ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নজরুলের গান-কবিতায় উজ্জ্বল আমাদের মুক্তি সংগ্রাম

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ২৫ মে ২০১৫

নজরুলের গান-কবিতায় উজ্জ্বল আমাদের মুক্তি সংগ্রাম

মনোয়ার হোসেন ॥ সময়টা একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাস। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে চলছে বাঙালীর সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম। উত্তাল ওই সময়ে রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধা আর শরণার্থী শিবিরে অসহায় মানুষদের উদ্দীপ্ত করতে নেয়া হয়েছিল সুরের আশ্রয়। এমনকি গান গেয়ে সংগ্রহ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা তহবিল। সেই সূত্রে দিল্লীর একটি পুজোম-পে বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার পক্ষে সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। সমবেত সুরের অনুরণনে শিল্পীরা গাইলেন বিদ্রোহী কবির উদ্দীপনামূলক গানÑ ‘কারার ঐ লৌহ কপাট/ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট/রক্ত জমাট/শিকল পূজার পাষাণ-বেদী/ওরে ও তরুণ ঈশান/বাজা তোর প্রলয় বিষাণ/ধ্বংস নিশান/উড়ুক প্রাচীন প্রাচীর-ভেদি।’ নজরুলের এই শেকল ভাঙ্গার গান পরিবেশন করেন শাহীন সামাদ, বিপুল ভট্টাচার্য, শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়, শারমিন মুরশিদ, দেবু চৌধুরীসহ একঝাঁক মুক্তিকামী শিল্পী। এভাবেই একাত্তরের রণাঙ্গনে প্রবলভাবে প্রকাশিত হয়েছিল নজরুলের গান। সেই অবিনাশী সুর বিপুলভাবে স্পর্শ করেছিল জনচিত্ত। বাঙালীর গণজাগরণে একইভাবে নজরুলের জ্বালাময়ী কবিতাও রেখেছিল তেজস্বী ভূমিকা। তাই তো নজরুলের গান-কবিতার প্রখরতায় উজ্জ্বল একাত্তরের মুক্তির সংগ্রাম। সুর আর বাণীর অহঙ্কারে আগ্নেয়গিরির অগ্নি উচ্ছ্বাস, শোষকের বিরুদ্ধে ভাবাবেগে টগ্বগ্্ শোষিতের সুতীব্র ধিক্কারের প্রকাশ ছিল নজরুলসঙ্গীত। একাত্তরের রণাঙ্গনে নজরুলের গান ও কবিতার অনবদ্য ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন নজরুল গবেষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে কাজী নজরুলের গান ও কবিতা ছিল অনুপ্রেরণার অনন্ত উৎস। কবিতার ছন্দে কিংবা গানের সুরে বাঙালীর মুক্তির সংগ্রামে জাতীয় কবির উপস্থিতি ছিল একই সঙ্গে প্রবল, প্রচ- ও প্রখর। বিশেষ করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্ন থেকেই বাঙালীর আত্মপরিচয়ের সংগ্রামে বিভিন্ন সভা-সমিতিতে উচ্চারিত হয়েছে বিদ্রোহী কবির গান ও কবিতা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পরিবেশিত ‘কারার ঐ লৌহ কপাট, মোদের এই শিকল পড়ার ছল, দুর্গম গিরি কান্তার মরু, জাগো অনশন-বন্দী, চল্্ চল্্্ চল্্্’ কিংবা জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখাÑদ্রোহের কবির মুক্তির বার্তাবহ এমন সব গান ছিল অসীম প্রেরণার আধার। একই সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ও শরণার্থী শিবিরে ছড়িয়েছে সুরের উদ্দীপনা। বাড়িয়েছে শত্রুতার বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া ও বেঁচে থাকার মনোবল। বস্তুতপক্ষে নজরুলের এসব গান ওই উত্তাল সময়ে নজরুলসঙ্গীত থেকে পরিণত হয়েছিল গণসঙ্গীতে। আর এটা ভাষা আন্দোলনের পর থেকে বাঙালীর মুক্তির সনদ ছেষট্টির ছয় দফা কিংবা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানসহ স্বাধীনতাপূর্ব প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সমানভাবে উচ্চারিত হয়েছে। একইভাবে নজরুলের কবিতার বাক্যবাণেও উদ্দীপ্ত হয়েছে বাঙালীর সশস্ত্র সংগ্রাম। তাঁর কালজয়ী কবিতা বিদ্রোহী থেকে শুরু করে দারিদ্র্য, ফরিয়াদ অথবা সাম্যবাদী ধরা দিয়েছে মুক্তির আকাক্সক্ষার হাতিয়ার হিসেবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পরিবেশিত নজরুলের এসব পদ্যের শাণিত চেতনার ঝঙ্কারে আলোড়িত হয়েছে মুক্তিকামী মানুষ। তাই নজরুলের মতো বিপুলভাবে অন্য কোন কবির কবিতা বা গান গীত হয়নি আমাদের মুক্তির আন্দোলনে। যদিও কবির এসব গান-কবিতা রচিত হয়েছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। তবে এসব সৃষ্টির অন্তর্নিহিত বাণীর প্রগাঢ়তার কারণেই সহজাত শক্তি নিয়ে পুনরায় প্রবল বেগে আবির্ভূত হয়েছে বাংলার মুক্তির আহ্বানে। অন্যদিকে প্রবন্ধের আশ্রয়ে বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক চেতনার বীজ বপনেও অনন্য নজরুল। আর তাঁর প্রতি বাঙালীর কৃতজ্ঞতার সেই প্রকাশের সূত্র ধরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তাঁকে অনুরোধ করে এনেছিলেন এ দেশে। গলায় পরিয়েছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় কবির মালা। সেই সময় প্রতিদিন বিউগল বাজিয়ে জাতীয় কবির বাসভবনে উত্তোলিত হতো জাতীয় পতাকা। একইভাবে বিউগলের সুরে নামানো হতো সেই পতাকা। আর কোন কবির ভাগ্যে এমন সম্মান জুটেছে কিনা, তা আমার জানা নেই। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা বিভাগের প্রধান ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী। স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতারে নজরুলের গীত বা কাব্যের প্রচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মুক্তির সংগ্রামে জনতার জাগরণ সৃষ্টির অভিপ্রায়ে সে সময় নিয়মিতভাবে প্রচারিত হতো নজরুলের গান ও কবিতা। এমনকি একাত্তরের ২৫ মে আমি নিজেও আবৃত্তি করেছিলাম বিদ্রোহী কবিতাটি। প্রচারিত হয়েছে নজরুলের ছেলে কাজী সব্যসাচীর আবৃত্তিসহ কবির রচিত বিভিন্ন শিল্পীর পরিবেশিত গান-কবিতা। এসব গান ও কবিতা উদ্দীপ্ত করেছে আমাদের রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের। একইভাবে অনুপ্রাণিত করেছে শরণার্থীসহ স্বাধীনতাকামী সকল বাঙালীকে। প্রখ্যাত নজরুলসঙ্গীত শিল্পী শাহীন সামাদ একাত্তরে ছিলেন অষ্টাদশী তরুণী। বরেণ্য এই কণ্ঠশিল্পী তারুণ্যের শক্তিতে ভর করে কণ্ঠকে হাতিয়ার করে অংশ নিয়েছেন মুক্তিসংগ্রামে। যোগ দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থায়। মুক্তিযুদ্ধে গণজাগরণ সৃষ্টিতে নজরুলসঙ্গীতের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেই অস্থির সময়ে শোষিত সাধারণ মানুষের চেতনাকে শাণিত করেছে নজরুলের গান। বাড়িয়েছে তাঁদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবল। সে কারণেই আমরা মুক্তাঞ্চলসহ শরণার্থী শিবির ও মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম নজরুলের অবিনাশী সুরেলা শব্দধ্বনি। তাঁদের মনে প্রেরণা সঞ্চারের পাশাপাশি নিজেরাও হয়েছি প্রাণিত। ভারতবর্ষের স্বাধীতের পটভূমিতে রচিত গানগুলো হয়ে উঠেছিল আমাদের শিল্পিত লড়াইয়ের হাতিয়ার। নজরুলের সব সঙ্গীতই প্রভাব ফেলেনি মুক্তিযুদ্ধে। তবে একাত্তরে কিছু কিছু নজরুলসঙ্গীত আমাদের প্রবলভাবে প্রেরণা য়ুগিয়েছে এবং প্রভাব বিস্তার করেছে। অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, ভাঙার গান, প্রলয় শিখা, সর্বহারা, সাম্যবাদী ও ফণিমনসার বিশেষ বিশেষ গানগুলো ত্বরান্বিত করেছে মুক্তির সংগ্রামকে। কারণ এসব গানের ভাষাশৈলী, ভাব-ব্যঞ্জনা কিংবা সুরের উন্মাদনা-উদ্দীপনা যুদ্ধরত সংগ্রামী জনতাকে আকর্ষণ না করে পারেনি। সেসব গান হয়ে উঠেছিল আমাদের জীয়নকাঠি। এমনকি সে সময় তাঁর কবিতাও পরিণত হয়েছিল সঙ্গীতে। Ÿাইরে সুর যোজনার সন্ধান না মিললেও অন্তর্নিহিত সুরের কারণে তেমনটাই ঘটেছে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য জাতীয় কবির বিদ্রোহী কবিতা। এই কাব্যের একটি স্তবকÑ মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি সেই দিন হবো শান্ত/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না...। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এ গান বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে অসংখ্যবার গেয়েছেন এ দেশের গণসঙ্গীত শিল্পীরা। মুক্তি সংগ্রামে নজরুলের যে গান বাঙালীর চেতনাকে সবচেয়ে আলোড়িত করেছে তার মধ্যে রয়েছেÑ কারার ঐ লৌহ কপাট/ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট...। কখনওবা শৃঙ্খল ভাঙার প্রত্যয়ে বিষের বাঁশি থেকে গীত হয়েছেÑ এই শিকল-পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল/এই শিকল-পরেই শিকল তোদের র্কব রে বিকল/তোদের বন্ধ কারায় আসা মোদের বন্দী হতে নয়/ওরে ক্ষয় করতে আসা মোদের সবার বাঁধন-ভয়/এই বাঁধন-পরেই বাঁধন-ভয়কে র্কবো মোরা জয়/এই শিকল-বাঁধা পা নয় এ শিকল ভাঙা কল। একইভাবে মুক্তিসংগ্রামে নজরুলের একটি গান জনমনে বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল। আনন্দের শিহরণ নিয়ে গাওয়া হয়েছিলÑ একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী/ফুলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে/ঝলমল্্ করে লাবণী...। কবির কিছু ভিন্ন ধারার গান স্বাধীনতা সংগ্রামে রেখেছিল অসাধারণ ভূমিকা। তেমন একটি গান হচ্ছেÑ তোরা সব জয়ধ্বনি কর/তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখীর ঝড়/আসছে এবার অনাগত প্রলয়নেশায় নৃত্য পাগল/সিন্ধুপারের সিংহ-দ্বারে ধমক হেনে ভাঙল আগল...। নিপীড়িতকে জাগিয়ে তোলার বাণী নিয়ে গীত হয়েছেÑ জাগো অনশন-বন্দী, ওঠ রে যত/জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত/যত অত্যাচারের আজি বজ্র হানি/হাঁকে নিপীড়িত জন-মন-মথিত-বাণী/নব জনম লভি অভিনব ধরণী/ওরে ওই আগত...। ওই সময় নজরুলের ‘কা-ারী হুঁশিয়ার’ কবিতাও জনমনে জ্বালিয়েছিল দ্রোহের আগুন। সুরের আশ্রয়ে গাওয়া হয়েছিলÑ দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর-পারাবার/লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার/দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ, ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ/কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ/এ তুফান ভারি, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার...।
×