
ছবি: দৈনিক জনকন্ঠ।
বর্ষা এলেই বদলে যায় গ্রামবাংলার চিত্র। খাল-বিল, ধানক্ষেত, জলমগ্ন মাঠে জমে থাকা পানির ফাঁকে দেখা মেলে ছোট ছোট থোকা। কারও চোখে পড়ে, কারও পড়ে না। অনেকেই জানেন না, এ রকম সাদা বা গোলাপি রঙের থোকাগুলো জলজ শামুকের ডিম। প্রাকৃতিক নিয়মে এই সময়টাতেই শুরু হয় তাদের প্রজনন চক্র।
জমে থাকা পানির পাশে, কচুরিপানার গোড়ায় কিংবা ধানের আইলের কাছে, কখনও আবার বাঁশঝাড়ের গোঁড়ার নরম কাদামাটিতে জমা হয় এসব ডিম। কয়েক দিনের মধ্যে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে ক্ষুদ্রাকৃতির শামুক। তবে এই দৃশ্য এখন আগের চেয়ে অনেক কম দেখা যাচ্ছে।
খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কৃষক আব্দুল মালেক বলছিলেন, “আগে বৃষ্টির সময় খালে খালে শামুকের ডিম দেখা যেত। হাঁস-মুরগির জন্য শামুকও পাওয়া যেত সহজে। এখন খাল শুকনা, আর শামুকও তেমন নেই।”
শুধু পাইকগাছা নয়, দক্ষিণাঞ্চলের দাকোপ, কয়রা, ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটার গ্রামাঞ্চল ঘুরে একই চিত্র পাওয়া গেছে। বর্ষা এলেও শামুকের ডিম বা শামুকের দেখা মিলছে কম। স্থানীয়দের অনেকেই বলছেন, এখনকার ছেলেমেয়েরা এই প্রাণী চিনেই না।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদা সুলতানা বলেন, “শামুকের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু নির্দিষ্ট কারণ আছে। জলবায়ু পরিবর্তন, অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার, জমিতে পানি না দাঁড়ানো এবং খাল-বিল ভরাট হওয়ায় শামুকের প্রজননব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক জায়গায় আবার শামুক ধরে বিক্রি করার প্রবণতাও বেড়েছে।”
শামুক শুধু একটি প্রাণী নয়, পরিবেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘জৈব বিশ্লেষক’। এরা পচনশীল জৈব বস্তু খেয়ে জলাশয়কে পরিচ্ছন্ন রাখতে সাহায্য করে। এ ছাড়া হাঁস, মাছসহ অনেক জলজ প্রাণীর জন্য শামুক একটি প্রাকৃতিক খাদ্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শামুক কমে গেলে কৃষির ওপরও প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে যাঁরা জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদে আগ্রহী, তাঁদের জন্য এটি একটি বড় সংকট। জমিতে শামুক না থাকলে জৈব সার তৈরি হয় না, মাটির স্বাস্থ্যও নষ্ট হয় ধীরে ধীরে।
স্থানীয় পর্যায়ের পরিবেশ সংগঠন ‘দাকোপ জীববৈচিত্র্য ফোরাম’-এর আহ্বায়ক নজরুল শেখ বলেন, “আমরা কয়েক বছর ধরে বর্ষার সময় শামুকের ডিম সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছি। মাঠে দেখলে শিক্ষার্থীদের দিয়ে তা নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রাখা হয়। তবে সচেতনতার অভাবে এখনও অনেক জায়গায় এগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।”
শামুকের ডিম অনেক সময় মাঠে কাজ করা শ্রমিকদের পায়ের নিচে পিষ্ট হয়। আবার শিশুরা খেলাচ্ছলে পিষে ফেলে। জমিতে ব্যবহৃত কীটনাশক ও বিষাক্ত পানি শামুকের ডিমের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। অতিবৃষ্টি হলে ডিম পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে যায়।
পরিবেশবিদদের মতে, এখনই না ভাবলে আগামী প্রজন্মের জন্য শামুক শুধু বইয়ের পাতায় রয়ে যাবে। তাঁরা বলছেন, প্রথমে প্রয়োজন স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা গড়ে তোলা। জমিতে রাসায়নিক ব্যবহার কমানো, খাল-বিল সংরক্ষণ এবং স্কুলের পাঠ্যক্রমে প্রজনন মৌসুম ও জলজ প্রাণীদের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা সংযুক্ত করাও জরুরি।
প্রতিবছরই বর্ষায় মাঠে শামুকের জন্ম হয়, একটি নিঃশব্দ প্রক্রিয়ায়। সেটা হয়ত আমাদের চোখে পড়ে না, কিন্তু প্রকৃতি নিজের মতো করে কাজ করে চলে। সেই চক্র বাধাগ্রস্ত হলে তার প্রভাব পড়ে পুরো পরিবেশের ওপর।
একটি শামুক হয়ত কিছুই নয়। কিন্তু তার অনুপস্থিতি বলে দেয়, প্রকৃতির ভিত কোথাও নড়ছে।
মিরাজ খান