ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

খোদ রাজধানীতেই চলে এক লাখ অবৈধ যানবাহন

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ১১ নভেম্বর ২০১৪

খোদ রাজধানীতেই চলে এক লাখ অবৈধ যানবাহন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সরকারী হিসেবে শুধু রাজধানীতেই চলছে এক লাখ সনদহীন যানবাহন। সারাদেশে প্রায় সোয়া তিন লাখ। এই হিসেবে অবৈধ চালকও আছে সমসংখ্যক! কিন্তু অবৈধ যানবাহন ও চালকদের বিরুদ্ধে অভিযানের প্রথম দিনে উল্লেখ করার মতো সফলতা নেই। রাজধানীতে সারাদিন মাত্র তিনটি গাড়ি পাকড়াও করতে পেরেছে বাংলাদেশে রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) ভ্রাম্যমাণ আদালত। সোমবার অভিযান শুরুর পর পরই অনেকটাই গণপরিবহন শূন্য হয়ে পড়ে। বাস চলাচল একেবারেই কমে যায়। রাস্তায় দিনভর চালক-যানবাহন ও আদালতের মধ্যে লুকোচুরি খেলা হয়েছে। ফলে নগবাসীর দুর্ভোগ চরমে ওঠে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাসের জন্য যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। সারাদেশে একযোগে এই অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানের কারণে রাস্তায় বাস চালানো বন্ধ করে দেন মালিক-শ্রমিকরা। এতে ভোগান্তি পোহাতে হয় যাত্রীদের। ধারাবাহিক এই অভিযান পরিচালনার কথা জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিকেলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম শেষ হয়। এর পরই পরই যানবাহনের দখলে চলে যায় রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো। বেলা পাঁচটার পর থেকে বিভিন্ন এলাকায় যানজট লেগে যায়। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর মাত্রা আরও তীব্র হয়। কাওরানবাজার, মতিঝিল, কাকরাইল, মালিবাগ, মৌচাক, ধানম-ি, সায়েন্সল্যাব, নিউ মার্কেট, বনানী, গুলশানসহ বিভিন্ন রুটে দেখা গেছে তীব্র যানজট। সম্প্রতি যশোরের অভয়নগরে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৪০ যাত্রী নিহত হওয়ার পর পরই ‘নিরাপদ সড়ক’ যোগাযোগ নিশ্চিত করার দাবি ওঠে। সড়ক নিরাপত্তা জোরদার করতে লাইসেন্সবিহীন গাড়ি ও চালকসহ মেয়াদোত্তীর্ণ পরিবহনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার বিষয়টি সামনে আসে। টনকনড়ে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের। স্বরাষ্ট্র, পরিবহন মন্ত্রণালয় পৃথকভাবে ২৮ অক্টোবর দেশের সকল জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারদের চিঠি দেয়। ১০ নবেম্বর থেকে অবৈধ যান ও চালকদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান চালাতে বলা হয়। পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সারাদেশে অবৈধ ও ক্রটিপূর্ণ যানবাহনের বিরুদ্ধে লাগাতার অভিযান চলবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে বিআরটিএর মোবাইল কোর্ট অভিযান পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের কাছে একথা বলেন তিনি। মানিক মিয়া এ্যাভিনিউতে অভিযান পরিদর্শনে গিয়ে মন্ত্রী বলেন, প্রথমদিন বিকেল পর্যন্ত ৭৭ মামলা এবং ৯৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এক গাড়ি চালককে পাঁচ দিনের জেল, একটি গাড়ি ধ্বংস ও দুটি ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে। রাজধানীর কাকলী, বনানী, গাবতলী ও কাওরানবাজারÑএই চার স্থানে প্রথম দিনে মোবাইল কোর্ট বসানো হয়। পুলিশসহ চার ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান পরিচালনা করেন। গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে মোবাইল কোর্ট বসানোর কারণে সকাল থেকেই গোটা রাজধানী কার্যত বাসশূন্য। অন্যান্য গণপরিবহনও ছিল তুলনামূলক কম। প্রাইভেটকার চলেছে সবচেয়ে বেশি। ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। বিআরটিএ পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) বিজয় ভূষণ পাল জানান, রাজধানীর চার পয়েন্টে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অভিযান চলে। অভিযানের পাশাপাশি বিআরটিএ সচেতনতামূলক ক্যাম্পেনের অংশ হিসেবে স্টিকার ও লিফলেট বিতরণ করা হয়। রাজধানীর কাওরান বাজার পয়েন্টে ঢাকা মেট্রো-ট-২১৪০ নম্বরের বাসটি জরিমানা পরিশোধ করতে না পারায় ডাম্পিংয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেন কর্তব্যরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দেবাশীষ নাগ জানান, কোন রকম প্রচার ছাড়াই আমরা অভিযানে নেমেছি। লক্ষ্য, ফিটনেসবিহীন ও রোড পারমিটবিহীন ছাড়া গাড়ি আটকানো। বিআরটিএ কার্যালয় থেকে অভিযান মনিটরিং করার কথাও জানান তিনি। সকল গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা করা হচ্ছে। ত্রুটি পাওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে আদায় করা হচ্ছে জরিমানা। কেউ এক ঘণ্টার মধ্যে জরিমানা দিতে ব্যর্থ হলে ডাম্পিং স্টেশনে গাড়ি পাঠানো হচ্ছে। রাস্তায় গণপরিবহন কম থাকার প্রশ্নে তিনি বলেন, চালক ও হেলপাররাই অভিযানের খবর ছড়িয়ে দিয়েছে। এজন্য বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি চলাচল কমছে। অভিযানের ভয়ে অনেক চালক রাস্তায় গাড়ি রেখে পালানোর কথাও জানান তিনি। বেসরকারী বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, দেশে মোট যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখের বেশি! সরকারী তালিকাভূক্ত যানবাহনের সংখ্যা ২১ লাখ। এরমধ্যে ফিটনেস ছাড়াই চলছে সাড়ে তিন লাখেরও বেশি যানবাহন। লাইসেন্স প্রাপ্ত চালকের সংখ্যা ১৩ লাখ। সাত লাখ অবৈধ চালক রেজিস্ট্রেশনভূক্ত পরিবহন চালাচ্ছেন। সবমিলিয়ে দেশে অবৈধ চালকের সংখ্যা ৩৩ লাখেরও বেশি। তারাই দাবড়ে বেড়াচ্ছে সড়ক-মহাসড়ক অর্থাৎ অবৈধ চালক আর যানবাহনের দখলে দেশের ৩৬১ রুট। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ পরিষদের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৮ লাখ নসিমন, করিমন, ভটভটি বিভিন্ন সড়কে চলাচল করছে। ৩ লক্ষাধিক ব্যাটারি চালিত রিক্সা ও ইজি বাইক মহাসড়কে যাতায়াত করছে নিয়মিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ৯১ ভাগ চালক। পরীক্ষা ছাড়াই লাইসেন্স পাচ্ছে ৬১ ভাগ ড্রাইভার। পরিবহন সেক্টরের অরাজগকতা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেই। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে রাজধানীতে মোট যানবাহনের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ১৬ হাজার ৯১২টি। পাঁচ বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত পরিবহনের সংখ্যা আট লাখ ৩৫ হাজার ৮১২টি। এরমধ্যে বাসের সংখ্যা ২১ হাজার ৪৯৩টি। মোটরসাইকেলের সংখ্যা তিন লাখ ২৮ হাজার ৩৪২টি। প্রাইভেট পেসেঞ্জার কারের সংখ্যা দুই লাখেরও বেশি আছে। চলতি বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে রেজিস্ট্রেনভুক্ত মোট পরিবহনের সংখ্যা ২১ লাখ পাঁচ হাজার ১৪০টি। এরমধ্যে অটোরিক্সার সংখ্যা দুই লাখ ২১ হাজার ৮৬টি। ডেলিভারি ভ্যান ২০ হাজার ৫৬২টি, জিপ প্রায় ৪০ হাজার, প্রায় ৮০ হাজার মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল রয়েছে ১১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি। প্রাইভেট পেসেঞ্জার কারের সংখ্যা ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৭টি। ট্রাক রয়েছে এক লাখ ৬৫ হাজারের বেশি। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে, সারাদেশে তিন লাখ ১৩ হাজার যানবাহন চলাচল যোগ্যতা (ফিটনেস) সনদ ছাড়াই চলছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকাতেই ফিটনেস সনদবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ৯৩ হাজার ৬০৪। শতকরা হিসাবে প্রায় ৩৩ ভাগ যানবাহনেরই ফিটনেস নেই। মোটরযান আইনে ফিটনেস পেতে অন্তত ৩০ ধরনের কারিগরি ও বাহ্যিক বিষয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। কিন্তু বিআরটিএ পরীক্ষার কাজে কোনো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে না। চোখে দেখে ফিটনেস দেয়া হয় সকল প্রকার যানবাহনকে। আবার ফিটনেস পেতে বিআরটিএ কার্যালয়ে গাড়ি হাজির করার নিয়ম রয়েছে। অভিযোগ আছে, বাস, ট্রাকসহ অধিকাংশ গণপরিবহন বিআরটিএ কার্যালয়ে না নিয়েই ফিটনেস সার্টিফিকেট মিলছে। স্টাফ রিপোর্টার বগুড়া অফিস থেকে জানান, পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনা রোধ ও সড়কের নিরাপত্তা জোরদার করতে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। তবে বগুড়ায় গণপরিবহনের বড় অংশের ফিটনেসসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় এ বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। অভিযানের প্রথম দিনেই বগুড়া কেন্দ্রীয় বাসটার্মিনাল থেকে বেশিরভাগ গাড়ি রাস্তায় বের হয়নি। কারণে যাত্রীদেরও দুর্ভোগে পড়তে হয়। তবে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন। অভিযানের প্রথম দিনে ফিটনেসসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় কিছু যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা ও জরিমানা আদায় করেণ ভ্রাম্যমাণ আদালত। বগুড়া পরিবহন মালিক সমিতির আওতায় প্রায় এক হাজার বাস-মিনিবাস চলাচল করে। মালিক সমিতিসহ বিআরটিএ বগুড়া সার্কেল সূত্র বলছে এসব গাড়ির ৮০ ভাগই ফিটনেসবিহীন। এছাড়া সিএনজি চালিত অটোরিক্সার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। জেলায় চলাচলরত প্রায় ১০ হাজার অটোরিক্সার মধ্যে রেজিস্ট্রেশন রয়েছে মাত্র প্রায় ৪ হাজার।
×