ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকা মহানগরে সমস্যার পাহাড়;###;নেই আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা;###;বড় চ্যালেঞ্জ দূষণরোধ;###;মশার উপদ্রব নিত্যসঙ্গী;###;খানা-খন্দকে ভরা অলি-গলি;###;সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতা

অপরিচ্ছন্নতায় বিশ্বে দ্বিতীয়

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৭ মার্চ ২০১৫

অপরিচ্ছন্নতায় বিশ্বে দ্বিতীয়

রাজন ভট্টাচার্য ॥ অন্তহীন সমস্যায় জর্জরিত ঢাকা মহানগরী। নাগরিকদের জন্য ২১ ধরনের সেবা দেয়া হয়ে থাকে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে। সাত বছর নির্বাচন না হওয়া ও দীর্ঘ সময় জনপ্রতিনিধি না থাকায় সেবার মান আরও কমেছে। বেড়েছে নতুন নতুন সমস্যা। কর্পোরেশন পরিচালনায় দেখা দিয়েছে আর্থিক সঙ্কট। দখল হয়ে গেছে বহু জমি। পয়ঃনিষ্কাশনের জটিলতা, নিরাপদ খাদ্য, অসম্ভব ঘনবসতি, লাগামহীন বাসা ভাড়া নগরবাসীর সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা। এর একটি সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেই সিটি কর্পোরেশনের। পার্ক, খেলার মাঠ, মার্কেট দখলে সক্রিয় ভূমিদস্যুরা। গড়ে ওঠেনি আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। বেড়েছে দূষণের মাত্রা। এছাড়াও রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না ঢাকার চার নদী। খালসহ জলাভূমি রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নেই। শিশুদের বিকাশের জন্য নেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। অপরাধীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে নগরীর পার্কগুলো। রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কার, ড্রেনের ব্যবস্থা, সকল প্রকার সনদ দেয়াসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কর্পোরেশনের ব্যর্থতার যেন শেষ নেই। নগরীর প্রায় অর্ধেক রাস্তা ও ফুটপাত দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। নগরবাসীর জন্য মান সম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি সিটি কর্পোরেশন। এমন বাস্তবতায় নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীদের পাহাড় সমান সমস্যা সামনে নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্জ ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়ন, প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা, জনবল বাড়ানো, সড়ক সংস্কার রাখা, যানজট কমানো, বেহাত হওয়া ভূমি উদ্ধারসহ সর্বোপরি স্বাস্থ্যসম্মত সবুজ ও পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ে তোলাই হবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রধান দায়িত্ব। পাশাপাশি আধুনিক যোগাযোগ, পরিবহন ব্যবস্থা, উন্নত পার্কিং ব্যবস্থা, ভাসমান হকার্সদের জন্য জায়গা বরাদ্দ, পর্যাপ্ত পাবলিক ও ভ্রাম্যমাণ টয়লেটের ব্যবস্থার বিষয়টি তো রয়েছেই। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চরম দুর্ভোগ আর ভোগান্তির মধ্যেই রাজধানীতে বসবাস করছেন প্রায় দুই কোটি মানুষ। খানাখন্দে ভরা নগরীর অলিগলির অনেক রাস্তাঘাটের করুণ দশা। যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, দিনের বেলায় বর্জ্য অপসারণ, মশার উপদ্রব যেন নগরীর মানুষের নিত্যসঙ্গী। জন্মনিবন্ধন থেকে মৃত্যুসনদ পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই চলছে দীর্ঘসূত্রতা, হয়রানি আর ভোগান্তি। টাকা ছাড়া মিলছে না নাগরিকতার সনদও। খাদ্য নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই। এক কথায় মেগাসিটি ঢাকার চারদিকে শুধু সমস্যা আর সমস্যা। অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচন হয় ২০০২ সালের এপ্রিলে। ২০০৭ সালের মে মাসে এর মেয়াদ শেষ হয়। তৎকালীন নির্বাচন কমিশনও দু’দফা ভোটের উদ্যোগ নিলে আইনী জটিলতায় আটকে যায়। ২০১১ সালের ৩০ শে নবেম্বরে ৫৭টি ওয়ার্ড নিয়ে দক্ষিণ ও ৩৬টি ওয়ার্ড নিয়ে উত্তর সিটি কর্পোরেশন গঠিত হয়। পরের বছর ইসি দুই কর্পোরেশনের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করলেও আইনী জটিলতায় তা ফের স্থগিত হয়। ২০১৩ সালের মে মাসে নির্বাচনের ওপর আদালতের স্থগিতাদেশ উঠে গেলে নতুন করে তফসিল ঘোষণার উদ্যোগ নেয় নির্বাচন কমিশন। অর্থসঙ্কট ॥ সম্প্রতি ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দক্ষিণ ও উত্তরে চরম অর্থসঙ্কট দেখা দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে মন্ত্রণালয়ের কাছে টাকা চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছিল। যদিও এখন অনেকটাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক। কয়েকমাস আগেও সিটি কর্পোরেশনের ঠিকাদারদের বকেয়া ছিল প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকা। দক্ষিণে ৫টি অঞ্চলে ৫৭টি ওয়ার্ড রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৬ হাজার কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছে। এ সব কর্মকর্তা ও স্টাফদের প্রতি মাসে সাড়ে ৬ কোটি টাকা বেতন-ভাতা দিতে হয়। সিটি কর্পোরেশনে গাড়ি আছে ৪শ’। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থেকে বিভিন্ন কাজে যানবাহন ব্যবহার করা হয়। প্রতিদিন গাড়িতে তেলসহ অন্যান্য খরচ লাগে। দূষণরোধ বড় চ্যালেঞ্জ ॥ সর্বশেষ আন্তর্জাতিক জরিপে ২০১৪ (সালে) যুক্তরষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের প্রকাশিত গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টাল পারফরমেন্স এ্যান্ড ইনডেক্সে বিশ্বের ১৭৮ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৯ উল্লেখ করা হয়েছে। এ সব দেশের সার্বিক পরিবেশ ও জীবন মানেই এ সূচকে শুধুমাত্র বায়ু দূষণের কারণেই বাংলাদেশের অবস্থান রয়েছে ১৭৮তম। অর্থাৎ বায়ু দূষণের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। দূষণের দিক থেকে ঢাকা অন্যতম নগরী। বিশেষজ্ঞদের মতে, নদী-খাল দখল ও দূষণের প্রতিযোগিতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঢাকার বায়ু দূষণ। পরিবেশ অধিদফতরের হিসেবে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় বায়ু দূষণের পরিমাণ ৫০ গুণের বেশি রয়েছে, রয়েছে শব্দ দূষণ। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেন ঢাকা শহরের চারপাশের ইটভাঁটি, যানজট, পুরানো মোটরগাড়ি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া এবং ধূলা। এ সব মিলিয়ে ঢাকার পরিবেশ এখন রীতিমতো অস্বস্তিকর। তাদের মতে, সারাদেশে কমবেশি ১০ হাজার ইটভাঁটি রয়েছে এবং এর প্রায় অর্ধেকই রয়েছে ঢাকা শহরের আশপাশে। বিশ্বব্যাংক ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের যৌথ গবেষেণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে ঢাকার বায়ু দূষণের মাত্রা এতো বেশি যে, বাতাসে এখন প্রতি কিউবিক মিটারে এয়ারবোর্ন পার্টিকুলেট ম্যাটারের পরিমাণ ২৫০ মাইক্রোগ্রাম, যা সহনীয় মাত্রার থেকে পাঁচগুণ বেশি (সহনীয় মাত্রা ৫০ মাইক্রোগ্রাম)। এদিকে নিউইয়র্কভিত্তিক ‘মার্চার হিউম্যান রিসোর্স কনসাল্টিংস’ নামের একটি সংস্থার স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক এক গবেষণা সমীক্ষায় ২০০৭ সালের মূল্যায়নে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে অপরিচ্ছন্ন শহরের তালিকায় দ্বিতীয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এছাড়া এ পর্যন্ত যে সব জরিপ হয়েছে ঘুরে-ফিরে ঢাকা শহরের নাম সবার ওপরে এসেছে। কখনও প্রথম আবার কখনও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ঢাকা। বায়ু দূষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসা সুবিধা, পয়ঃনিষ্কাশন, ঘনবসতি এবং সংক্রামক রোগ-ব্যাধির প্রাদুর্ভাবকে পরিমাপক ধরে এ সব সমীক্ষা চালানো হয়। আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও বড় চ্যালেঞ্জ ॥ বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা মতে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৭ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে ডাম্পিং হয় ৩ হাজার ৮শ’ মেট্রিক টন। বেসরকারী জরিপ মতে প্রতিদিন গৃহস্থালি বর্জ্য উৎপাদিত হয় ৫ হাজার ৯শ’ ৫০ মেট্রিক টন। এছাড়া মেডিক্যালসহ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে ১ হাজার ৫০ মেট্রিক টন। রাস্তাঘাট থেকে উৎপাদিত হয় ৪শ’ মেট্রিক টন। আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাজে সহযোগিতার জন্য জাপানের দাতা সংস্থা এগিয়ে এসেছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের জন্য চ্যালেঞ্জ কি থাকতে পারে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিএম এনামুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, আমার দুই বছরের দায়িত্ব পালনকালে তেমন কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়নি। নিয়মিত কাজ করার চেষ্টা করেছি। যাতে মানুষের কোন দুর্ভোগ না হয়। এখন উত্তর সিটি কর্পোরেশন আর্থিকভাবে সচ্ছল। কোন সমস্যা নেই। তিনি বলেন, নির্বাচিত মেয়র প্রতিনিধিদের জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ হবে তারা ভোটারদের কাছে কি প্রতিশ্রুতি দেবেন। প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হবে মূল কাজ। এছাড়া নিয়মিত কাজের মধ্যে রয়েছে, নতুন সড়ক নির্মাণ, সড়ক সংস্কার, মশক নিধন ও নিয়ন্ত্রণ, আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থা, বনবল বাড়ানো, ভবন নির্মাণ, দূষণ রোধে কাজ করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি। এদিকে সিটি কর্পোরেশন ছাড়াও রাজধানীবাসীকে সেবাদানে সরকারের অন্য ৫৫টি প্রতিষ্ঠান জড়িত। কিন্তু এ সংস্থাগুলোর মধ্যে প্রকট সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় করা না গেলে নগরীর উন্নয়ন ও ভাল সেবা প্রদান কোনভাবেই সম্ভব নয়। পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশন আইনে মেয়রের ওপর বিপুল কাজ ন্যস্ত করা হলেও তাকে আইনী ক্ষমতা দেয়া হয়নি। এ কারণে মেয়রের পক্ষে অনেক সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। ১৪ মার্চ নাগরিক সংগঠন ‘আমরা ঢাকা’র উদ্যোগে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স মিলনায়তনে ‘আজ ও আগামীর ঢাকা’ শিরোনামে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, পৃথিবীর সব শহরে নগর পরিকল্পনা করে সিটি কর্পোরেশন। ঢাকায় এ কাজ করে রাজউক। এ ব্যবস্থা বদলাতে হবে অথবা নির্বাচিত হলে এ সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে নগর পরিকল্পনা করতে হবে। নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকা নিয়ে মেয়র প্রার্থীদের ভিশন কী, সেটা স্পষ্ট করতে হবে। পাশাপাশি শহর পরিচালনায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে সম্ভাব্য মেয়রের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ঢাকাকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার কথাও বলেন তিনি। আলোচকরা বলেন, যিনিই মেয়র হোন না কেন, আমরা তাকে সহযোগিতা করতে চাই। গবেষণা ও পরিকল্পনার কথা জানাতে চাই।
×