ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পৌষে নতুন সাজে প্রকৃতি

নিয়েছ জড়িয়ে কুয়াশার শুভ্র চাদরে তপসীর সাধনায়...

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ২০ ডিসেম্বর ২০১৫

নিয়েছ জড়িয়ে কুয়াশার শুভ্র চাদরে তপসীর সাধনায়...

মোরসালিন মিজান ॥ পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আয় আয় আয়...। বছর ঘুরে আবারও এসেছে পৌষ। আর পৌষ মানেই শীতের শুরু। হ্যাঁ, প্রিয় ঋতুর আজ রবিবার ষষ্ঠ দিন। এরই মাঝে গরম জামা-কাপড় গায়ে উঠেছে। শুরু হয়ে গেছে পীঠা-পুলির উৎসব। কবির ভাষায়- শীত এসেছে লাগলো কাঁপন, লাগলো দোলা প্রাণে/ শীত এসেছে হিমেল হাওয়া, আনন্দ আর গানে...। পৌষের প্রথম দিন থেকে শুরু হয় শীতকাল। চলে মাঘের শেষ দিন পর্যন্ত। এ হিসাব অবশ্য পঞ্জিকার। এ সময়ের আগে পরেও শীত থাকে। তো, হঠাৎ এই শীতল অনুভূতি জন্মের রহস্য কী আসলে? উত্তরে আবহাওয়া অফিস বলছে, বাংলাদেশ বিষুব রেখার উত্তরে। প্রায় সাড়ে ২৩ ডিগ্রী অক্ষাংশে। কিন্তু শীতকালে অবস্থান পরিবর্তন করে সূর্য বিষুব রেখার দক্ষিণে চলে যায়। দক্ষিণে কিছুটা হেলে থাকে। দিন ছোট হয়। বড় হতে থাকে রাত। এর ফলে শীতের প্রকোপ বাড়ে। বাংলাদেশে যখন শীতকাল, পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোয় তখন গ্রীষ্ম। ওসব দেশে বাতাস উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। উত্তর গোলার্ধ থেকে ঠা-া বাতাস দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। বাংলাদেশের উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা। সেখান থেকে বরফ শীতল বায়ু এ দেশের ওপর দিয়ে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। আবহাওয়ার আকস্মিক পরিবর্তনের কারণে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে যে ঠা-া বাতাসের প্রবল প্রবাহ সৃষ্টি হয় তা শৈত্যপ্রবাহ নামে পরিচিত। এ সময় তীব্র ঠা-া অনুভূত হয়। এখন, ঠিক এই মুহূর্তেও চলমান আছে হাল্কা শৈত্যপ্রবাহ। তাতেই শীতটা টের পাওয়া যাচ্ছে। তবে মাঘ মাসে শীত এত বেড়ে যায় যে, বাঘও ভয়ে পালায়! অবশ্য পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের শীতের সঙ্গে বাংলাদেশের শীতের পার্থক্য বিস্তর। কোন কোন দেশে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রীতে নেমে আসে। খুব কাছের দেশ চীনেও তাপমাত্রা মাইনাস নয়-দশ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত নিচে নামে! মেরু অঞ্চল বা এন্টার্কটিকার কথা তো বলাই বাহুল্য। সেখানে বাংলাদেশে তাপমাত্রা ছয় কিংবা পাঁচ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে খুব একটা নামে না। সে দিক থেকে বাংলাদেশে শীত অনেক বেশি উপভোগ্য। পৌষের প্রকৃতিও অদ্ভুত সুন্দর। একটু খেয়াল করলে তা চোখে পড়বে বৈকি। অনেক কিছুই এরই মাঝে বদলে গেছে। এখন সকাল হলেই সূর্যালোকের দেখা মেলে না। ঘন কুয়াশায় ঢাকা চারপাশ। রাতে শিশির ঝরছে। প্রকৃতির এ রূপ বর্ণনা করেই জীবনানন্দ লিখেছিলেনÑ শিশির পড়িতেছিল ধীরে-ধীরে খ’সে;/ নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি/ উড়ে গেলো কুয়াশায়, -কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরো...। অপর এক কবির কবিতায় বর্ণনাটি এ রকম- হে শীত, সবুজের পোষাক খসিয়েছ/ নিয়েছ জড়িয়ে কুয়াশার শুভ্র চাদরে তপসীর সাধনায়...। পৌষে এই কুয়াশা এত হয় যে সূর্য দেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হয়। কবি কিশোর সুকান্ত তাই লিখেছিলেন, সকালের এক- টুকরো রোদ্দুর-/ এক-টুকরো সোনার চেয়েও মনে হয় দামী।/ ঘর ছেড়ে আমরা এদিক-ওদিকে যাই-/এক-টুকরো রোদ্দুরে তৃষ্ণায়...। গ্রামের সাধারণ কৃষক অবশ্য সূর্যের অপেক্ষা করেন না। ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে আইল্যায় হাত ছেঁকে নেন। এভাবে যেটুকু সম্ভব উষ্ণতা সঞ্চয় করে কাজে নেমে যান। পৌষে কৃষকের ফসল ঘরে তোলার কাজ শেষ হয়ে যায়। হাতে তেমন কাজ থাকে না। সবাই উৎসব-আনন্দে মাতে। নতুন ধান থেকে পাওয়া চালে ঘরে ঘরে চলে পিঠাপুলির আয়োজন। পৌষের শেষ দিনে ব্যাপক আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় পৌষসংক্রান্তি। শীতে প্রকৃতিজুড়ে শুরু হয় রং-বেরঙের খেলা। গ্রামে শীত মানেই সরিষার ক্ষেতে দোল খাওয়া কাঁচা হলুদ। আশ্চর্য সুন্দরে চোখ আটকে যায়। খেজুরের রসে ভরে ওঠে মাটির কলসী। ম ম গন্ধ ছড়ায়। শীতের হাওয়ায় কাঁপন ধরে আমলকীর বনে। কবিগুরুর ভাষায়- শীতের হাওয়ার লাগলো নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে।/ পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে...। শীতকালে ফুলেরাও যেন বাড়তি আবেদন নিয়ে হাজির হয়। সৌন্দর্যের সবটুকু মেলে ধরে। মৌসুমী ফুলে ভরে ওঠে বাগান। হলুদ গাঁদা ফুল এরই মাঝে শীতকে স্বাগত জানিয়েছে। আর গোলাপ তো ফুল নয় শুধু, বিশেষ জাত। খুব প্রিয় গোলাপ সারা বছরই ফোটে। তবে এই এখন মৌসুম। গোলাপের মিষ্টি ঘ্রাণে ক্রমশ চারপাশ ভরে উঠছে। ফুটছে ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, মোরগফুল। মুখ তুলে তাকাচ্ছে সূর্যমুখী। আকাশের দিকে তাকিয়েও এখন অনুমান করা যায়, শীত এসেছে। সেখানে উড়ে বেড়াচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে শীতের পাখিরা। প্রায় সারাদেশের বনে, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের শাখায় এখন উৎসব চলছে পাখিদের। দেশীয় পাখিদের সঙ্গে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে যোগ দিয়েছে অতিথি পাখিরা। কবির ভাষায়, শীতের পাখিরা বৈকাল থেকে উড়ে আসে নাতিশীতোষ্ণ দেশে...। এসবের বাইরে, শীতের আর যে আলোচনা তার নাম দুর্ভোগ। বিশেষ করে দারিদ্র্যের সঙ্গে অহর্নিশ যুদ্ধ করা মানুষ সময়টা বড় কষ্টে কাটায়। শীত বাড়লে তাদের কষ্ট বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। শহরের ছিন্নমূল মানুষের জন্যও আনন্দের হয় না শীত। রাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কবির ভাষায়, এই শীত ‘বিষাদের প্রতিমূর্তি।’ যারা চিরসুখী, যারা আনন্দের জীবন পেয়েছেন, তাঁদের এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো উচিত। কেবল তাহলেই সবার জন্য প্রিয় আর উপভোগ্য হয়ে উঠবে শীতের কাল।
×