
ফেনীর মুহুরী সিলোনিয়া নদীর বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করে প্লাবিত হয়েছে নি¤œাঞ্চলের ব্যাপক এলাকা
ফেনীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৪টি স্থান ভেঙে কমপক্ষে ২০ গ্রামের ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। লোকালয়ে পানি ঢুকে নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এদিকে, ভারি বর্ষণে চট্টগ্রাম মহানগরসহ জেলার নিচু এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে। সড়ক ডুবে যাওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য লাইটারিং প্রায় বন্ধ।
নগরীতে নালায় পড়ে তিন বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধসের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় নিরাপদে থাকতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহরে মাইকিং করা হচ্ছে। কুমিল্লায় গোমতী নদীর পানি বাড়ায় বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতার।
টানা বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরামের মুহুরী, সিলোনিয়া নদীর ১৪টি স্থানের ভাঙন দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে ২০ গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ এখন পানিবন্দি। এদিকে, ফেনী শহরের কিছু কিছু এলাকা থেকে পানির নামলেও অধিকাংশ এলাকায় এখনো জলাবদ্ধতা রয়েছে।
পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, মুহুরী নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পরশুরাম উপজেলার জঙ্গলঘোনায় দুটি, অলকায় তিনটি, শালধর এলাকায় একটি, ফুলগাজী উপজেলার উত্তর শ্রীপুর এলাকায় একটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সিলোনিয়া নদীর পরশুরামের গদানগর এলাকায় একটি ও ফুলগাজীর দেড়পড়া এলাকার দুটি স্থানে ভেঙেছে। এছাড়া, মহুয়া নদীর পরশুরাম উপজেলার সাতকুচিয়ায় দুটি, বেড়াবাড়িয়ায় একটি ও ফুলগাজী উপজেলার দৌলতপুর এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের একটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে এসব স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। পরশুরামের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফুর রহমান বলেন, রাত থেকে বাঁধের কোনো স্থানে নতুন করে ভাঙেনি। লোকালয়ে পানি ঢুকে নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। আমরা দুর্গতদের পাশে থেকে কাজ করছি।
ফেনী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মজিবুর রহমান বলেন, টানা তিনদিন মাঝারি ও ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। বুধবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩০৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বৃষ্টিপাত কিছুটা কমেছে। আগামীকালও (আজ) জেলাজুড়ে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন মজুমদার বলেন, নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার ৯৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে, মধ্যরাত থেকে পানি কিছুটা কমেছে। উজানে বৃষ্টি বন্ধ থাকলে বাঁধ ভাঙনের শঙ্কা কম।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জানান, জেলা প্রশাসন থেকে ফুলগাজী, পরশুরাম ও ফেনী সদর আংশিক এলাকার জন্য ১৯টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে ৩৮০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নগদ টাকা ১২০ মে. টন চাল, ৪শ’ প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আশ্রয় কেন্দ্রে খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকার সামজিক সংগঠন ত্রাণ কাজ শুরু করেছে।
চট্টগ্রাম ॥ তিনদিনের ভারি বর্ষণে মহানগরসহ পুরো চট্টগ্রাম জেলায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ডুবে গেছে শহর ও গ্রামের নিচু এলাকা। সড়ক ডুবে যাওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে অনেক এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। নগরে নালার পানিতে পড়ে তিন বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য লাইটারিং একপ্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
গত সোমবার থেকে শুরু হওয়া বর্ষণের তীব্রতা বুধবার ছিল সবচেয়ে বেশি। আগের দিন রাত থেকে থেমে থেমে টানা বর্ষণ অব্যাহত ছিল সারাদিন। পুরো দিনে একটিবারের জন্যও সূর্যের আলো দেখা যায়নি। চট্টগ্রাম মহানগরীর নিচু এলাকাগুলো পানির নিচে চলে যায়। অনেক স্থানে দেখা দেয় জলজট। এর ফলে জনজীবনে স্থবিরতা নেমে আসে। বিশেষ করে স্কুলগামী শিশু কিশোর ও কর্মস্থলমুখী মানুষকে খুবই বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়। তবে আবহাওয়া বৈরী থাকায় অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পাঠদান বন্ধ রাখা হয়। শ্রমজীবী মানুষদের পড়তে হয় মারাত্মক দুর্ভোগে।
চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর আনন্দপুর গেট এলাকায় এক শিশু নালায় পড়ে নিখোঁজ হয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের টিম শিশুটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, বুধবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় ১৬০ দশমিক ২ মিলিমিটার। মৌসুমি জলবায়ু প্রবলভাবে সক্রিয় রয়েছে বিধায় সমুদ্র বন্দরগুলোকে তিন নম্বর এবং দেশের নদী বন্দরসমূহকে এক নম্বর সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস কর্মকর্তা মো. ইসমাইল ভূঁইয়া জানান, বৃহস্পতিবার থেকে বৃষ্টিপাতের তীব্রতা কমে আসবে। তবে একেবারে বন্ধ হবে না। হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত এবং সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া থাকবে।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, বৃষ্টিপাতের মধ্যেও জেটিতে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং স্বাভাবিক নিয়মেই হয়েছে। কিন্তু বহির্নোঙরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সাগরে উঁচু ঢেউয়ের পাশাপাশি প্রবল বাতাস থাকায় ছোট জাহাজগুলোর পক্ষে বড় জাহাজের পাশে স্থির থাকা কঠিন হয়ে পড়ায় এই প্রতিকূল অবস্থা। অভ্যন্তরীণ জলপথে পণ্য পরিবহনও থমকে গেছে।
বৃষ্টিপাতের ফলে চট্টগ্রাম নগরীর কাপাসগোলা, বাদুরতলা, শুলকবহর, চকবাজার, পাঁচলাইশ, কাতালগঞ্জ, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, ছোটপুলসহ নি¤œাঞ্চলের সড়ক এবং অনেক বাড়িঘরের নিচতলা ডুবে যায়। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঢুকেছে পানি। ফলে ব্যবসায়ীদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
মহানগরীর বাইরে চট্টগ্রাম জেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলায় বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। মীরসরাই, সীতাকু-, ফটিকছড়ি, আনোয়ারা, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, চন্দনাইশসহ বিভিন্ন উপজেলাতে জনকণ্ঠের সংবাদদাতারা ভোগান্তির তথ্য তুলে ধরেন। টানা বর্ষণের পাশাপাশি পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়েছে ফসলের মাঠ ও মৎস্যখামার। অনেক পুকুরে পাড় ডুবে মাছ বেরিয়ে গেছে। এতে কৃষক ও মাছচাষীদের মাথায় হাত পড়েছে।
রাঙ্গামাটি ॥ দুদিন ধরে টানা বৃষ্টিপাতে পাহাড় ধসের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বুধবার বিকেলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী লোকজনকে নিরাপদে আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য বলা হয়েছে। জেলায় কখনো ভারি ও কখনো মাঝারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
দুর্যোগ মোকাবিলায় রাঙ্গামাটি পৌরসভায় জরুরি সভা করা হয়েছে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে নতুন করে ভূমি ধসসহ প্রকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিতে পারে। এ জন্য জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সজাগ থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। এদিকে, কাপ্তাই লেকের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাঘাইছড়ি, লংগদু ও বরকল উপজেলা এলাকার নি¤œাঞ্চল ডুবে গেছে।
কুমিল্লা ॥ টানা বর্ষণে বেড়েছে কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি। ফলে, জেলার গোমতী নদীর দুই পাড়ের জেলার সাতটি উপজেলার বেশকিছু এলাকায় বাঁধ ভাঙার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় পানি গোমতী নদীর ৯ দশমিক ৮ মিটারে প্রবাহিত হচ্ছিল। প্রতি ঘণ্টায় পানি ৮ থেকে ৯ সেন্টিমিটার করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কুমিল্লা কার্যালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
পাউবো সূত্র আরও জানায়, ভারত থেকে নেমে আসা উজানের ঢলে গত ২৪ ঘণ্টায় গোমতীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সন্ধ্যা ৬টায় গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমার ১ দশমিক ৯৫ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গোমতী নদীর বিপৎসীমা ১১ দশমিক ৩ মিটার।
পাউবো কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মো. ওয়ালিউজ্জামান বলেন, টানা বর্ষণ আর উজানের ঢলে গোমতী নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃষ্টি থেমে গেলে এবং উজানের ঢল বন্ধ হলে বিপদ কাটতে পারে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে গোমতীর প্রতিরক্ষা বাঁধের জন্য হুমকি হতে পারে। জেলা ও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় আমরা বাঁধ এলাকায় সার্বক্ষণিক নজরদারি করছি।
প্যানেল মজি