ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

মিরসরাই ট্র্যাজেডি: ১৪ বছরেও হয়নি প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন

ফিরোজ মাহমুদ, মিরসরাই, চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ১৫:৫৫, ১১ জুলাই ২০২৫

মিরসরাই ট্র্যাজেডি: ১৪ বছরেও হয়নি প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন

ছবি: সংগৃহীত

রায়হান উদ্দিন চৌধুরী অপু, ছিলেন অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। কৃষক বাবার একমাত্র সন্তান। বাবার স্বপ্ন ছিলো ছেলেকে ডাক্তারি পড়াবেন। পড়াশোনা শেষে পরিবারের হাল ধরাসহ এলাকাবাসীর বিনা পয়সায় চিকিৎসায় এগিয়ে আসবেন। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। ভয়াল ট্র্যাজেডি কেড়ে নিলো তার স্বপ্নেভরা জীবনটা। সন্তানহারা হয়ে পড়লেন তার পরিবার।

২০১১ সালের ১১ জুলাই ভয়াবহ এক সড়ক দুর্ঘটনায় চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে নিহত হন ৪৫ কোমলমতি শিক্ষার্থী। এতে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন ৩৪ জন। আশপাশের অন্যন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আরও ৭ জন ও একজন অবিভাবক ও দুইজন ফুটবলপ্রেমী নিহত হন।

আজ সেই ট্র্যাজেড়ির ১৪ বছর পূর্ণ হলেও সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন মহল ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা নিহতদের পরিবারের সদস্যদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তার কোনো কিছুরই বাস্তবায়ন হয়নি বলে অভিযোগ করেন নিহতদের পরিবারগুলো।

আজ স্কুল আঙিনায় কথা হয় ওই সময়কার ৮ম শ্রেণিতে পড়ুয়া আমিন শরীফের মা হোসনেয়ারা, ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী রায়হান উদ্দিন চৌধুরী অপুর বাবা সোলতান আহমদ, ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাজীব হোসেনের বাবা আনোয়ার পাশার সঙ্গে।

তারা জানান, ‘আমাদের সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তখন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের চাকরি দেবে। কিন্তু আজ ১৩টি বছর কেটে গেলেও কেউ কোন খোঁজ রাখেনি। এমনকি স্কুল কর্তৃপক্ষও কোনো ধরনের সহযোগিতা করেননি। শুধু এই দিবসটি আসলে আমাদের ডেকে আনেন। আলোচনা সভা করেই সব শেষ করে দেন। সন্তানহারা পরিবারের সাথে দেখা করা কিংবা কথা বলেন না তারা। অনেক পরিবার একমাত্র সন্তান হারিয়ে রোজগারের উপযোগী কেউ না থাকায় অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটায়।’

আমিন শরীফের মা হোসনেয়ারা জানান, ‘আমিন শরীফ আমার একমাত্র সন্তান। বর্তমানে তার বাবার কোনো ইনকাম নেই। আমার ছেলে যদি থাকতো তাহলে আজ সে লেখাপড়া শেষ করে পরিবারের হাল ধরতো। কিন্তু ভয়াল এই দুর্ঘটনায় আমার সব কেড়ে নিয়েছে,’ বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

রায়হান উদ্দিন চৌধুরী অপুর বাবা সোলতান আহমদ ও রাজীব হোসেনের বাবা আনোয়ার পাশা বলেন, ‘শুধু দিসবটি আসলে স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাদের ডাকেন। আর কখনও তারা খবর রাখেন না আমাদের পরিবারগুলোর। আমাদের অনেক পরিবারের একমাত্র সন্তার হারিয়ে দুঃখ-কষ্টে জীবন যাচ্ছে। ১১ জুলাইয়ের এই দিনটিকে নিরাপদ সড়ক দিবস ঘোষণার দাবি জানালেও তা আলোর মুখ দেখেনি।’

আবুল কাশেম নামের এক অবিভাবক বলেন, ‘আমার একটা সন্তার হারিয়েছি। আরেকটি সন্তানের একটি চাকরির জন্য বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে ঘুরেছি। কিন্তু কেউ আমাদের সহযোগিতা করেনি। এমনকি স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে গেলেও তার কোনো ধরনের সহযোগিতা কিংবা আশ্বাস দেননি,’ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ১১ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাই স্টেডিয়ামে ‘বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট’র খেলা শেষে একটি ট্রাকে করে বিজয়োল্লাস করে আবুতোরাবে ফেরার পথে সৈদালীতে একটি ডোবায় শিক্ষার্থীদের বহনকারী মিনি ট্রাকটি উল্টে যায়। ওই সময় বাঁচানো যায়নি পিকআপের তলানিতে আটকে পড়া কোনো ক্ষুদে শিক্ষার্থীকে। একে একে নিথর দেহে পরিণত হয় আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩৪ জনসহ আশপাশের কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৭ জন ও একজন অবিভাবক ও দুইজন ফুটবলপ্রেমী যুবক, তাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রচিত হয় মিরসরাই ট্র্যাজেডি। ওই বছর ট্র্যাজেডিতে নিহতদের স্মরণীয় করে রাখতে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রবেশমুখে স্থাপন করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’ আর দুর্ঘটনাস্থলে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ ‘অন্তিম’।

দিবসটি উপলক্ষে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সকাল ১০টায় নিহতদের স্মরণে দুই স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন, বেলা ১১টায় স্কুলের হলরুমে আলোচনা সভার আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সোমাইয়া আক্তার, নিহতদের পরিবার, স্বজন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এলাকাবাসী।

রাকিব

আরো পড়ুন  

×