ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শরতে লজ্জাবতী

ফুলের চেয়ে পাতার ভালবাসা বেশি... দেখলেই ছুঁয়ে দিতে মন চায়

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৩১ আগস্ট ২০১৫

ফুলের চেয়ে পাতার ভালবাসা বেশি... দেখলেই ছুঁয়ে  দিতে মন চায়

সমুদ্র হক পুষ্পকলিতে লাজুকলতাই একমাত্র পত্রালী বা পাতা যার প্রেম ফুলের চেয়ে বেশি। পুষ্পপ্রেমীরা অন্যসব ফুলকে যত ভালবাসে লজ্জাবতীর পাতাকে ভালবাসে তার চাইতে বেশি। ফুলের চেয়ে পাতা চেনে বেশি। বনফুলের মধ্যে এই লাজুকলতা দেখলেই হাত বুলিয়ে বা ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে। শরতের এই সময়টায় বনফুলের ফাগুন মাস। পথের ধারে, ঝাউবনে, ঝোপঝাড়ে, জঙ্গলে, বাঁশবাগানে নাম না জানা কত ফুল আনাদরে ফুটে অভিমানে পাপড়ি ঝরিয়ে দেয়....কেউ খোঁজ রাখে না। নদী তীরে গোধূলি বেলায় কোন কাশবনের ধার দিয়ে যাওয়ার সময় একটু আদর পেতে কেতকী বা কেয়া সুগন্ধি ছড়িয়ে জানান দেয় আশপাশেই আছে। তবু কেউ দেখে না। সুবাসটুকু নিয়ে পথিক চলে যায় গন্তব্যে। এমনই কতফুল শরতের অপার সৌন্দর্যের প্রকৃতির ডালা ভরে রেখেছে। ডালার বৃত্তের বাইরে এসেছে লাজুকলতা। প্রকৃত নাম লজ্জাবতী। পথের ধারে লজ্জাবতী দৃষ্টিতে এলেই ছুঁয়ে দিতেই হবে, এমনটি ছিল কিশোর মন। লাজুকলতা মিটিমিটি করে তাকিয়ে মেলে ধরা ছোট্টপাতাগুলো দুই হাত জোড় করার মতো যুক্ত হয়ে হেসে লুটোপুটি খেয়ে যেন গড়িয়ে পড়ে। ছেলেবেলায় লজ্জাবতীর পত্রালীতে কেউ হাত বুলোয়নি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে কি। পুষ্পউদ্যানে লজ্জাবতীই একমাত্র গাছ যার ফুলের চেয়ে পাতার সৌন্দর্য এবং কদর দুই-ই বেশি। এই গাছের ফুল সহজে কেউ দেখে না। অন্য ফুলকে নিয়ে মানুষের যত ভালবাসা যত রোমন্টিসিজম কোন বনফুল তা পায় না। এতেই তার গর্ব। বনফুলের সারিতে আরেকটি ফুল- গ্রামের প্রতিটি জায়গায় সামান্য জঙ্গলেই গজিয়ে ওঠে। দলকলস নামের এক ছোট্ট সাদা ফুল এলাকা ভেদে নাম ভিন্ন। কোন স্থানে বলা হয় কাউনশিশা কোথাও সাদাকিংশুক। যদিও পলাশ ফুলের আরেক নাম কিংশুক। দলকলস ফুলের নাম কিভাবে কিংশুক হলো এ নিয়ে বিতর্ক আছে। বিতর্কে না গিয়ে পুরনো দিনের একটি গান- উৎপলা সেনের কণ্ঠে এই গানে সুরে সুরে বলা হয়েছে ‘কিংশুক ফুল হিংসুক ভারি আজ করে ভাব কাল করে আড়ি মন তার বোঝা যায় না..’। এই বনফুলগুলো তেমনই কখন যে ভাব করে কখন যে আড়ি দেয়! মাইকের মতো খুবই ছোট্ট দলকলস বা কাউনশিশা ছেলেবেলায় তুলে নিয়ে ঠোঁটের মধ্যে ধরে মিষ্টি রস চুষে নিয়েছে অনেকেই। বলা হতো ফুলের মধু। মৌমাছিরা এই ফুলের ওপর বসে মধু সংগ্রহ করে। প্রায় দেড় ফুট ছোট্ট এই গাছের ফুলে ভ্রমর (এবং মানুষ) মধু চুষে না নিলে দ্রুত শুকিয়ে যায়! কখনও বাড়ির সামনে বা উঠানের কোন এক কোনে এই গাছ বেড়ে ওঠার সঙ্গেই জঙ্গল মনে করে কেটে দেয়া হয়। প্রবীণরা এই গাছ সহজে কাটতে দেন না। এই ফুলের ঔষধি গুণ আছে। শরীরের কোথাও কেটে গেলে ফুলের রস লাগিয়ে দিলে ব্যাথা বেদনা উপশম হয়। এমনই অনেক বনফুল ঔষধি গাছ বা ফুল হয়ে আছে। লজ্জাবতীর কি গুণ আছে তা এখনও জানা যায়নি। তবে মানুষের হাতের ছোঁয়ায় এই ফুলের পত্রালী বুজে যাওয়া দেখে উদ্ভিদ ও রসায়ন বিজ্ঞানীরা নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন। দেশে দুই ধরনের লজ্জাবতীর গাছ মেলে। একটি পাহাড়ে আরেকটি সমতল ভূমিতে। পাহাড়ের লজ্জাবতী অনেকটা উঁচু। মনে হবে কাঁটা নেই। খেয়াল করলে বোঝা যাবে কোমল হালকা কাঁটা আছে। সমতলের লজ্জাবতী সমতলের মতোই মাটিতে মিশে থাকার মতো। নিজেকে রক্ষায় ছোট্ট কাঁটা আছে। এই লজ্জাবতীর বিজ্ঞান নাম ‘মাইমোসা পুডিকা’। ১৭৫৭ সালে উদ্ভিদ বিজ্ঞানী কার্ল লিনিয়াস এই ফুলটিকে প্লান্টারাম প্রজাতিভুক্ত করেন। তবে পাহাড়ী লজ্জাবতীর প্রজাতি আজও নির্ণয় হয়নি। এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা নানা যুক্তি দেখিয়েছেন। পাখি, প্রাণীর প্রজননের মতো এবং উদ্ভিদেরও পরাগায়ন আছে। সেখানেও আছে জেন্ডার। এই জায়গাটিতে লজ্জাবতীকে নিয়ে হোঁচট খাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। মানুষ এবং পাখির মধ্যে ‘পলিগামী, মনোগামীর’ অস্তিত্ব আছে যেমন বাবুই পাখি পলিগামী আবার লাভ বার্ড মনোগামী। পাহাড়ী লজ্জাবতীর বৈশিষ্ট এমনÑ এই গাছ শাখা প্রশাখা নিয়ে অনেকটা উঁচু। পাতা সমতলের লজ্জাবতীর চেয়ে বড়। আঙুল বোলানোর সময় কিছুটা দোলা দেয়ার অনেক পড়ে পাতা বুজে যায়। পাহাড়ী লজ্জাবতীর লাজলজ্জার বালাই নেই। ঝাঁকুনি দেয়ার সময় পত্রালীর কা-ের একাংশের কোষ থেকে পানি বের হয়। কোষগুলো নিজস্ব চাপ হারিয়ে ফেলে। পাহাড়ী লজ্জাবতীর এত শক্তির উৎস খুঁজে পায়নি বিজ্ঞানীরা। যে কারণে পরাগায়নের ধারায় সমতলের লজ্জাবতী যদি হয় মনোগামী তাহলে এই কম লজ্জার উত্তেজনার ক্ষরণের পাহাড়ী লজ্জাবতী পলিগামী (!)। দুই ধরনের লজ্জাবতী নিজের নিরাপত্তা নিজেই নেয়। পাতা বুজে যাওয়ার দ্রুত পরিবর্তন দেখে জীবজন্তুরা খায় না। তীক্ষè উল্টো কাঁটার জন্য সাপ যায় না। ক্ষতিকর পোকারাও কেটে পড়ে। লজ্জাবতীর ফুল ফিকে লাল। দেশে দেশে লজ্জাবতীর নানা নাম। ইংরেজী নাম ডোন্ট টাচ মি, সিøপিং গ্র্যাস, বেড রোজ লিফ, ফিলিপাইনে নাম মাকিহিয়া (লাজুক) ওয়েস্টইন্ডিজের নামের বাংলা অর্থ মিছেমিছি মরা, ইন্দোনেশিয়ায় পুত্রিমালু (লাজুক রাজকন্যা)। কত বাহারি নাম এই লজ্জাবতীর। পুষ্পকলির আবির্ভাবের সঙ্গে মানুষের মনে জাগায় বিচিত্র অনুভূতি অপরূপ আবেশ ও পুলক। যৌবনের আকুলতা। বনফুলগুলো তেমনি আকুলতা নিয়েই বেড়ে ওঠে।
×