ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বই উৎসব

প্রকাশিত: ০৫:০১, ২ জানুয়ারি ২০১৫

বই উৎসব

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জামায়াতের হরতাল উপেক্ষা করেই দেশজুড়ে শুরু হলো ৩৩ কোটি পাঠ্যবই বিতরণের অন্যরকম এক উৎসব। প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রতিটি শিক্ষার্থীর হাতে ঝকঝকে নতুন পাঠ্যবই। দেশজুড়ে বৃহস্পতিবার ছিল এমনই এক উৎসব যার আমেজ থাকবে সপ্তাহজুড়ে। শিক্ষার্থীরা নেচে-গেয়ে, বেলুন আর কাঠির মাথায় বাঁধা রঙিন রেশমি ফিতা উড়িয়ে শামিল হয় উৎসবে। বই পেয়ে তারা আনন্দে উচ্ছ্বসিত। রাজধানীসহ দেশের কোথাও শিশুদের এ উৎসবের আনন্দকে ম্লান করতে পারেনি জামায়াতের হরতাল। উৎসবের উদ্বোধন করে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার বলেছেন, শিশুদের জোয়ারের কাছে হরতাল ব্যর্থ। যারা দেশের উন্নতি চায় না, তারা আজ হেরে গেছে। সারাদেশের সবখানেই উৎসব হচ্ছে। সারাদেশে উৎসব হলেও কেন্দ্রীয়ভাবে মতিঝিল সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে কর্মসূচী পালন করে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সকাল ১০টায় বিদ্যালয়ের মাঠে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিয়ে উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার। ছিলেন শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান, প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিব কাজী আকতার হোসেন, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল কাসেম মিয়া, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক মোঃ আলমগীর হোসেন প্রমুখ। এর আগে হরতাল উপেক্ষা করেই কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে জড়ো হয় হাজারও কচিমুখ; সঙ্গে মা-বাবারাও। বেলুন আর কাঠির মাথায় বাঁধা রঙিন রেশমি ফিতা উড়িয়ে শিশুরা যোগ দেয় উৎসবে। শামিল হন মন্ত্রীরাও। এবারও প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী স্তরের সকল শিশু পেয়েছে সম্পূর্ণ অফসেট পেপারে সেলাইবিহীন ও হিট লেমিনেটিংয়ে তৈরি চার রঙা বিষয়ভিত্তিক ছবিসংবলিত ঝকঝকে বই। যা বৃষ্টিতে ভিজবে না, ছিঁড়েও যাবে না। হরতালের মধ্যেও উৎসবে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের উপস্থিতিতে মাঠ ভরে গেছে জানিয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, যারা দেশের উন্নতি চায় না, যারা আজ হরতাল দিয়ে দেশের বিরুদ্ধে কাজ করছে। তারা আজ হেরে গেছে। আমি সারাদেশে খবর নিয়েছি, সবখানেই উৎসব হচ্ছে। পৃথিবীর কোন দেশে এত বিশালসংখ্যক বই বিনামূল্যে দেয়া হয় না জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, এটা কেউ বিশ্বাসও করতে চায় না। কিন্তু আমরা বিনামূল্যে বই তুলে দিচ্ছি। শিক্ষার্থীদের বেশি ও কঠিন কঠিন বই দেয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, আপনাদের সন্তান একটি, আর আমার সঙ্গে চার কোটি। তাদের আধুনিক যুগের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। তাই তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, ক্যারিয়ার শিক্ষা এবং অষ্টম শ্রেণীতে কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা চালু করা হয়েছে। ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার সময়ও শিক্ষার্থীরা টাকা দিয়ে বই কিনত। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ২০১০ সাল থেকে প্রথম শ্রেণী হতে নবম শ্রেণী পর্যন্ত সব শিক্ষার্থী বিনামূল্যে বই পাচ্ছে। এখন কেউ বলতে পারবে না যে, তারা আর বই পায় না। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ২০১০ সালে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়, সব শিশুকে স্কুলে নিয়ে আসা হবে। সে হিসাবে প্রথমে ১৯ কোটি বই দেয়া হয়। এরপর তা বৃদ্ধি করে ২২ কোটি, পরে ২৪ কোটি এবং তারও পরে ২৭ কোটি বই বিতরণ করা হয়। ২০১৪ সালে ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থীকে ৩১ কোটির ওপর বই বিতরণ করা হয়। এ বছর সর্বোচ্চ বই বিতরণ করা হচ্ছে উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, চার কোটি ৪২ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩২ কোটি ৪৬ লাখ বই বিতরণ করা হচ্ছে। আগামী এক সপ্তাহ ধরে উৎসব চলবে। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসবে আর নতুন বই নিয়ে বাড়ি ফিরবে। শিক্ষাক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের সমতা অর্জনের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, আমরা ছেলে ও মেয়ের সমতা নির্ধারিত সময় ২০১৫ সালের আগেই অর্জন করতে পেরেছি। পাঠ্যপুস্তক বিতরণে বিশ্বের মধ্যে উদাহরণ তৈরি করেছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতির প্রশংসার কথা উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ বলেন, ভারতের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের প্রশংসা করে বলেছেন, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, বিতরণ ও ব্যবস্থাপনা পৃথিবীর আর কোথাও এভাবে সম্ভব হয়নি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বপ্নের কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলছি। আমরা বিশ্বমানের শিক্ষা, বিশ্বমানের প্রযুক্তি গড়ে তুলেছি। জাতীয় শিক্ষা ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তাঁরা দিন-রাত পরিশ্রম করে এ সব কাজ করেছেন। এ জন্য তাঁদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিশ্বে আমাদের উপযোগিতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষায় বেশি বিনিয়োগ করছি। এটাই শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ, বড় বিনিয়োগ। তিনি বলেন, বিশ্বে আমরা উদাহরণ সৃষ্টি করেছি। শিক্ষায় আমরা এগিয়ে গেছি অনেকদূর। আমাদের সন্তানরা দেশে-বিদেশে প্রতিটি স্থানে ভাল করছে। এদিকে মাঠে আনন্দমুখর পরিবেশে উৎসব শুরু হলেও শেষ হয়েছে কিছুটা অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে। অনুষ্ঠানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রীকে সম্বোধন করা হয় ওই মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে। শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন মন্ত্রীকে সচিব সম্বোধন করায় মঞ্চে হাসাহাসি ফিসফিস শুরু হয়। একই সঙ্গে মন্ত্রী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করলেও মন্ত্রণালয়ের সচিবকে সভাপতি বলা নিয়েও অতিথিদের মধ্যে ফিসফাস চলে। অস্বস্তিতে পড়েন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী। এছাড়া বসার ব্যবস্থা না করায় বিদ্যালয় মাঠে ধুলোর ওপর বিছানো চাঁটাইয়ের ওপর বসে পড়ে শিক্ষার্থীরা। অভিভাবক ও অতিথিদের জন্য কিছু চেয়ারের ব্যবস্থা থাকলেও তাতে সংকুলান হয়নি। দুই মন্ত্রী ছাড়াও অন্য আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে মঞ্চে ছিলেন শতাধিক মানুষ। মঞ্চের সামনে আরও অর্ধশত মানুষের ভিড়। এ জন্য মঞ্চ ছিল প্রায় আড়ালে। মন্ত্রীরা বক্তব্য দিয়ে ভিড় ঠেলে মাঠে নেমে বেলুন ওড়ান। কয়েক শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দেন ভিড় ঠেলেই। প্রচ- ভিড়ে হেনস্তার শিকার হয় ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা। ভিড়ে অনেক শিশু কান্নাকাটি করছিল। অভিভাবকরা অনুষ্ঠান ভালভাবে আয়োজন না করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। স্কুলের রোভার স্কাউটদের দিয়ে শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করা হলেও তা ব্যর্থ হয়। জানা গেছে, ১০০ ভাগ বই চলে গেছে স্কুলে। যথেষ্ট বই বাফার স্টকে রাখা হয়েছে। কোথাও চাহিদা বাড়লে বা বই কম হলে চিন্তার কোন কারণ নেই। প্রথম দিনই স্কুলে আসতে না পারলেও পরে এলে বই পাবে শিক্ষার্থীরা। ২০১০ সাল থেকে গেল মহাজোট সরকারের উদ্যোগে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কার্যক্রমের শুরু। এবারও সেই রাজনৈতিক শক্তির বদৌলতেই চলছে সাড়ে ৩২ কোটির বেশি বই বিতরণের বিশাল কর্মযজ্ঞ। পর পর ছয় বছর। বছরের শুরুতেই সারাদেশে ঘরে ঘরে বই পৌঁছে দিয়ে সারা পৃথিবীতে নতুনভাবে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের মতো আগামী বছরও প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিশু শিক্ষার্থীর মধ্যে বই, রঙিন খাতাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রায় দুই কোটি কপি শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হবে। ২০১০ সালের আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনই ছাত্রছাত্রী যেমন পায়নি বিনামূল্যের বই তেমনি বছরের প্রথম দিনও পাঠ্যবই হাতে পায়নি। বরং তা পেতে পেতে মার্চ/এপ্রিল পার হয়ে যেত প্রতিবছর। আর এই সুযোগে পাঠ্যবই নিয়ে অসাধু সিন্ডিকেট চক্র অস্থির করে তুলত বইয়ের বাজার। মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই প্রথমবারের মতো ২০১০ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের দুই কোটি ৭৬ লাখ ৬২ হাজার ৫২৯ শিক্ষার্থীকে ১৯ কোটির অধিক বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছিল। পরে একটি বিশেষ মহল এনসিটিবির গুদামে আগুন লাগিয়ে দেয়। শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে ২০১১ ও ২০১২ সালে বইয়ের সংখ্যা ২৩ কোটিতে উন্নীত করতে হয়। পরের বছর প্রায় ২৭ কোটি। আর গেল বছর দেয়া হয়েছে সাড়ে ৩১ কোটি কপি পাঠ্যবই।
×