ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫, ৭ শ্রাবণ ১৪৩২

আমার মেয়ে আর আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে না, এই কষ্ট কীভাবে সহ্য করব, মাইলস্টোন স্কুলের ঘটনায় নিহত সায়মার বাবা

স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর।

প্রকাশিত: ২০:০৯, ২২ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ২০:১০, ২২ জুলাই ২০২৫

আমার মেয়ে আর আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে না, এই কষ্ট কীভাবে সহ্য করব, মাইলস্টোন স্কুলের ঘটনায় নিহত সায়মার বাবা

তুই আমার কলিজা, তুই আমার জান। প্রতিদিন আমরা একসঙ্গে স্কুলে যেতাম। এখন আমি কাকে নিয়ে স্কুলে যাব? তুই কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলি? আমি তোকে ছাড়া বাঁচব না। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দূর্ঘটনায় তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী আদরের ছোট বোন নিহত সায়মা আক্তারের লাশ দেখে কান্নায় চোখের জল মুছতে মুছতে তার বড় ভাই সাব্বির হোসেন এসব কথা বিলাপ করে বলেন। সাব্বির একই বিদ্যালয় থেকে চলতি বছর এসএসসি পাস করেছে। 

মঙ্গলবার (২২ জুলাই) ঘটনাস্থলে গিয়ে জানা গেছে, সায়মা আক্তারের বাবা শাহ আলম গাজীপুর মহানগরীর সদর থানাধীন ২১ নম্বর ওয়ার্ডের বিপ্রবর্থা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি মা-ভাইসহ স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে রাজধানীর উত্তরায় নিজস্ব ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন। তিনি প্রাণ-আরএফএল কোম্পানিতে ফেনী এলাকায় কর্মরত। তার মেয়ে সায়মা আক্তার (৯) উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী এবং বড় ছেলে সাব্বির হোসেন চলতি বছর একই বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছে।

সোমবার (২১ জুলাই) বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় নিহত হয় সায়মা আক্তার। সায়মার মৃত্যুর খবর শুনে প্রতিবেশিসহ আত্মীয় স্বজনরা রাত থেকেই তাদের গ্রামের বাড়িতে ভীড় জমাতে থাকে। রাত দুইটার দিকে সায়মার লাশ স্বজনরা গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসে। আগুনে পুড়ে যাওয়া সায়মার মুখ দেখে অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। মঙ্গলবার সকালে নিহতের গ্রামের বাড়ি গিয়ে দেখা গেছে মঙ্গলবার লাশবাহী একটি ফ্রিজিং গাড়িতে শিশু সায়মা আক্তারের লাশ রাখা ছিল। এসময় মেয়ের লাশের পাশে বসে রিনা বেগম বিলাপ করছিলেন। তিনি মূর্ছা যাচ্ছিলেন। সায়মা আক্তারের স্মৃতি স্মরণ করে নিহতের বড় ভাই ও বাবা শিশু সায়মার শোকে আহাজারী করছিলেন। প্রতিবেশিসহ স্বজনরাও কান্না করছিলেন। তাদের আহাজরীতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। ভারী হয়ে ওঠে চারপাশের পরিবেশ। এসময় অন্যরা তাদের শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

নিহতের বাবা বলেন, উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাটি আমার এক বন্ধু ফোন করে আমাকে জানায়। খবর পেয়েই স্কুলে গিয়ে সারাদিন খোঁজাখুঁজি করেও আমার মেয়ের সন্ধান পাইনি। বিভিন্ন স্থানে ও হাসপাতালে খোঁজাখুঁজির পর রাত ৮টার দিকে জানতে পারি সিএমএইচে তার লাশ রাখা আছে। ভোর রাত তিনটার দিকে সায়মার লাশ গাজীপুরে গ্রামের বাড়িতে আনা হয়।

তিনি আরো বলেন, রবিবার রাতেও আমার কলিজার টুকরো মেয়েটি আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছিল। রাতে কতবার চুমু দিয়েছে, তার হিসেব নেই। এরপর আর মায়ের (সায়মা) সঙ্গে কথা হয়নি। আমার মেয়ে আর আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে না। এই কষ্ট আমি কীভাবে সহ্য করব?

সায়মার মা রিনা বেগম বলেন, প্রতিদিনই মেয়েকে আমি স্কুলে নিয়ে যাই। কিন্তু, গতকাল যাইনি। আমার এক ভাই সায়মাকে স্কুলে নিয়ে যায়। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সায়মা আমাকে বলেছিল আম্মু আমি স্কুলে যাচ্ছি, টাটা, বাই বাই। এটাই যে আমার মেয়ের সঙ্গে শেষ কথা ছিল বুঝতে পারিনি। সায়মার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে চিকিৎসক হবে, মানুষের সেবা করবে। দুপুরে ফেসবুকে জানতে পারি, আমার মেয়ে দুর্ঘটনায় মারা গেছে। এসব বলে মা রিনা বেগম বিলাপ করে কাঁদছেন। আশপাশের প্রতিবেশী নারীরাও তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

মঙ্গলবার (২২ জুলাই) বেলা ১১টার দিকে স্থানীয় জামে মসজিদের মাঠে জানাজার পর সায়মা আক্তারকে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়। এসময় এলাকাবাসী জানান, সায়মার মৃত্যুতে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সায়মার মৃত্যু শুধু তার পরিবার নয়, পুরো এলাকাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। প্রতিভাবান একটি শিশু, যার জীবন শুরুই হয়নি ঠিকভাবে, তাকে বিদায় জানাতে গাজীপুরের আকাশও যেন ভারী হয়ে উঠেছে।

 
 

রিফাত

×