ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আত্মহননে বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান দশম, যা ২১১ সালেও ছিল ৩৮তম

দেশে আত্মহত্যা বাড়ছে- ৬০ ভাগই নারী

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

দেশে আত্মহত্যা বাড়ছে- ৬০ ভাগই নারী

শর্মী চক্রবর্তী ॥ জীবন সবার কাছে বড় মূল্যবান। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ বিভিন্ন কর্মকা-ের সঙ্গে নিজেদেরকে জড়িত করে। কিন্তু বর্তমানে আত্মহত্যার সংখ্যা দিনের পর দিন আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে। আর এদিকে এগিয়ে আছে নারীরা। অন্যান্য দেশে আত্মহত্যায় পুরুষের সংখ্যা বেশি হলেও বাংলাদেশে এ চিত্র ভিন্ন। ২০১৪ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের আত্মহত্যার পরিস্থিতি ভয়াবহ। তথ্যে জানা যায়, আত্মহত্যায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। যা ২০১১ সালে ছিল ৩৮তম। বিশ্বের প্রায় সব দেশে নারীর তুলনায় তিন থেকে চার গুণ বেশি আত্মহত্যা করে পুরুষরা। কিন্তু বাংলাদেশে আত্মহত্যাকারীদের ৬০ ভাগই নারী। এ দেশে নারীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হন। বেশির ভাগ নারীই আর্থিকভাবে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। দেশে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণই হচ্ছে আত্মহত্যা। প্রতি ঘণ্টায় একজন আত্মহত্যা করে। গত পাঁচ বছরে প্রায় ৮০ হাজার ৬৬৪ জন আত্মহত্যা করেছেন। খোদ রাজধানীতে প্রতিদিন দুই থেকে তিন জন আত্মহত্যা করছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে, ১৫Ñ৪৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের একটি হলো আত্মহত্যা। গত বছর ডব্লিউএইচও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, ২০২০ সাল নাগাদ প্রতিবছর সাড়ে ১৫ লাখ মানুষ আত্মঘাতী হবেন। আত্মহত্যার চেষ্টা চালাবেন এরও ১০ থেকে ২০ গুণ মানুষ। আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, অপ্রাপ্তি, প্রতারণা, হতাশা, মাদক, মানসিক অবসাদ, পারিবারিক নির্যাতন, ইভটিজিং ও অতিরিক্ত আবেগ প্রবণতার পারিবারিক সহিংসতা, সম্পর্কের অবনতি, প্রেমে ব্যর্থ বা প্রত্যাখ্যাত হওয়া। যৌন হয়রানি, বেকারত্ব, মানসিক চাপ বা অসুস্থতা, তালাক, হতাশা, মা-বাবার সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি, সালিশে মিথ্যা শাস্তি পাওয়া, প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থতাসহ বিভিন্ন কারণেই বেশির ভাগ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। এছাড়া ফেসবুক, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোনের অপব্যবহার ও সহজলভ্যতাও কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করেছেন। শুধু গত পাঁচ বছরে ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৫০ হাজার ৬৬০ জন। এ তথ্য পুলিশ সদর দপ্তরের। যাঁরা আত্মহত্যা করেছেন বা চেষ্টা করেছেন, তাঁদের বড় অংশের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এ নিয়ে গোটা বিশ্ব উদ্বিগ্ন। বিভিন্ন সংস্থা দাবি করেন, মেয়েদের নির্যাতন বা মর্যাদাহানির কারণে আত্মহত্যার অনেক খবর প্রকাশ হয় না বলে এর সঠিক পরিসংখ্যানও পাওয়া যায় না। তবে সংস্থাগুলো বলছে, আত্মহত্যাকারীদের বেশির ভাগই বিভিন্ন বয়সী নারী। বেসরকারী সংগঠন ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবির বলেন, নারীদের আত্মহত্যার প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। যদিও বিষয়টি অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। বিশেষ ক্ষেত্রে আইন, সমাজের পাশাপাশি পরিবারও একজন নারীকে যথাযথ সমর্থন দেয়নি বা দেয় না। আর তখনি একজন নারী হতাশা, ক্ষোভ অভিমান নিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। খুশি কবির বলেন, যে পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। কারণ অনেক ঘটনাই প্রকাশিত হয় না। এছাড়া একটি নারীকে নির্যাতনের পর যখন সে আত্মহত্যা করে সেটি কি হত্যা না আত্মহত্যা এ প্রশ্নটি রয়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায় হত্যার নামে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া হয়। তাই নারীদের নিয়ে সমাজ ও পরিবারকে তার চিন্তাধারা বদলাতে হবে। এ দায়িত্বটি মূলত পুরুষদের। তাদের মানসিকতাও পরবির্তন করতে হবে। একজন সরকারী আইনজীবী (সহকারী এটর্নি জেনারেল) এ বিষয়ে বলেন, নারীদের আত্মহত্যার প্ররোচনার জন্য বাংলাদেশ দ-বিধি ও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, সেক্ষেত্রে মামলা হলেও শাস্তির নজির খুব একটা চোখে পড়ে না। এজন্য দায়ী আত্মহত্যার প্ররোচনার আইনগত সঠিক সংজ্ঞা না থাকা, মামলায় তথ্য, প্রমাণ, সাক্ষীর অভাব। যে কারণে নিম্ন ও উচ্চ আদালত থেকে আসামিরা সহজেই জামিন পেয়ে যায়। সঙ্গত কারণে প্ররোচনাকারীদের আইন ও বিচারের মুখোমুখি করা যাচ্ছে না। ১৫ আগস্ট রাতে গুলশান থানা পুলিশ কলেজ হোস্টেলের কক্ষ থেকে রাজধানীর ক্যামব্রিয়ান স্কুল এ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণীর ছাত্রী নাঈমা বিনতে নাহিদের লাশ উদ্ধার করে। আত্মহত্যার আগে সে একটি সুইসাইড নোট লিখে গেছেন। আম্মু-আব্বু আমাকে মাফ করে দিও। আমি অন্যায় করেছি, আমার সাজা হওয়া উচিত। আমি আর কোন কিছু সহ্য করতে পারছি না। খুব অসহায় লাগছে। তুমিই তো বলো আমার মতো মেয়ের দরকার নেই। আমি এভাবে তোমাদের কষ্ট দিতে চাই না। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমি এ জীবন সহ্য করতে পারছি না। আমি একজনকে ভালবাসি। আমি খারাপ, আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। তাই আমি চলে গেলাম। পুলিশ ও নাঈমার বন্ধুরা জানান, তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল বাবু নামে এক সহপাঠীর। বিষয়টি নাঈমার মা-বাবা জেনে ক্ষুব্ধ হন তার প্রতি। ঈদের ছুটি কাটিয়ে গত ৮ আগস্ট কেশবপুরের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফেরার আগে নাঈমার মোবাইল ফোনটি কেড়ে নেন তারা। অন্যদিকে নাঈমার প্রেমিক বাবু তার সঙ্গে প্রতারণা করে। তারই সহপাঠীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোল। মানসিক এ চাপ সহ্য করতে না পেরেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় নাঈমা। শুধু নাঈমা নয়। ২০১৪ সালের বহুল আলোচিত আত্মহত্যার ঘটনাটি ঘটেছে রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের গরীবে নেওয়াজ সড়কে ১১ নম্বর বাসায়। ইংলিশ মিডিয়ামে অধ্যয়নরত ভাই-বোনের আত্মহত্যার নির্মম ঘটনাটি সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কিশোর-যুবরাই বেশি আত্মহত্যা করছেন। এর মধ্যে পুরুষের তুলনায় নারীরাই বেশি আত্মহত্যাকে বেছে নিচ্ছেন। কিশোরগঞ্জের ভৈরবের মুর্শিদ মুজিব উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী হাসি আক্তার জ্যোতি (১৫) স্থানীয় সুস্মিত সুলতান (২০) নামে এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় থেকে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। তার কপট প্রেম বুঝতে পারেনি জ্যোতি। মনপ্রাণ উজাড় করে দেয় সুস্মিতকে। প্রেম গড়ায় শারীরিক সম্পর্কে। প্রতারক প্রেমিক সুস্মিত তাদের বিশেষ মুহূর্তের ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। ফেসবুকে আপলোড করে। এরপরই লজ্জায় অপমানে জ্যোতি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। প্ররোচনার অভিযোগে মামলায় গ্রেফতার হয় সুস্মিত। মামলা তুলে নেয়ার জন্য প্রভাবশালীরা চাপ দেয় জ্যোতির পরিবারকে। একদিকে মেয়ে হারানোর শোক, সামাজিক অসম্মান আর অন্যদিকে বিচার না পাওয়ার শঙ্কায় মুষড়ে পড়ে জ্যোতির পরিবার। রাজধানীর তেজগাঁওয়ের কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের অবসরপ্রাপ্ত মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ আখতারুজ্জামান বলেন, মানসিক চাপ, অপ্রাপ্তি, মাদক ও আবেগপ্রবণতার কারণেই আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটছে। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকা প্রসঙ্গে তিনি জানান, বয়ঃসন্ধিকালে আবেগ বেশি থাকে। ওই সময়ে কোন অপ্রাপ্তিই তারা সহজে মেনে নিতে পারে না। এ থেকে মানসিক যে চাপ সৃষ্টি হয় তা সহ্য করতে না পেরেই আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়। আত্মহত্যার প্রবণতার প্রতিকার সম্পর্কে তিনি বলেন, চাইলেই সব পাওয়া যায় না। অপ্রাপ্তিটাকে সহজে গ্রহণ করার মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে। যেমন, খেলাধুলার মাধ্যমে আমরা জয় অনুভব করি আবার পরাজয়টাও গ্রহণ করি। এটি বাস্তব জীবনের একটি রিহার্সাল। এই শিক্ষার জন্য পারিবারিক সচেতনতা প্রয়োজন। এছাড়াও, অভিভাবকদের উদাসীনতা বা জেনারেশন গ্যাপ, পারিবারিক কলহ, সামাজিক বৈষম্য, দারিদ্র্য, জুয়া, দীর্ঘমেয়াদি পীড়াদায়ক রোগ অনেক সময় আত্মহত্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মাদকসেবীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার সাধারণ মানুষের তুলনায় ১৪ গুণ বেশি। বিশেষ করে হিরোইন ও ইয়াবা সেবনে আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, মূলত হতাশা থেকে মানুষ আত্মহত্যা করে। আর আত্মহত্যাকে তারা ‘অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করছেন। তবে আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা সম্ভব বলে মনোচিকিৎসকরা মনে করেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আত্মহত্যাকারীদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের যৌথ এক গবেষণায় জানা যায়, ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সীরাই বেশি আত্মহত্যা করছেন। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা এই যে, তরুণ-তরুণীদের আচার-আচরণে এখন আগের চেয়ে পরিবর্তন এসেছে। অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এর অন্যতম কারণ ইয়াবা-আসক্তি। অতিমাত্রায় ইয়াবা সেবনের ফলে তরুণরা ‘সাইকোসিস’ নামক মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, যার প্রভাবে তারা রাগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়ে অসহিষ্ণু হয়ে পড়েন এবং কখনও কখনও উত্তেজিত হয়ে আত্মহত্যার মতো অপরাধ ঘটান।
×