ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল

অপরিণত শিশু চিকিৎসার বাতিঘর

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫

অপরিণত শিশু চিকিৎসার বাতিঘর

বাবুল হোসেন ॥ কম ওজন আর মারাত্মক শ্বাসকষ্ট নিয়ে জন্ম নেয়া প্রিম্যার্চুড বা অপরিণত শিশুর আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসাসেবা এখন দেশেই মিলছে। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে সরকারী পর্যায়ে একমাত্র ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই সঙ্কটাপন্ন নবজাতকের এই চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে একদম বিনা পয়সায়। চিকিৎসাসেবার এই আধুনিকায়নে নবজাতকের মৃত্যুর হার ২৫ শতাংশ থেকে কমে ১৫-এর নিচে দাঁড়িয়েছে। জটিল সার্জারির প্রয়োজন ছাড়া নবজাতকের জটিলতর সব ব্যয়বহুল চিকিৎসাসেবার প্রয়োজনে এখন আর কাউকে দেশের বাইরে কিংবা প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যেতে হয় না। এতে নবজাতকের পরিবার যেমন খুশি, তেমনি নবজাতকের সব রোগের চিকিৎসার জন্য ভরসার বাতিঘর হয়ে উঠেছে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। আত্মত্যাগী ও ধৈর্যশীল একদল দক্ষ চিকিৎসক, প্রশিক্ষিত নার্স ও আয়া কর্মচারীদের সমন্বিত সেবা ও প্রচেষ্টায় সঙ্কটাপন্ন নবজাতকের প্রাণ ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে এটি এখন সম্ভাবনার মডেল। দীর্ঘ এক দশক প্রতীক্ষার পর পেটে সন্তান আসায় আনন্দে অনেকটাই আত্মহারা নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার কান্দাপাড়া গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী দম্পতি তরিকুল ইসলাম ও ইভা। কিন্তু এই আনন্দ অনেকটাই ম্লান হয়ে যায় যেদিন নির্ধারিত সময়ের আগেই মা ও সন্তানকে বাঁচাতে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিজার করে প্রসব করানো হয় প্রিম্যার্চুড নবজাতককে। জন্মের পরই মারাত্মক শ্বাসকষ্টের সঙ্গে নবজাতকের জীবনকে আরও সঙ্কটাপন্ন করে তোলে অব্যাহত খিঁচুনি। নেত্রকোনা থেকে রেফার্ড হয়ে আসা এই নবজাতকের চিকিৎসা হয় ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নবজাতকের (নিউ বেবি) ওয়ার্ডে। মাত্র ৫ দিনের চিকিৎসাসেবায় সুস্থ হয়ে ওঠায় নবজাতকের বাবা-মার মুখে আবারও ফুটে ওঠে হাসির ঝিলিক। হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থাপনায় সন্তুষ্ট তরিকুল ও ইভা দম্পতি। কতর্ব্যরত চিকিৎসকরা বলেন, নবজাতক আশঙ্কামুক্ত ও সুস্থ। মুক্তাগাছা উপজেলার গৃহবধূ শাহনাজের প্রথম সন্তান জন্ম নেয়ার পর পরই দেখা দেয় মারাত্মক শ্বাসকষ্ট। মিনিটে যেখানে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাত্রা থাকে ৪০-এরও বেশি বার। সেখানে এই নবজাতকের ছিল মাত্র ৫ থেকে ৬ বার। সঙ্গে কম ওজনের সমস্যা। স্বাভাবিক ২ দশমিক ৫ কেজি ওজনের স্থলে এই নবজাতকের ওজন ছিল মাত্র ১ দশমিক ৮ কেজি। জন্মের পর পরই তাকে ময়মনসিংহ মেডিক্যালে ভর্তির পর কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের (ভেন্টিলেটরি) সাপোর্ট দেয়া হয়। নবজাতকের বাবা মুজিব জানান, সিজারের পর নবজাতক শ্বাস নিচ্ছিল না। কর্তব্যরত চিকিৎসক (আইএমও) ডাঃ রেবেকা সুলতানা জানান, ভেন্টিলেটরি সাপোর্ট দিতে দেরি হলে নবজাতককে বাঁচানো যেত না। ক্ষতির আশঙ্কা ছিল ব্রেনের। জন্মের পর মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় খাদ্যনালীতে না গিয়ে শ্বাসনালীতে ঢুকে পড়ায় শ্বাসকষ্ট বেড়ে আজিজুল ও জোছনা দম্পতির প্রথম সন্তানের জীবন সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়লে নিয়ে আসা হয় ময়মনসিংহ মেডিক্যালে। এখানে নবজাতকের বুকে জমে থাকা কফ দ্রুত বের করার জন্য সাকসন যন্ত্র ব্যবহার করা হয় এবং একই সঙ্গে অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়ার পর বাচ্চা সুস্থ হয়ে ওঠে। প্রথম সন্তান নিয়ে এ রকম সমস্যায় উদ্বিগ্ন বাবা-মায়ের মুখে এখন আনন্দের হাসি। এমন সব জটিল ও মারাত্মক রোগের চিকিৎসায় বেসরকারী হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা ব্যয় হওয়ার কথা। এই হিসাবে সাত দিন থেকে ৩০ দিনের এই চিকিৎসা কেবল ব্যয় বহুলই নয়, অনেকের জন্য ছিল কষ্টসাধ্য অথচ এই ব্যয়বহুল চিকিৎসাসেবা মিলছে ময়মনসিংহ মেডিক্যালে একদম বিনা পয়সায় এই দাবি নবজাতক ওয়ার্ডপ্রধান অধ্যাপক ডাঃ আনোয়ার হোসেনের। ময়মনসিংহ মেডিক্যালের নবজাতক ওয়ার্ডে প্রতিদিন গড়ে ১২০ থেকে ১৬০ নবজাতক ভর্তি হচ্ছে। মাসে গড়ে এই ওয়ার্ডে ৮শ’ থেকে এক হাজার নবজাতক ভর্তি থাকছে। ওয়ার্ডে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ১৫টি ছাড়াও বিছানা রয়েছে আরও ৫০টি। অত্যাধুনিক চিকিৎসাসেবার জন্য রয়েছে ভেন্টিলেটরি সাপোর্ট মেশিন, ইনকিউবিউটর, ওয়ার্মার, ফটো থেরাপি, ব্লাড ও গ্যাস এনালাইজারসহ আন্তর্জাতিকমানের অত্যাধুনিক বিছানা। চিকিৎসাসেবার মান নিশ্চিত করতে পুরো ওয়ার্ডকে করা হয়েছে আইসোলেটেড। ভর্তির পর কোন বাবা-মা কিংবা স্বজনকে নবজাতকের কাছে যেতে দেয়া হয় না। কর্তব্যরত চিকিৎসক, নার্স ও আয়াই সবকিছু দেখভাল করছে। প্রয়োজনে অভিভাবকদের কল দেয়া হয় ওয়ার্ডের বাইরে স্থাপন করা মাইকে। আন্তর্জাতিকমানের এমন সেবা পেয়ে খুশি নবজাতকদের পরিবার ও স্বজনরা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও যন্ত্রপাতির অভাবে ময়মনসিংহ মেডিক্যালে নবজাতকের মৃত্যুর হার ছিল ২৫ শতাংশ। গত ২০১৩ সালের জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের ভেতরে আলাদাভাবে মাত্র ৪টি বিছানায় দেয়া হতো নবজাতকের চিকিৎসাসেবা। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম না থাকায় কম ওজন ও মারাত্মক শ্বাসকষ্ট নিয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই জন্ম নেয়ার কারণে প্রিম্যার্চুড নবজাতকদের অন্তত ২৫ শতাংশ মারা যেত জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। নবজাতকের মৃত্যুর এই উদ্বেগজনক হার কমিয়ে আনতে গত ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের উন্নয়নকাজ করে নবজাতকের ওয়ার্ড আলাদা করে দেয়া হয়। দাতা সংস্থা ইউনিসেফের সহায়তায় এ সময় নবজাতক ওয়ার্ডে সরবরাহ দেয়া হয় বিশ্বমানের বিছানাসহ প্রয়োজনীয় আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম। এসব আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামের রক্ষণাবেক্ষণসহ লোকবলের দক্ষতা বাড়াতেও সহায়তা দিচ্ছে ইউনিসেফ।
×