ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

কাওরান বাজারের ঘটনা ও রঞ্জিত প্রচারণা

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ২২ এপ্রিল ২০১৫

কাওরান বাজারের ঘটনা ও রঞ্জিত প্রচারণা

সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে দল-সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালানোর জন্য বিএনপি নেত্রী গত সোমবার (২০ এপ্রিল) ঢাকার কাওরান বাজারে গিয়েছিলেন। নিজস্ব সিকিউরিটি পরিবেষ্টিত তার জাঁকজমকপূর্ণ গাড়িবহরে স্থানীয় লোকজন, বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের একটা অংশ ঢিল পাটকেল মেরেছে। তাদের অভিযোগ, যে নেত্রী গত তিন মাস যাবত তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ রেখেছেন, তাদের আয় উপার্জনে বিরাট লোকসান ঘটিয়েছেন, নিরীহ মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছেন, তিনি এত শীঘ্র সেই ব্যবসায়ী ও মানুষজনের কাছে ভোট চাইতে আসেন কিভাবে? এটা বিএনপি সম্পর্কে দেশের মানুষের একটা বিরাট অংশের মনের ক্ষোভ। বিএনপির নেতা-নেত্রীরা এই মুহূর্তে ভোট চেয়ে রাজপথে নামলে সেই ক্ষোভের কিছুটা বহিঃপ্রকাশ ঘটতেই পারে। এই ধরনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ পাকিস্তান আমলেও ঘটেছে। মুসলিম লীগের অপশাসনে বিরক্ত বিক্ষুব্ধ মানুষ ওই দলের নেতাদের সভা-সমিতিতে গেলেই কালো পতাকা দেখিয়েছে, ইট পাটকেল মেরেছে। আইয়ুব খানের গবর্নর হিসেবে মোনায়েম খান এতই জনধিকৃত হয়েছিলেন যে, গবর্নরগিরি ছাড়ার পর তিনি একদিন ঢাকার সদরঘাটে যেতেই ক্রুদ্ধ জনতা তার গাড়ি বেষ্টন করে তাকে অপদস্ত করেছিল। এগুলো করেছে সাধারণ মানুষ। কোন দল, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ বা কোন রাজনৈতিক দল পরিকল্পনামাফিক করেনি। কোন মিডিয়াও তখন সে অভিযোগ তোলেনি। নিরপেক্ষতার নামে চরম ভ-ামি তখনও আমাদের সাংবাদিকতার একটা অংশকে এত কলুষিত করেনি। এই কলুষেরই এখন প্রকাশ দেখছি প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের মতো স্বঘোষিত কিছু নিরপেক্ষ পত্রিকায়। কাওরান বাজারের ঘটনাটিকে এই দুটি পত্রিকা শুধু ফলাও করে প্রচার করেনি, এমনভাবে প্রচার করেছে যাতে মনে হতে পারে আওয়ামী লীগ সমর্থকরাই খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা চালিয়েছে এবং আওয়ামী লীগ সরকারও চান না, বিএনপি অবাধে ও স্বাভাবিকভাবে তাদের নির্বাচন প্রচারণা চালাক। এই প্রচারণাটিকে যদি প্রতিষ্ঠা দেয়া যায়, তাহলে বিএনপি নির্বাচনে হারলে বলা যাবে সরকার বিএনপিকে অবাধে নির্বাচন প্রচার চালাতে দেয়নি এবং বিএনপির ভোটদাতারা অবাধে ভোট দিতেও পারেনি। সুতরাং এই নির্বাচনের রায় গ্রহণযোগ্য নয়। আর যদি বিএনপি নির্বাচনে জেতে, তাহলে বিএনপির নেতা-নেত্রীরা যতো জোরে বগল বাজাবেন, তার চাইতেও জোরে বগল বাজাবেন এই দুটি পত্রিকা। বলবেন, আওয়ামী লীগের হামলা, সরকারী বাধা উপেক্ষা করে জনগণ বিএনপির পক্ষে ভোট দিয়েছে, এখন এই সরকারের উচিত অবিলম্বে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে খালেদা জিয়ার দাবি মোতাবেক নতুন সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। এই দাবিকে সমর্থন দেয়ার জন্য তো তথাকথিত সুশীল সমাজ ও ড. কামাল হোসেন অধীর আগ্রহে ঘরে বসে প্রহর গুনছেন এবং ড. ইউনূসও কখন তার আকাশ ভ্রমণ স্থগিত রেখে বাংলাদেশের মাটিতে নামবেন সেজন্য অপেক্ষা করছেন। হুজুগে না মেতে একটু ঠা-া মাথায় কাওরান বাজারের ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যাবে, সেখানে খালেদাবিরোধী বিক্ষোভে স্থানীয় কিছু আওয়ামী লীগ সমর্থক-ব্যবসায়ী ও লোকজন অংশ নিতে পারে; কিন্তু বিক্ষোভটি এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের। গত তিন মাসে যাদের গাড়ি পুড়েছে, পরিবার পরিজন মারা গেছে, তারা বিএনপি নেত্রীকে দেখে আনন্দে বগল বাজাতে বাজাতে রাস্তায় নামবে এটা আশা করা যায় না। পরিস্থিতি বিবেচনায় বেগম জিয়ার উচিত ছিল শুধু নিজস্ব সিকিউরিটি নয়, সরকারী নিরাপত্তা ব্যবস্থাও চাওয়া এবং সরকারেরও উচিত তাকে এই নিরাপত্তা দেয়া। গত পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের মতো বর্তমানের তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক হয় সেদিকে হাসিনা সরকারের কঠোর দৃষ্টি রাখার কথা, এই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে সরকারের ক্রেডিবিলিটি বাড়বে এবং এই সরকারের অধীনে আগামী সাধারণ নির্বাচন যে ফ্রি এবং ফেয়ার হবে সে সম্পর্কে দেশের এবং দেশের বাইরের লোকের কোন সন্দেহ থাকবে না। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো বাতিল ও ব্যর্থ ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন দ্বারা নির্বাচন অনুঠানের জন্য বিএনপির দাবিটি মাঠে মারা যাবে। এই অবস্থায় বেগম জিয়ার গাড়িবহরে আওয়ামী লীগ পরিকল্পনা করে দু-চারটি ইট পাটকেল মেরে নিজেদের নাক কাটবে এটা কোন সুস্থ মস্তিষ্কের লোক বিশ্বাস করতে পারে না। প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার তা যতই তাদের পাঠকদের বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করুক না কেন! সাধারণত স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার নির্বাচনে জয়-পরাজয় কোন সরকারের ভাগ্য নির্ধারণ করে না। ধরে নেয়া হয় এটা সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোটদাতাদের কোন চূড়ান্ত রায় নয়। সেজন্যই ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচারের টোরি সরকারের আমলে টোরিদের ঘোর রাজনৈতিক শত্রু কেন লিভিংস্টোন গ্রেটার লন্ডন কাউন্সিলের নির্বাচনে বার বার টোরি প্রার্থীকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও থ্যাচার সরকারের আসন নড়াতে পারেননি। কিন্তু বাংলাদেশের তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ব্যাপারে একথা এখন বলা যাবে না। এমনিতেই গত সাধারণ নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে বিএনপি প্রশ্ন তুলেছে। গত ৫ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিএনপি জিতেছে। এরপর আগামী ২৮ এপ্রিলের নির্বাচনেও যদি বিএনপি জেতে, তাহলে নতুন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তাদের দাবি অপ্রতিরোধ্য হয়ে দাঁড়াবে। এই সত্যটা নির্বাচনী প্রচারে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মনে রাখা উচিত। আওয়ামী লীগের সামনে এখন উভয় সঙ্কট। আওয়ামী লীগ যদি স্বাভাবিকভাবেই তিনটি সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে জেতে, তাহলে বিএনপি ও তাদের সমর্থক সুশীল গোষ্ঠী ও দুটি ‘নিরপেক্ষ’ দৈনিক প্রচার চালাবে, নির্বাচন অবাধ হয়নি। বিএনপির জয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। আবার আওয়ামী লীগ যদি তিনটি আসনেই হারে, তাহলে সরকারের পদত্যাগ ও নতুন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি এবং দাবি মানা না হলে আন্দোলনের হুমকিতে দেশ গরম করে তোলা হবে। কেউ কেউ আমাকে বলেছেন, এই নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ দুটি আসনে জেতে এবং একটিতে হারে, তাহলে সম্ভবত নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বিএনপি এই দাবিটি তুলতে পারবে না। আমার ধারণা, তাহলেও তারা তুলবে। দুটি আসনেও আওয়ামী লীগের জয়কে তারা প্রশ্নবিদ্ধ করবে এবং আবার আন্দোলনে নামার জন্য হুমকি-ধমকি দেবে। ক্ষমতা দখল না করা পর্যন্ত তাদের ছলচাতুরির রাজনীতির অবসান হবে না। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের উচিত হবে কে কি ভাববে বা না ভাববে তার পরোয়া না করে তিনটি মেয়র পদেই জয়ী হওয়ার চেষ্টা করা। কেবল ভাল প্রার্থী দিয়ে বা সরকারের উন্নয়ন কাজের ফিরিস্তি দেখিয়ে এই জয় অর্জন করা যাবে না। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর চার্চিল যুদ্ধ জয়ের জন্য সেভিয়ার অব দ্য নেশন (জাতির ত্রাণকর্তা) খেতাব পেয়েছিলেন এবং ধরেই নিয়েছিলেন কৃতজ্ঞ জাতি তার দলকে নির্বাচনে বিপুল ভোটে জেতাবে। সে আশায় ওই বছরেই তিনি সাধারণ নির্বাচন দিয়েছিলেন। কৃতজ্ঞ জাতি তাকে ভোট দেয়নি। নির্বাচনে তার দলের ভরাডুবি হয়েছিল। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগেরও সতর্ক হওয়া উচিত। হাসিনা সরকার গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেছেন সেজন্যে কৃতজ্ঞ জাতি দলে দলে আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে এই আশায় বসে থাকলে দলটি ভুল করবে। খালেদা জিয়ার গাড়িতে ইটপাটকেল মারা হলেও তাতে কোন লাভ হবে না। আওয়ামী লীগকে প্রতিটি ভোটদাতার দুয়ারে দুয়ারে যেতে হবে। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে তাদের পারসেপসন বদলাতে হবে। বিএনপির ধ্বংসাত্মক রাজনীতি এবং মানুষ পুড়িয়ে মারার বর্বরতার ছবি তাদের কাছে আরও স্পষ্ট করে তুলতে হবে। ভোটদাতাদের এ কথাটি বোঝাতে হবে, বিএনপিকে ভোট দিলে এই নিষ্ঠুর ঘাতকের দলকেই ক্ষমতা দখলের পথ করে দেয়া হবে। দেশে শুরু হবে ধর্মান্ধতার রাজনীতি। যা পরিণামে বাংলাদেশেও ইরাক ও সিরিয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। ‘অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না।’- আমাদের সুশীল সমাজও আওয়ামী লীগ ও হাসিনা বিদ্বেষে অন্ধ হয়ে থাকলে ধর্মান্ধতার প্রলয় বন্ধ করতে পারবেন না। বেগম জিয়া নির্বাচনী প্রচারে নেমেছেন। কিন্তু একটিবার তার তথাকথিত আন্দোলনে দেশে যে অসংখ্য নর-নারী ও শিশুর মৃত্যু হয়েছে, তাদের জন্য শোক প্রকাশ ও তাদের হতভাগ্য পরিবার পরিজনের জন্য একটি সান্ত¡নার বাণী উচ্চারণ করেননি। অথচ নিজের দ্বিতীয় পুত্র কোকো, যার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, তার কবরে গিয়ে ক্যামেরার সামনে কেঁদেছেন। বাংলাদেশ কোন্ পথে, এই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে তার কিছুটা জবাব পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের মানুষ দেশের সঙ্কটে অনেক সময় রাজনৈতিক ম্যাচুরিটির পরিচয় দিয়েছে। এবারেও যদি দেয় এবং ধর্মান্ধতা, উগ্র মৌলবাদ ও অসত্য প্রচারণার রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে তাহলে ভবিষ্যতের সঙ্কটগুলো সে এড়াতে সক্ষম হবে। কিন্তু সেজন্য আওয়ামী লীগকে আরও তৎপর হতে হবে এবং দেশের মানুষকে সঠিক পথ নির্দেশ করতে হবে। এই নির্বাচনকে তাই গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। এর ফলাফলের ওপর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতও অনেকটা নির্ভর করছে। লন্ডন, ২১ এপ্রিল, মঙ্গলবার, ২০১৫
×