ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২

একটি ফলাফল, একটি আত্মহত্যা - এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল পরবর্তী বাস্তবতা

সৈয়দ আমিনুল ইসলাম, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ০৯:১৩, ১১ জুলাই ২০২৫

একটি ফলাফল, একটি আত্মহত্যা - এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল পরবর্তী বাস্তবতা

গতকাল প্রকাশিত হলো ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল। সারাদেশে আনন্দ-উল্লাস, ফুল-মিষ্টির বাহারি আয়োজন। কিন্তু এই উল্লাসের পাশে অদৃশ্য এক শোকের রেখা। যারা পাস করতে পারেনি, তাদের জীবনে যেন নেমে এসেছে এক চিরকালীন অন্ধকার। সব শিক্ষা বোর্ড মিলিয়ে ফেল করেছে ৬ লাখ ৬৬০ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ৩ লাখ ২৪ হাজার ৭১৬ জন ছাত্র এবং ২ লাখ ৭৫ হাজার ৯৪৪ ছাত্রী। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে কয়েকটি আত্মহত্যার সংবাদ। অকৃতকার্য হওয়ার কারণে কয়েকজন কিশোর-কিশোরী চিরতরে বিদায় নিয়েছে এই দুনিয়া থেকে। প্রশ্ন জাগে শুধুমাত্র পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া মানেই কি জীবন শেষ?

 

পরিবারের চোখে এই ফলাফলই যেন পুরো ভবিষ্যতের মানচিত্র। পাস করলেই ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, ফেল করলেই অন্ধকার - এমন এক কঠিন মানসিক কাঠামোতে বেড়ে ওঠে আমাদের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মানসিক প্রস্তুতি কি সত্যিই তৈরি হয় সেই অনুপাতে?

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যা হচ্ছে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বাংলাদেশেও পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। ব্যর্থতার ভয়, পরিবারের চাপে পড়া, আত্মীয়-প্রতিবেশীদের তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি সব মিলিয়ে এই বয়সী শিক্ষার্থীরা তীব্র মানসিক চাপে থাকে। ফলে ছোট একটি ব্যর্থতাই তাদের কাছে হয়ে ওঠে জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন।

 

পরীক্ষায় খারাপ ফলাফলের পর অনেক শিক্ষার্থী পরিবারে ফিরে পান না সমবেদনার জায়গা। বরং শুনতে হয় কটু কথা, অপমান, কখনো শারীরিক নির্যাতনও। এক শ্রেণির অভিভাবক নিজের অতৃপ্ত স্বপ্ন সন্তানদের ওপর চাপিয়ে দেন। আবার অনেকে সন্তানের ব্যর্থতায় নিজেদের সামাজিক অবস্থানকে ‘লজ্জিত’ মনে করেন। এই মানসিকতা শিক্ষার্থীদের আরও কোণঠাসা করে তোলে।

 

বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় সাফল্যকে মাপা হয় জিপিএ দিয়ে। কিন্তু একজন শিক্ষার্থীর মানবিকতা, সৃজনশীলতা, নেতৃত্বগুণ, সামাজিক সচেতনতা এসবের কোনো মূল্যায়ন হয় না। অনেকেই হয়তো সৃজনশীলতা বা কারিগরি কাজে দক্ষ, কিন্তু পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ায় তাকে ব্যর্থ বলে গন্য করা হয়। এই একপেশে মানদণ্ডের কারণে হতাশা আরও বাড়ে।

 

এজন্য স্কুলে ও পরিবারে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা জরুরি। শিক্ষার্থীদের শেখাতে হবে একটা পরীক্ষায় ফেল করা মানে জীবন শেষ নয়। অভিভাবকদের উচিত সন্তানের প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসা প্রদর্শন করা। ‘তুমি পারবে’, ‘চেষ্টা করো’, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’- এই ধরনের কথাই অনেক সময় একজন হতাশ শিক্ষার্থীর প্রাণ বাঁচাতে পারে। শিক্ষা ব্যবস্থায় নম্বরের চেয়ে দক্ষতা ও আগ্রহকে গুরুত্ব দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তোলা উচিত। আত্মীয়, শিক্ষক, প্রতিবেশী সবার উচিত একজন শিক্ষার্থীকে ব্যর্থতার পরেও মানুষের মতো করে দেখতে শেখা।

 

একটি ফেল করা পরীক্ষার চেয়ে একটি মানুষের জীবন অনেক বেশি মূল্যবান। সময় এসেছে শিক্ষা ব্যবস্থার সেই প্রাচীন চক্র ভাঙার, যেখানে একজন শিশু কেবল একটা ফলাফলের ওপর দাঁড়িয়ে নিজের পুরো ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। আসুন, আমরা প্রশ্ন করি - একটি ফলাফলের জন্য যদি একজন কিশোর/কিশোরী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়, তাহলে আমরা ঠিক কোন শিক্ষাকে সফলতা বলছি?

আঁখি

×