশের মানুষ সৌজন্যতা শেখেনি এখনও। যারা গাড়ির মালিক সেই শিক্ষিত ধনী লোকেরাই এখনও রাস্তায় সৌজন্যতা দেখান না, আর সিগারেট খাওয়াতে সৌজন্যতা দেখাবেন সেটা হয় না। সরকার তার সেই কঠিন আইনটি আবার প্রয়োগ করে দেখতে পারে। কয়েকটা বছর কঠিনভাবে পালন করা হোক সেই আইন, তাতে কমে আসবে উন্মুক্ত স্থানে ধূমপায়ীর সংখ্যা। তার চাপেই কমে যাবে নিয়মিত ধূমপান। নইলে চলুন সবাই মিলে জ্বলন্ত এই নরকেই থাকি! মরব তো একদিন, সেটা না হয় হোক নরকের আগুনেই। গুডলাক ২০১৬! ১ জানুয়ারি ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং সম্পাদক, প্রিয়.কম [email protected]
×